Advertisement
E-Paper

নীরব শিল্পীর নীরব বিদায়

বরাবর শান্ত, নীরবে তুলির টান দিয়ে চলা এক শিল্পী তিনি। স্থিরতা যে খেলার মাঠে সব চেয়ে বড় অস্ত্র হতে পারে, তা চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন এই প্রজন্মের তিন নায়ক।

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৮ ০৪:৫২
আড়ালে: ইনিয়েস্তা সেই পর্দার পিছনেই। ফাইল চিত্র

আড়ালে: ইনিয়েস্তা সেই পর্দার পিছনেই। ফাইল চিত্র

এই তা হলে শেষ দেখা, আন্দ্রে ইনিয়েস্তা!

উন্নত শিরে নয়, অবনত মস্তকে!

বিজয় উৎসবে নয়, পরাজয়ের অন্ধকারে!

তাঁর ফুটবল আঁতুড় ঘর বার্সেলোনা ছেড়ে আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ৩৪ বছর বয়সি ইনিয়েস্তা বিশ্বকাপে হারের পরে জানিয়ে দিলেন, স্পেনের হয়েও আর খেলবেন না। এর পরে গন্তব্য জাপান ফুটবল লিগ। লা লিগার মতো যার কোনও সরাসরি টিভি সম্প্রচার বিশ্বের সর্বত্র পৌঁছবে না। দৈনন্দিন সিস্টেমে ঢুকে গিয়েছিল, ইনিয়েস্তা বল বাড়াবেন, মেসি গোল করবেন। সেই হিস্টিরিয়া থেমে গেল, শেষ হয়ে গেল একটা যুগ। তাঁর বিদায়ে হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তিকিতাকা নামক মোহময়ী স্প্যানিশ শিল্পই!

বরাবর শান্ত, নীরবে তুলির টান দিয়ে চলা এক শিল্পী তিনি। স্থিরতা যে খেলার মাঠে সব চেয়ে বড় অস্ত্র হতে পারে, তা চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন এই প্রজন্মের তিন নায়ক। টেনিসে রজার ফেডেরার, ক্রিকেটে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি এবং ফুটবলে আন্দ্রে ইনিয়েস্তা। উইম্বলডন শুরু হয়ে গিয়েছে। ফেডেরারকে দেখা যাবে মুখ নিচু করে নিজের র‌্যাকেট ঠিক করতে করতে সবুজ ঘাসে এ কোর্ট থেকে ও কোর্টে চলে যাচ্ছেন। তেমনই মসৃণ ভাবে পেরিয়ে যাবেন একটার পর একটা পয়েন্ট। বিশ্বকাপ জিতেও আবেগের বিস্ফোরণ ঘটে না ধোনির। ফুটবলে তেমনই অবিচল থেকে একের পর এক মাইলফলক পেরিয়ে গিয়েছেন ইনিয়েস্তা। প্রতিপক্ষ বুঝতেও পারে না, কখন তাদের দুর্গে হানা দেন স্প্যানিশ শিল্পী!

লা মাসিয়া অ্যাকাডেমিতে যোগ দেন ১২ বছর বয়সে। বাড়ি থেকে আলাদা হয়ে হস্টেলে থাকবেন না বলে কান্নাকাটি জুড়েছিলেন। বাবা-ঠাকুরদা তাতে নরম হয়ে পড়েছিলেন। কঠোর ছিলেন মা। ‘‘ওকে চেষ্টা করতে দাও,’’ বলে মা ঠেলে দিয়েছিলেন জীবনযুদ্ধের নির্মম রাস্তায়। মন ভেঙে দেওয়া বিকেলে অ্যাকাডেমির গেটের বাইরে এসে কিশোর ইনিয়েস্তা আবিষ্কার করেন, তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পরিবারের কেউ আসেননি। ভিতরের কান্না বুকে চেপে আবার গেট ঠেলে ঢুকে যান অ্যাকাডেমির ভিতরে। যখন বেরোলেন, স্প্যানিশ ফুটবলের উজ্জ্বলতম গ্র্যাজুয়েট!

২০১০ বিশ্বকাপে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন না। রাতের অন্ধকারে হোটেলের করিডরে দৌড়তেন ফিটনেস ঠিক আছে কি না পরখ করার জন্য। কোনও ট্রেনার বলেননি, পরীক্ষা না-দিলে তোমাকে নেওয়া হবে না। কোচ বলেননি, ফিট না-হলে দলে জায়গা হবে না। তবু ইনিয়েস্তা তারকার পাসপোর্ট দেখিয়ে দলে আসতে চাননি। পরীক্ষায় পাশ করে খেলতে চেয়েছেন। খেলার নির্মম পৃথিবী! এমন দায়বদ্ধ সৈনিককে তাঁর শেষ ম্যাচে বেঞ্চে বসিয়ে দিল স্পেন টিম ম্যানেজমেন্ট!

রাশিয়ার কাছে টাইব্রেকারে ম্যাচটা হারার পরে সের্খিয়ো র‌্যামোস এবং জোর্ডি আলবা যে-ভাবে তাঁকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেটাই সব চেয়ে গভীর মুহূর্ত হয়ে থাকল। বরাবরের সেই স্তম্ভের মতো দেখাচ্ছিল তখন তাঁকে। ছেড়ে দিলেই যেন র‌্যামোসরা পড়ে যাবেন। স্পেন পড়ে যাবে! প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে ওঁরা তাই যেন বলতে চাইছেন, আন্দ্রে যেয়ো না।

আরও পড়ুন: পেনাল্টির রাজা হয়ে উঠছেন হ্যারি কেন

সব খেলাতেই দু’ধরনের আইন হয়। একটা লিখিত। অন্যটা অলিখিত। অনেক সময়ে অলিখিত নিয়মের স্বর সব চেয়ে জোরালো শোনায়। তারই নাম ‘স্পোর্টসম্যান স্পিরিট’। ইনিয়েস্তা যার সর্বশ্রেষ্ঠ দূত। মাঠের মধ্যে অভব্য আচরণ বা উত্তেজিত বাক্য বিনিময় করতে দেখা যায়নি তাঁকে। ক্যামেরুন তারকা স্যামুয়েল এটো এক বার বলেছিলেন, ‘‘খেলার মধ্যে ইনিয়েস্তাকে আঘাত করলে শুনতে হয়, ও-ই বলছে, সরি।’’ র‌্যামোস এত মারকুটে ডিফেন্ডার। ক্লাব ফুটবলে খেলেন ইনিয়েস্তার যুযুধান প্রতিপক্ষ রিয়াল মাদ্রিদে। সেই তিনিও বলেছিলেন, ‘‘ওর গায়ে পা ছোঁয়াতে পারব না। অসম্ভব! ও হচ্ছে সেন্ট আন্দ্রে।’’

বার্সেলোনার হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন চার বার। সঙ্গে ন’বার লা লিগা, ছ’বার কোপা দেল রে, ছ’বার স্প্যানিশ সুপার কাপ। দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন এক বার (২০১০), ইউরো দু’বার (২০০৮, ২০১২)। এত সব সাফল্যের মধ্যেও মাঠের মধ্যে জার্সি খুলে ফেলতে দেখা গিয়েছে এক বারই। ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে স্পেনের বিশ্ব জয়ের গোলটি করে। তা-ও নিজের গোল বা দলের বিশ্বকাপ জয়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে নয়। প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগেই আচমকা হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান প্রিয় বন্ধু। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশেই ভিতরে পরা গেঞ্জিতে লিখে রাখা বার্তাটি দেখাতে জার্সি খুলে ফেলেন।

প্রয়াত বন্ধুর স্ত্রী খেলা দেখছিলেন। ইনিয়েস্তার গোলটা হওয়ার কয়েক সেকেন্ড আগে থেকেই তাঁর মনে হতে থাকে, কিছু একটা ঘটবে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গোল! যেন ঐশ্বরিক প্রভাব! বন্ধুর স্ত্রী ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মনে মনেই জয়ধ্বনি দিয়ে চলেন, ‘সেন্ট আন্দ্রে, সেন্ট আন্দ্রে’।

রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকে মেসি বা রোনাল্ডোর বিদায় নিয়ে গোটা পৃথিবী ফেটে পড়ছে। সন্ত আন্দ্রে বরাবরের মতো নীরবে অপস্রিয়মাণ। কত বড় ফুটবলার তিনি? মেসি এক বার বলেছিলেন, ‘‘আন্দ্রে কী করে, অনেক সময় ধরা যায় না। কিন্তু আমরা জানি, ও কী করে। মাঠের মধ্যে আমি সব সময় চেয়েছি, আন্দ্রে আমার কাছাকাছি থাকুক। বিশেষ করে যখন পরিস্থিতি কঠিন হয়ে ওঠে, আমি ওকে বলি, কাছাকাছি থাকো।’’ ফুটবলে বাড়তে থাকা বডি বিল্ডিং প্রতিযোগিতার মধ্যে বেঁটেখাটো, পলকা চেহারার এক মিডফিল্ডার এক দশকের উপর শাসন করে গেলেন! এটাই তো চমকপ্রদ ঘটনা! বলকে তাঁর সামনে মনে হত সার্কাসের পোষ মানা বাঘ। আর তিনি মাস্টার!

স্পেনের তিকিতাকা অর্কেস্ট্রায় প্রধান দুই শিল্পী ছিলেন ইনিয়েস্তা এবং জাভি। সেই জাভি পর্যন্ত বলেছিলেন, ‘‘আমার বিকল্প হবে। দ্বিতীয় ইনিয়েস্তা কখনও পাওয়া যাবে না। কেউ বুঝতে পারে না, ও কত বড় ফুটবলার। এক দিন আন্দ্রে চলে যাবে। তখন সবাই বুঝবে, কী হারালাম!’’

সেই সময় উপস্থিত। বিশ্বকাপ বিপর্যয় কাটিয়ে ফের যখন বার্সেলোনার হয়ে মাঠে নামবেন মেসি বা স্পেনের হয়ে দিয়েগো কোস্তারা, অপেক্ষায় থাকবেন মাঝমাঠ থেকে লেসার রশ্মির মতো নিখুঁত পাসগুলোর। আর সেগুলো আসছে না দেখে হঠাৎ পিছন ঘুরে তাকিয়ে আবিষ্কার করবেন, শূন্য মাঝমাঠ! ইনিয়েস্তা চলে গিয়েছেন! নিঃশব্দে, তাঁর ফুটবলের মতোই!

এর পরেও ফুটবল থাকবে। বার্সেলোনা খেলবে, স্পেন খেলবে। হয়তো আবার জিতবেও তারা। কিন্তু ফুটবল মাঠে ফুটবে না আর পাসের রডোডেনড্রন!

Spain Andrés Iniesta Retirement Football FIFA World Cup 2018 বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy