রোববার সকাল দশটা।
সিডনি ক্রিকেট মাঠের বাইরেটা বন্ধের চেহারা নিয়েছে। ভেতরে কয়েকটা বাচ্চা টেনিস কোর্টে। আর কোনও জনপ্রাণী নেই। কিন্তু এক নম্বর গেটটা কী করে বন্ধ থাকতে পারে? গত ২৫ নভেম্বর থেকে গেটটাকে তো ২৪X৭ ডিউটিতে থাকতে হচ্ছে!
ক্রিকেট অদৃষ্টের অদ্ভুত পরিহাসে ভিক্টর ট্রাম্পারের এসসিজি। স্টিভ ওয়ের এসসিজি। আজ ঘাতক মাঠ হিসেবে পরিচিত হয়ে গিয়েছে। আর এক নম্বর গেটটাই সেই জায়গা যেখানে গোটা অস্ট্রেলিয়ার শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য শ্রাদ্ধবাসরে রেখে যাওয়া মালা আর রজনীগন্ধার ডাঁটির মতো শোভা পাচ্ছে।
ভেতরে ডাকাডাকি করতে ভেনু সার্ভিসেস গেট থেকে এ বার এক নিরাপত্তারক্ষী বেরিয়ে এল। “হ্যাঁ এক নম্বর গেট বন্ধ। আর ওগুলো কাল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।” ফিল হিউজের মৃত্যুর পটভূমি তৈরি হওয়া মাঠ তার মানে নতুন সপ্তাহ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছে! আর সে পেছনে তাকাতে চায় না!
দৃশ্য হিসেবে ভীষণ প্রতীকী। গতকালের অ্যাডিলেডের বিকেলের পর ক্রিকেট-জনতার মনন থেকে ফিল হিউজ সরে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে সেই সাত অক্ষরের শব্দটাই, যার জন্য তাঁকে লোকে চেনে। ক্রিকেট। আর মাইকেল ক্লার্ক যদি গোটা অস্ট্রেলিয়ার সামনে সেই শোকার্ত মুখের অভিজাত, মর্যাদাব্যঞ্জক ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর হয়ে থাকেন। সেই জোড়টা সম্পূর্ণ করলেন বিপক্ষ অধিনায়ক।
ক্রিকেট এসে যেন কোহলির মাধ্যমে অবশেষে দুঃখের হাত ধরল। বলল জীবন থেমে থাকে না। এ বার চলো সময় হয়েছে আমার মধ্যে তোমার মিলিয়ে যাওয়ার।
ডিসেম্বরের সেকেন্ড সানডেতে সিডনি নগরীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ঘুরে। ফোনে অস্ট্রেলিয়ার নানা শহরে কথা বলে। বোধগম্য হল— বিরাট কোহলি রাতারাতি এখন এ দেশের নিবিড় আশীর্বাদধন্য এক মহানায়ক রূপে উন্নীত। মাইকেল ক্লার্কের সাড়ে পাঁচ মিনিটের কান্নাভেজা বক্তৃতা যদি গোটা দেশের সামনে তাঁর অবিসংবাদী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে থাকে, কোহলির শনিবাসরীয় মনোভাব তা হলে এমন এক রোমান্টিক নির্যাস যা ব্যাট-বল-স্টাম্পের বাইরে তো বটেই। জেতা-হারারও ঊর্ধ্বে।
ক্রিকেট সার্কিটে দু’টেস্টের মাঝে এই ফাঁকফোকরওয়ালা দিনগুলো নতুন উইকেট, নতুন বিকল্প খেলোয়াড় এ সব আলোচনাতেই ব্যস্ত থাকে। আর আজ তো আলোচনা করার মতো সত্যি আছে। ক্লার্কের বদলি শন মার্শ কি না? পিটার সিডল বসিয়ে রিজার্ভ পেসার জশ হ্যাজলউড কি না? আর যেটা সম্ভবত নয়, বাস্তব, গাব্বায় পুরু ঘাস রেখে অজিরা সেই পিচেই খেলছে যেখানে গত বছর মিচেল জনসন ধ্বংস করেছিলেন ইংল্যান্ডকে। অ্যাসেজের লাকি কড়াইয়ে ভারতকে ফেলছে অস্ট্রেলিয়া, এর চেয়ে জুতসই আলোচনা আর কী হতে পারে ছুটির ক্রিকেট বাজারে?
আজ্ঞে না। এখনও অ্যাডিলেড হ্যাংওভার কাটাতে না পারা অস্ট্রেলিয়া কৃতজ্ঞ ভাবে শুধু বলে যাচ্ছে— কী ক্রিকেট রোমান্টিক এই ছেলেটা! পরিস্থিতি ওর যেমন সহায়ক ছিল, খুব সহজেই ড্র করে দিতে পারত। তা না করে কিনা জয়ের ঝুঁকি নিল, চিত্তাকর্ষক ক্রিকেট খেলার ঝুঁকি নিল। কী অসাধারণ!
অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট-অধিবাসীরা ইয়র্কশায়ারের লোকেদের মতো প্রশংসার ব্যাপারে এত কৃপণ নয়। আবার তারা মোটেও খরুচে নয়। খুব ভেবেচিন্তে তবেই বিপক্ষের প্রশংসা করে। সেই তারাই কিনা এ দিন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলছে, কোহলির মধ্যে স্যর ফ্র্যাঙ্ক ওরেলের ছায়া খুঁজে পাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় যখন টেস্ট ক্রিকেটের খুব মন্দা, তখন ষাটের দশকে টিম নিয়ে এসেছিলেন স্যর ফ্র্যাঙ্ক। তার পর টাই টেস্ট সহ কী হয়েছিল, ইতিহাস!
এ দিন ব্রিসবেন থেকে ম্যাথু হেডেন আত্মজীবনীর লেখক এবং বিশিষ্ট ক্রিকেটলিখিয়ে রবার্ট ক্র্যাডক ফোনে বললেন, “আমাদের অস্ট্রেলীয় সাংবাদিকদের পক্ষে একটা বার্তা প্লিজ কোহলিকে পৌঁছে দেবেন। বলবেন ওর মনোভাবে অস্ট্রেলিয়া শুধু মুগ্ধ নয়। আলোড়িত। কয়েক জন প্রাক্তন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারের সঙ্গে কথা বললাম, ওরা অবধি ঘোর কাটাতে পারছে না।”
সিডনি শহরে বসে এ সব শুনতে শুনতে যেন আরও বিস্ময়কর লাগছিল। গাড়িতে বাঁ পাশে দেখছি সিডনি হিল্টন। একটা সময় ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে তাত্পর্যপূর্ণ হোটেল। এখানে বসেই তো প্যাকার ক্রিকেটের বেশির ভাগ বৈঠক প্লেয়ারদের সঙ্গে করতেন কেরি প্যাকার। গোটা অস্ট্রেলিয়ার মনোভাব ধরা পড়ত তাঁর সেই সময় উত্তেজিত হয়ে বলা কিছু মন্তব্যে।
বিশ্ব একাদশ যখন বারবার প্রচণ্ড লড়ে হেরে যাচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে, তখন প্যাকার রাগত ভাবে তাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, দারুণ লড়ে হারা আর হারায় কোনও তফাত নেই। মনে রাখো, গ্যালান্ট লুজার হল তারা যারা নিয়মিত হারে। এর পর বিশ্ব একাদশ জিততে শুরু করল কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারছে।
প্যাকার এ বার ডেকে পাঠালেন ক্লাইভ লয়েডকে। কী বলেছিলেন, লয়েড আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন। “শোনো, কোয়ান্টাসের একটা ফ্লাইট রোজ সিডনি থেকে লন্ডন হয়ে বার্বেডোজ যায়। এ রকম দেখলে সোজা তুলে দেব।” প্যাকার মারা গিয়েছেন ন’বছর হতে চলল। চ্যানেল নাইন বিক্রি হয়ে গিয়েছে একদল ব্যাঙ্কার গোষ্ঠীর কাছে। কিন্তু তাঁর দর্শন লোকগাথার মতো থেকে গিয়েছে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটমহলে। জেতা ছাড়া সবই তুচ্ছ। তিনি মারা যাওয়ার পরেও জন বুকানন ব্যাগি গ্রিন টুপির ওপর ড্রেসিংরুমে পোস্টার লাগিয়েছেন নিয়মিত ভাবে— রুপো তোমরা জিততেই পারো না। স্রেফ সোনা হারাতে পারো।
নিষ্ঠুর জয়ীর মন্ত্রে দীক্ষিত সেই মহাদেশের কী হল? বিল লরির মতো তথাকথিত কাঠখোট্টা লোক মেলবোর্ন থেকে ফোনে জানালেন, হ্যাঁ, বহু দিন পরে তিনি এমসিজি টেস্টে কমেন্ট্রি করবেন ঠিক করেছেন। “কিছুক্ষণ খেলা দেখেছি কালকে। হ্যাঁ এটাই ক্রিকেট,” লরি ফোন রেখে দিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও ব্র্যাডম্যান নির্দেশিত নিষ্ঠুরতার যিনি ক্রিকেটমাঠে শরিক, সেই নিল হার্ভিও তো বলেছেন, “হারা-জেতা বড় কথা নয়। টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্কটকালে এই ছেলেটা টেস্ট ক্রিকেটকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছে। ওর পাশে সবার থাকা উচিত।” রিকি পন্টিং? তিনিও তো কোহলির প্রেমে বিভোর। অস্ট্রেলিয়ান কাগজে বলেছেন, “এই ছেলেটার খাঁচাটা প্রতি বার চাপে বাড়ে। অনবদ্য।”
আপাতত একটা কমন আশঙ্কা অস্ট্রেলীয়দের মুখে ফিরছে, ওই ধোনি এসে আবার খেলার স্টাইলটা বদলে দেবেন না তো?
সব দেখে আর শুনে তাজ্জব লাগছে বললে কম বলা হয়! বিরাট-সভ্যতা কোথায় মোচড় মারল অস্ট্রেলীয়দের হৃদয়তন্ত্রীতে যে, এমন প্রতিক্রিয়া! না কি পাওয়ার হিটিং, ঢাউস ঢাউস স্কোর আর নৈমিত্তিক একঘেয়েমি দেখে মানুষ রোমান্স হারিয়ে ফেলছিল? কোহলির মধ্যে কোথাও সেই রোমান্স সরবরাহের দলগত আশ্বাস খুঁজে পেয়েছে!