Advertisement
E-Paper

এম স্কোয়ারকে স্তব্ধ করে করল, লড়ল, জিতল রে

আইপিএল পৃথিবী যে কতটা অবাক করে দিতে পারে, তার তুলনা সম্ভবত আইপিএল নিজেই। বনবন করে ঘোরা, ছন্দে ছন্দে রং পাল্টানো এই দুনিয়ায় কে যে কখন বাদশা থেকে ফকির, বা ঠিক তার উল্টোটা হয়ে যাবে, কেউ জানে না। এই দুনিয়ায় এক মুহূর্তে মহানায়কের ঠিকানা হয়ে যায় ‘কেয়ার অব ফুটপাথ’। আবার নেহাতই অজ্ঞাতকুলশীল কেউ রাতারাতি চলে আসে ঝাড়বাতির রোশনাইয়ে। সুভাষচন্দ্র বসুর ধাত্রীভূমিতে নাইটদের কিংস-নিধন যজ্ঞ চিরন্তন সেই আইপিএল-পাঠটাই যেন নতুন করে মনে পড়িয়ে দিয়ে গেল!

প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৪ ০৩:১২
কটকে নাইট-শাসন। ছবি: পিটিআই।

কটকে নাইট-শাসন। ছবি: পিটিআই।

আইপিএল পৃথিবী যে কতটা অবাক করে দিতে পারে, তার তুলনা সম্ভবত আইপিএল নিজেই। বনবন করে ঘোরা, ছন্দে ছন্দে রং পাল্টানো এই দুনিয়ায় কে যে কখন বাদশা থেকে ফকির, বা ঠিক তার উল্টোটা হয়ে যাবে, কেউ জানে না। এই দুনিয়ায় এক মুহূর্তে মহানায়কের ঠিকানা হয়ে যায় ‘কেয়ার অব ফুটপাথ’। আবার নেহাতই অজ্ঞাতকুলশীল কেউ রাতারাতি চলে আসে ঝাড়বাতির রোশনাইয়ে। সুভাষচন্দ্র বসুর ধাত্রীভূমিতে নাইটদের কিংস-নিধন যজ্ঞ চিরন্তন সেই আইপিএল-পাঠটাই যেন নতুন করে মনে পড়িয়ে দিয়ে গেল!

কে কত বড় টিম, কে নিলামে ম্যাড ম্যাক্স আর কিলার মিলার তুলে বসে আছে, বা কে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিদের খড়কুটোর মতো উড়িয়ে লিগ টেবিলে স্থায়ী প্রভুত্ব করছে, সেটা বড় নয়। বড় হল, আজ সাড়ে তিন ঘণ্টায় দু’শো চল্লিশ বলের মেয়াদে তুমি কী করলে। অবস্থা বা পরিস্থিতি না বুঝে আইপিএলের দুনিয়ায় ‘দাদাগিরি’ চালাতে গেলে তার পরিণতি কতটা মর্মান্তিক হতে পারে, রবিবাসরীয় কটকে খুব ভাল করে টের পেয়ে গেলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল-সহ পঞ্জাবের রাজপুত্ররা।

আইপিএলের এক বনাম পাঁচের যুদ্ধ হচ্ছে একপেশে, টস থেকে শেষ বল পর্যন্ত ফার্স্ট বয়কে শাসন করছে ফিফথ বয়, ভাবা যায়! ম্যাচ শুরুর আগে অতি বড় নাইট-সমর্থক কেন, স্বয়ং গৌতম গম্ভীরও কি ভেবেছিলেন মহাযুদ্ধটা এমন একমাত্রিক হবে? যার শেষে লেখা থাকবে ন’উইকেটে নাইট-জয়? ভাবতে পেরেছিলেন, যে নাইটদের নিয়তি আইপিএল সেভেনে আবার ‘কেকেহার’-এর দিকে যাচ্ছিল, তাদের জন্য হঠাৎ সব কিছু ঠিকঠাক চলতে শুরু করবে?

উদাহরণ এক— সাকিব আল হাসানকে বসিয়ে পীযুষ চাওলার টিমে অন্তর্ভুক্তি। ব্যাট হাতে নাইটদের মধ্যে সেরা স্ট্রাইক রেট, দ্বিতীয় সেরা ব্যাটিং গড় সাকিবের। বোলিংয়ে সেরা ইকনমি রেট। এমন অলরাউন্ডারকে বসানো নিয়ে নাইট-সমর্থকদের ভুরু কোঁচকানোর যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু ম্যাচের প্রেক্ষিত বুঝিয়ে দিল, চাওলার উপস্থিতিটা এ দিন নাইট অধিনায়কের অন্যতম মাস্টারস্ট্রোক। ম্যাচ শেষে যে স্ট্র্যাটেজির উপর আলোকপাত করতে গিয়ে রবিন উথাপ্পা মনে করিয়ে দিলেন, কিংস সংসারে বহু দিন কাটিয়ে এসেছেন পীযূষ। পঞ্জাব টিমের নাড়িনক্ষত্র তাঁর চেয়ে ভাল কে জানবে? আমিরশাহিতে পঞ্জাব ম্যাচে অন্যতম পারফর্মার পীযূষ এ দিন শেষ করলেন ৩-১৯ দিয়ে।

উদাহরণ দুই— গ্লেন ম্যাক্সওয়েল আটকে গেলেন নাইটদের সেশন স্ট্র্যাটেজির মারণ-ফাঁদে। বল দেখে খেলাটা ম্যাড ম্যাক্সের স্বভাববিরুদ্ধ। তাঁর ছকটা খুব সোজা— নেমেই প্রথম থেকে বোলারকে থেঁতলানি দিয়ে তার মনোবল চূর্ণ করে দাও। আজ তাঁর ভাগ্য খারাপ, নেমেই মর্নি মর্কেলের সামনে পড়তে হল। প্রবল ঝুঁকি নিয়ে, ডেথের জন্য তাঁকে না রেখে এ দিন শুরুতেই মর্কেলকে নিয়ে এসেছিলেন গম্ভীর। উল্টো দিক থেকে সুনীল নারিনকে দিয়ে করিয়ে দেওয়া হল দু’টো ওভার। মর্কেলের এক্সপ্রেস গতি বা নারিনের স্পিন-সম্মোহন দু’টোর একটাও সামলানো সহজ বস্তু নয়। ১৪ রান করতে ১৪ বল লেগে গেল ম্যাক্সওয়েলের। নাইটদের বিরুদ্ধে লাল জার্সিতে তাঁর সর্বোচ্চ স্কোর সেই ১৫-ই থেকে গেল। অর্থাৎ, দু’টো ওভারের সেশনেই তিনি বন্দি। শুরুতে অন-সাইডে যে স্কোরিং শটগুলো খেলে থাকেন অস্ট্রেলীয় মহাতারকা, এ দিন সেগুলোর একটাও খেলতে পারলেন না। ছন্দে ফিরতে চাওলাকে তাঁকে মারতেই হত। আর সেখানেই তাঁর জন্য মৃত্যু-ফাঁদের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন গম্ভীর। নাইটদের ম্যাক্সওয়েল স্পেশ্যালিস্ট মর্কেল অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানের উইকেট নিতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু চাওলার বলে ডিপ স্কোয়্যার লেগে তাঁর ক্যাচটা নিতে ভুল করলেন না।

উদাহরণ তিন— যে বৃষ্টিকে নাইট সংসারে খলনায়ক হিসেবে দেখা হচ্ছিল, সেই বৃষ্টিই পরোক্ষ ভাবে সাহায্য করে দিল নাইদের। ম্যাচ শেষে উথাপ্পা যেমন বললেন, পরপর দু’দিন বৃষ্টির জন্যই উইকেটটা এ রকম হয়ে গিয়েছিল। দিন কয়েক আগেকার চেন্নাই ম্যাচের ব্যাটিং-স্বর্গ পিচের জায়গায় উইকেট হয়ে গিয়েছিল ডাবল পেস্ড। যে আঠালো পিচে আটকে গেল পঞ্জাব ব্যাটিং। বীরেন্দ্র সহবাগ একা ৫০ বলে ৭২, বাকিরা ৭০ বলে ৭৭! জয়ের চিত্রনাট্য লেখার বেশির ভাগ কাজটা ওখানেই সেরে ফেলেছিলেন নাইটরা। কেকের উপর আইসিং দিয়ে গেলেন দুই ওপেনার গম্ভীর-উথাপ্পা।

আর উদাহরণ চার— নাইট অধিনায়ক স্বয়ং। রবিবার যে ভাবে ব্যাট করছিলেন, তাতে আইপিএল সেভেনে তাঁর তিন নম্বর হাফসেঞ্চুরিটা ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। দেখে কে বলবে, মরুশহরে গম্ভীরের আইপিএল যাত্রার শুরুটা হোঁচটে ভর্তি ছিল! তাঁর ঘনিষ্ঠমহলের কাছে অবশ্য গম্ভীরের প্রত্যাবর্তন আশ্চর্যের কিছু নয়। তাঁদের বক্তব্য, গম্ভীর কেমন ফর্মে আছেন সেটা বোঝানোর জন্য ক্রিজে যথেষ্ট সময়ই এত দিন পাননি নাইট অধিনায়ক। এত দিন নাকি স্বচ্ছন্দে খেলতেও পারছিলেন না গম্ভীর। কারণ উল্টো দিকে পরপর উইকেট চলে যাচ্ছিল। রবিন উথাপ্পা ওপেনিংয়ে উঠে আসায় তাঁর চাপ এখন শূন্যে গিয়ে ঠেকেছে। গম্ভীরের ঘনিষ্ঠমহলের বক্তব্য, আমিরশাহিতে যখন তিনি নেটে ঢুকতেন, তখন তাঁকে ঠিক এ রকম চাপমুক্ত ভাবেই শট নিতে দেখা যেত যা এখন দেখা যাচ্ছে। ফারাক একটাই। নেট সেশনের চাপমুক্ত ব্যাপরটা এখন ম্যাচেও তিনি পাচ্ছেন।

রবিবার তাঁর ৪৫ বলে অপরাজিত ৬৩-র পর গম্ভীরের বন্ধুবান্ধবরা এ-ও বলছেন, তাঁর মতো ব্যাটসম্যানের ফর্ম নিয়ে কথা বলাটাই অন্যায়। উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে, গ্যারি কার্স্টেনের আমলে এক বার ভারত সফরে এসেছিল নিউজিল্যান্ড। গম্ভীরের ফর্ম তখন খুব খারাপ। হায়দরাবাদ ম্যাচের আগে গম্ভীর নাকি গ্যারিকে বলেও ছিলেন, স্যর আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিন। ফর্ম নেই। গিয়ে রঞ্জি খেলি। গ্যারি তাঁকে বুঝিয়েসুঝিয়ে ম্যাচে নামান। এবং নিউজিল্যান্ডের এক পেসারকে কভার আর এক্সট্রা কভারের মধ্যে দিয়ে একটা বাউন্ডারি মেরে নিজের চেনা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিলেন গম্ভীর। এ ক্ষেত্রেও বলা হচ্ছে, তাঁর এই ‘কনফিডেন্স মোমেন্ট’ সম্ভবত এসেছিল আমিরশাহিতে, রাজস্থান ম্যাচে। যেখানে টিম হারলেও গম্ভীর ৪১ করে যান। এঁদের বক্তব্য, একটা শট বা একটা ম্যাচ গম্ভীরের মতো ব্যাটসম্যানকে ফর্মে ফিরিয়ে দেয়। এবং সেটাই দেখছে আইপিএল।

অধিনায়ক গম্ভীরও এ দিন সমান উজ্জ্বল। মর্কেল আর পীযূষকে খেলানো দু’টো নিখুঁত স্ট্র্যাটেজিক মুভ। কেকেআর সমর্থকদের পক্ষে আশার আরও খবর, চাপে পড়লেও গম্ভীরের মস্তিষ্ক এখন গরম নয়, বরফশীতল দেখাচ্ছে। এ দিন পঞ্জাব দশ ওভারে যখন ৮৫-২, ক্রিজে যখন সহবাগ-ম্যাক্সওয়েল, যে কোনও অধিনায়কের হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে যাওয়ার কথা। গম্ভীর সেখানে বোলার পরিবর্তনেই ম্যাচটা শেষ করে দিলেন। যার সম্মিলিত ফল— ৯ ম্যাচে ৫ জয়। যার পরিণতি— প্লে অফের প্রথম চার টিমের মধ্যে ঠিক যতটা এখন থাকতে পারে সানরাইজার্স, ঠিক ততটাই পারে কেকেআর।

রবিবাসরীয় কটকে গম্ভীররা তাই শুধু পুর্নজন্মই ঘটালেন না। প্লে অফের যুদ্ধকে জীবন্ত করে আইপিএলের শেষ সপ্তাহে শিরশিরে উত্তেজনার উপাদানও সংযোজন করে গেলেন!

সংক্ষিপ্ত স্কোর

কিংস ইলেভেন পঞ্জাব ১৪৯-৮ (সহবাগ ৭২, পীযূষ ৩-১৯)

কলকাতা নাইট রাইডার্স ১৮ ওভারে ১৫০-১ (গম্ভীর ন.আ ৬৩, উথাপ্পা ৪৬)।

ipltag priyadarshini rakshit cuttack
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy