Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কাসিয়াসের এ বার খেলা ছাড়া উচিত

পাঁচ গোল খেয়ে ফেরার সময় কাসিয়াসের মুখটা যখন ক্যামেরা ধরল, তখন কেন জানি না আমার বুকে একটা ব্যথা চিনচিন করে উঠল। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কিপারকে দেখে মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ওর মতো অসহায় আর কেউ নেই। ঊনচল্লিশ বছর আগে কি এ রকম মুখ নিয়েই মোহনবাগান মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম? হবে হয়তো। পঁচাত্তরের হাই ভোল্টেজ ডার্বির সেই যন্ত্রণা প্রাক্তন হয়ে যাওয়ার পরও আমাকে দুঃখ দেয়। আমি তখন ছিলাম বছর আঠারোর এক তরুণ।


পঞ্চ-গোলে বিধ্বস্ত অধিনায়ক। নেদারল্যান্ডসের কাছে হারের পর কাসিয়াস। ছবি: এএফপি

পঞ্চ-গোলে বিধ্বস্ত অধিনায়ক। নেদারল্যান্ডসের কাছে হারের পর কাসিয়াস। ছবি: এএফপি

ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৪ ০৩:৪৪
Share: Save:

পাঁচ গোল খেয়ে ফেরার সময় কাসিয়াসের মুখটা যখন ক্যামেরা ধরল, তখন কেন জানি না আমার বুকে একটা ব্যথা চিনচিন করে উঠল। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কিপারকে দেখে মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ওর মতো অসহায় আর কেউ নেই।

ঊনচল্লিশ বছর আগে কি এ রকম মুখ নিয়েই মোহনবাগান মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম? হবে হয়তো। পঁচাত্তরের হাই ভোল্টেজ ডার্বির সেই যন্ত্রণা প্রাক্তন হয়ে যাওয়ার পরও আমাকে দুঃখ দেয়। আমি তখন ছিলাম বছর আঠারোর এক তরুণ। ফলে যে যেখানে দেখত সান্ত্বনা দিত। বলত, ‘এটা একটা দুর্ঘটনা। তুই ঘুরে দাঁড়াবি-ই’। আর সবাই যখন এটা বলত, তখন আরও বেশি বেশি করে মনে হতো, বিশ্বে আমার চেয়ে অভাগা কেউ নেই।

কাসিয়াসের যন্ত্রণাটা কী রকম হতে পারে? আমার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশিই হবে হয়তো। কারণ, এক) বিশ্বচ্যাম্পিয়ন টিমের কিপার হিসাবে খেলতে এসে পাঁচ গোল খাওয়া। দুই) স্পেনের বিশ্বকাপ ইতিহাসে খারাপতম ম্যাচে অধিনায়ক ছিল কাসিয়াস নিজেই।

কিন্তু প্রশ্ন হল, আমি পরে ফিরে এসেছিলাম। ক্লাব এবং জাতীয় দলে সাফল্যের সঙ্গে খেলেছি। কারণ আমার বয়স কম ছিল বলে একটা স্বপ্ন ছিল। দেখিয়ে দেওয়ার জেদ ছিল। কাসিয়াস কি পারবে? সোজাসুজিই বলছি, কঠিন। কেন এমন রুক্ষ একটা সিদ্ধান্ত সরাসরিই লিখলাম? কারণ তেত্রিশের কিপারের সামনে আর কোনও স্বপ্ন নেই। দু’টো ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা হয়ে গিয়েছে, একটা বিশ্বকাপও। ক্লাব পর্যায়েও সাফল্য পেয়েছে। আর কি নিয়ে ও স্বপ্ন দেখবে? দু’বার বিশ্বকাপ জয়? নেদারল্যান্ডস ম্যাচে স্পেনের পারফরম্যান্সের পর সেটা না দেখাই ভাল। আর কে না জানে স্বপ্ন না দেখলে যে কোনও কাজেই ফিরে আসা কঠিন। তা সে ফুটবল হোক বা সিনেমা। পারফর্মারদের প্রতিদিন স্বপ্ন দেখতে হয়। পারফর্ম করতে হয়।

রিয়াল মাদ্রিদেও এ বার কাসিয়াস অফ ফর্মে ছিল। খেলতে পারছিল না একেবারেই। নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কিপারকে দেখে মনে হচ্ছিল, গত বিশ্বকাপের ছায়া। গত বারের কাসিয়াস হলে ফান পার্সির দুর্দান্ত হেডের গোলটা উড়ে গিয়ে হয়তো বাঁচাত। কিন্তু কোথায় গেল সেই রিফ্লেক্স? গতি? গ্রিপিং? অ্যান্টিশিপেশান? গোল ছেড়ে বেরিয়ে এসে বিপক্ষের পা থেকে বাজপাখির মতো বল ছিনিয়ে নেওয়ার দক্ষতা! বিশ্বকাপে হাতে গোনা কয়েকবার হলেও, ক্লাব ফুটবলে এখন আকছার চার-পাঁচ গোল হচ্ছে। কোনও কিপার একটা ম্যাচে পাঁচ গোল খেলেই যে খারাপ, তাও বলা উচিত নয়। ‘দুর্ঘটনা’ হতেই পারে। অফ ফর্মে থাকতেই পারে কেউ। কিন্তু শেষ রক্ষণে সাফল্যের মূল রসদ আত্মবিশ্বাসই তো কাসিয়াস হারিয়ে ফেলেছে।

অবিশ্বাস্য ফলের ম্যাচটায় দেখলাম তিন নম্বর গোলের বলটা যখন স্পেন বক্সে উড়ে এল তখন তো গ্রিপ-ই করতে পারল না কাসিয়াস! অত দূর থেকে আসা ফ্রিকিক ওর মতো কিপার লাফিয়ে উঠে গ্রিপ করবে না? ভাবতেই পারছিলাম না। বোঝাই যাচ্ছিল শারীরিক ভাবে ও ফিট নয়। নেদারল্যান্ডস যে চার নম্বর গোলটা করে গেল তার জন্য কাসিয়াস পুরোপুরি দায়ী। আসলে তত ক্ষণে হতাশা গ্রাস করে ফেলেছিল পুরো টিমের সঙ্গে স্পেন কিপারকেও। সে জন্যই বলটা ওর পা থেকে বেরিয়ে ফান পার্সির পায়ে চলে গিয়েছিল। ফান পার্সির একটা শট তো হাত দিয়ে না ধরে, ডান পা বাড়িয়ে রুখল।

কিপাররা চাপে পড়ে গেলে এ রকমই একের পর এক ভুল করে। সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা। তবে ওর কাছে এটা অপ্রত্যাশিত। ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল এই লোকটাই ব্রাজিলে আসার আগে গত তিনটি টুর্নামেন্টে মাত্র পাঁচ গোল খেয়েছে। তবুও কাসিয়াস বলেই, পরে রবেন আর জিয়ারজিনিওর দু’টো নিশ্চিত গোল বাঁচিয়েছে। না হলে তো আরও লজ্জায় পড়ত স্পেন।

এত কিছুর পরও বলছি, চিলির বিরুদ্ধে পরের ম্যাচে স্পেনের গোলে কিন্তু কাসিয়াসকেই খেলানো উচিত দেল বস্কির। ওর অভিজ্ঞতা এবং টিমের মনোবল বাঁচিয়ে রাখার জন্য। ইস্টবেঙ্গলের কাছে পাঁচ গোল খাওয়ার পর (আমি চার গোল খেয়েছিলাম) বাগান গোলে আমাকে রাখা হয়নি। আস্থা রাখতে পারেনি মোহনবাগানের টিম ম্যানেজমেন্ট। অনেক দিন ম্যাচের বাইরে ছিলাম। এক-এক সময়ে মনে হত, আর হয়তো পারব না। কাসিয়াসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিন্তু উল্টো। গত বিশ্বকাপের পর চার বছর কেটে গিয়েছে। বয়স বেড়েছে ওর। আর সামনে কিছু নেই প্রমাণ করার। এখানেই ওকে এত দিনের অসাধারণ পারফরম্যান্সের জন্য সম্মানটা জানানো হোক। জানি না, স্পেন শেষ পর্যন্ত কত দূর যাবে। কিন্তু পাঁচ গোলের কলঙ্ক মুছতে ওকে বাকি ম্যাচগুলোয় সুযোগ দেওয়া হোক।

কাসিয়াসের মতো কিপাররা কিন্তু প্রতিদিন বিশ্রী গোল খাওয়ার জন্য জন্মান না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE