Advertisement
E-Paper

তাতালেন নেইমার, ব্রাজিলকে বাঁচাল সিজারের দস্তানা

খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে মিনিটপাঁচেক। সেন্টার সার্কলের ওপর উপুড় হয়ে ওঁরা শোয়া। প্রথমে মনে হবে হামাগুড়ি দেওয়ার মতো। ভাল করে দেখলে বোঝা যাচ্ছে প্রার্থনার ভঙ্গি। কোচ গেলেন ডাকতে। বলতে যে, অনুশোচনার কিছু নেই। ওঠো। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ালেনও। তবু এরা উঠছে না দেখে কোচই এ বার সরে গেলেন। নিশ্চয়ই দেখে এলেন, মুখ গুঁজে তাঁর প্লেয়াররা কাঁদছিলেন। টাইব্রেকারের শেষ মুহূর্তের দুর্ভাগ্য হারালে তো লোকে মুখ গুঁজে কাঁদবেই। গঞ্জালো জারার শেষ পেনাল্টিটা সাইড পোস্টে না লাগলে তো চিলি হেরে দেশে ফেরে না! তারও আগে অতিরিক্ত সময়ের শেষ দিকে একটা কুড়ি গজি শট ব্রাজিলের ক্রসপিসে লেগে ফিরেছে।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৪ ০৪:০১
ব্রাজিলকে বাঁচাল সিজারের হাত। শনিবার বেলো হরাইজন্তেতে তোলা উৎপল সরকারের ছবি।

ব্রাজিলকে বাঁচাল সিজারের হাত। শনিবার বেলো হরাইজন্তেতে তোলা উৎপল সরকারের ছবি।

খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে মিনিটপাঁচেক। সেন্টার সার্কলের ওপর উপুড় হয়ে ওঁরা শোয়া। প্রথমে মনে হবে হামাগুড়ি দেওয়ার মতো। ভাল করে দেখলে বোঝা যাচ্ছে প্রার্থনার ভঙ্গি।

কোচ গেলেন ডাকতে। বলতে যে, অনুশোচনার কিছু নেই। ওঠো। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ালেনও। তবু এরা উঠছে না দেখে কোচই এ বার সরে গেলেন। নিশ্চয়ই দেখে এলেন, মুখ গুঁজে তাঁর প্লেয়াররা কাঁদছিলেন।

টাইব্রেকারের শেষ মুহূর্তের দুর্ভাগ্য হারালে তো লোকে মুখ গুঁজে কাঁদবেই। গঞ্জালো জারার শেষ পেনাল্টিটা সাইড পোস্টে না লাগলে তো চিলি হেরে দেশে ফেরে না! তারও আগে অতিরিক্ত সময়ের শেষ দিকে একটা কুড়ি গজি শট ব্রাজিলের ক্রসপিসে লেগে ফিরেছে। খাতা খুলে দেখছি শটটা ছিল ৮৮ মিনিটে, মানে দু’মিনিট বাকি থাকতে। হাল্ক যদি দাবি করে যান যে, ইংরেজ রেফারি হ্যান্ড বলের জন্য তাঁর যে গোলটা নাকচ করেছেন সেটা বগলের তলায় লেগেছিল, তা হলেও তো তাঁর একটা দুর্ভাগ্য বনাম চিলির দুটো দুর্ভাগ্য— কাটাকুটি হয়ে গেল। স্কোলারি কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলনে অষ্টাশি মিনিটের অসীম সৌভাগ্যের কথাই বলে গেলেন।

আজ সত্যিই চিলির ম্যাচ শেষেও মাঠে শুয়ে থাকার দিন। প্রায় একটা গোটা স্টেডিয়াম আর বিশ্ব ফুটবলের এত বড় সুপার-পাওয়ারকে তার দেশে নাস্তানাবুদ করেও কিনা হেরে ফিরছে।

এ বার বলি, শুয়ে যাঁরা কাঁদছিলেন দু’জনের কেউ চিলির নন। একজন পেনাল্টি বাইরে মারা উইলিয়ান। অন্য জন দানি আলভেজ। ওঁদের ডাকতে যিনি গিয়েছিলেন তাঁর নামও লুই ফিলিপ স্কোলারি। কলকাতায় টিভি দেখিয়েছে কি না জানি না, কিন্তু ব্রাজিলের দ্বিতীয় পেনাল্টি মিস হওয়ার পর এখানকার ফিলিপাও রিজার্ভ বেঞ্চের দিকে যে ইঙ্গিত করেছিলেন তার অনুবাদ— সব শেষ।

তখনও কেউ জানে না বেলো হরাইজন্তের এই মাঠে ব্রাজিল ইতিহাসের এমন একটা দিন আসবে যা আদৌ কোনও দিন ঘটেছে কি না কেউ মনে করতে পারল না। ব্রাজিল গোলকিপার হয়ে যাবেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। এই জুলিও সিজারের দলে নির্বাচন নিয়েই দাবানলের মতো সমালোচনা হয়েছিল ব্রাজিলে। দু’টো পেনাল্টি আটকে খেলার পর তিনি বলে গেলেন, ওহে সমালোচকেরা, তা হলে ট্রেনিংটা করেছিলাম!

কিন্তু জুলিও সিজারেও শেষরক্ষা হচ্ছিল না। তিনি দু’টো শট বাঁচিয়ে দেওয়ার পরেও আতঙ্কের স্তর আরও বেড়ে গিয়েছিল শেষ দিকে। বিশেষ করে ব্রাজিল যখন শেষ কিকটা নিচ্ছে। সাধারণত কোচেরা প্রথম বা শেষ পেনাল্টিতে তাঁদের সবচেয়ে দক্ষ পেনাল্টি-মারিয়েদের রাখেন। ব্রাজিল রেখেছিল নেইমার দ্য সিলভাকে। যে বাজারে সাঞ্চেজের মতো ভাল পেনাল্টি-মারিয়ের শট বাঁচিয়ে দিয়েছেন জুলিও সিজার, সেখানে শেষ কিকের চাপ নিতে পারবেন তিনি?

যখন নিজেদের শেষ শট নিতে যাচ্ছেন, গ্যালারি আর নেইমার-নেইমার ডাক তোলার অবস্থায় নেই। আমার সামনের মহিলা কাঁদছেন। তাঁর টিনএজার কন্যা দু’হাত মুখে চাপা দিয়ে বসে আছে। আগের শটটা হাল্ক মিস করায় যেন ধরেই নেওয়া হয়েছে হাহাকারের লগ্ন আগত। পঞ্চাশের সেই অভিশপ্ত মারাকানা ফিরল বলে। সে বার তা-ও ফাইনালে হেরেছিল, এ বার দ্বিতীয় রাউন্ডেই বেরিয়ে যাবে।

নেইমার গোটা ম্যাচে থাকা মানে অবিরত ভাল খেলা এবং অবিরত মার খাওয়া। ফিফা তাঁর মতো বল প্লেয়ারদের জন্য কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখেনি, এটা চরম আশ্চর্য। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে তিনি তো আরও অনিরাপদ। একে তো মার খেয়ে থাই পুরো ফুলে রয়েছে। প্লেসিংই করতে পারবেন কি না, কেউ জানে না। তার ওপর গোলপোস্টের পেছনে চিলি গ্যালারি। চিলি গোলকিপারকে অবিরাম তাদের সমর্থকেরা টগবগে আওয়াজে চার্জ করছে। সবে আগের শটটা তিনি বাঁচিয়েছেন। এই বার নেইমার সেই পেনাল্টিটা মারলেন যেটা ইউ-টিউবে গেলে তাঁর পুরনো পেনাল্টি হিসেবে দেখা যাবে। একটা ফল্স দেন। দৌড়ের সঙ্গে ওই ফল্সে গোলকিপার বিভ্রান্ত হয়ে যায়। শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায় পেনাল্টি বাঁচানোর স্পেশ্যালিস্ট হিসেবে ভারতে গণ্য হন। তিনি এক বার বলেছিলেন, পেনাল্টি ভাল মারলে তো কিছু করার নেই। তবে একটা টোটকা হল কিকার বল বসানোর সময় কোন দিকে তাকাল সেটা দেখে নেওয়া। শিবাজির সময়ে একমাত্র অমলরাজ ছাড়া সবাই নাকি হাল্কা যে দিকে তাকাতেন সে দিকে অবধারিত মারতেন।

শিবাজিদের ফুটবল আর এটা পুরোপুরি অন্য গ্রহ। কিন্তু পেনাল্টির ক্ষেত্রে এখনও অনেক মিল। ভাল কিকাররাও যে দিকে মারবেন, বল বসানোর সময় অন্তত এক বার দেখে নেন। নেইমার ব্যতিক্রম। তাঁর পা থেকে বডি মুভমেন্ট পুরোটাই হিলতে থাকে। পেনাল্টিটাও মারলেন ড্রিবল করার মতো। ওই ৩-২ হয়ে যাওয়ার পর শেষ শটটা পোস্টে লাগা আংশিক চিলির মন্দ ভাগ্য। আর বেশির ভাগটাই নেইমারের কেরামতি।

ব্রাজিলের কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে গেল। সাংবাদিকরা পর্যন্ত স্তব্ধবাক। বেলো মাঠের স্বেচ্ছাসেবকেরাও চুপচাপ। মাঠে যে উৎসবের ঢেউ দেখার কথা ছিল, তা প্রায় কিছুই হল না। মিডিয়া সেন্টারে বরং আলোচনা চলছে, টোস্টাও যেটা বলেছেন সেটাই তা হলে ঠিক। ব্রাজিলের দুটোই স্ট্র্যাটেজি। প্রথম, বল পেলে নেইমারকে দাও। দ্বিতীয়, বল পেলে নেইমারকে দাও। যে দিন নেইমার-স্ট্র্যাটেজি খাটবে না, সে দিন এ রকমই অবস্থা হবে।

প্রেস কনফারেন্সে এসে সাম্পাওলি বলে গেলেন, ক্রসবারই আমাদের ইতিহাস থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে আটকে দিল।

সক্রেটিস হয়তো কবরে শুয়ে কলামই লিখছেন, হে স্কোলারি, সেকেন্ড রাউন্ডেই টাইব্রেকার আর তোমার গোলকিপার কিনা ম্যান অব দ্য ম্যাচ!

ম্যাচের সেরা জুলিও সিজার

ব্রাজিলের জয়ে মূল কারিগর। পুরো ম্যাচ চিলির অসংখ্য শট বাঁচিয়ে স্কোর ১-১ রাখলেন সিজার। টাইব্রেকারে চিলির পিনিয়া ও সাঞ্চেজের শটও বাঁচালেন। যার সৌজন্যে ব্রাজিল ৩-২ জিতল। ফ্ল্যামেঙ্গোতে কেরিয়ার শুরু সিজারের। ২০০৫ থেকে ২০১২ অবধি ইতালীয় ক্লাব ইন্টার মিলানের হয়ে অনেক ট্রফি জেতেন।

belo horizonte neymar gautam bhattacharya fifaworldcup
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy