Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পটৌডিকে সর্বকালের সেরা ভারত অধিনায়কের মুকুট পরিয়ে দিলেন সৌরভ

ক্রিকেট বিশ্ব এত দিন জানত, ‘অফসাইডের ঈশ্বর’ তাঁকে কেন বলে। ক্রিকেটবিশ্ব আজ জানল, অবসরের ছ’বছর পরেও অফে তাঁর মোহিনী শটগুলো অক্ষত আছে! শুধু আজ হাতে ব্যাট ছিল না। মাইক ছিল। সৌরভ যেন শুরুই করলেন ওয়ান ডে ক্রিকেটে তাঁর অফ দিয়ে মারা বিখ্যাত শটগুলো দিয়ে। প্রথমেই হাসতে হাসতে স্কোয়্যার ড্রাইভ, “ভিডিওয়ে দেখলাম, গত বার গ্রেগ চ্যাপেলকে ডাকা হয়েছিল। এ বার আমাকে ডেকে সেটা শুধরে নেওয়া হল!”

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৪ ০৯:০৫
Share: Save:

ক্রিকেট বিশ্ব এত দিন জানত, ‘অফসাইডের ঈশ্বর’ তাঁকে কেন বলে।

ক্রিকেটবিশ্ব আজ জানল, অবসরের ছ’বছর পরেও অফে তাঁর মোহিনী শটগুলো অক্ষত আছে!

শুধু আজ হাতে ব্যাট ছিল না। মাইক ছিল।

সৌরভ যেন শুরুই করলেন ওয়ান ডে ক্রিকেটে তাঁর অফ দিয়ে মারা বিখ্যাত শটগুলো দিয়ে। প্রথমেই হাসতে হাসতে স্কোয়্যার ড্রাইভ, “ভিডিওয়ে দেখলাম, গত বার গ্রেগ চ্যাপেলকে ডাকা হয়েছিল। এ বার আমাকে ডেকে সেটা শুধরে নেওয়া হল!” মধ্য কলকাতার অভিজাত হোটেলের বলরুম মুহূর্তে হাততালির আওয়াজে গমগমে। পরেরটা সোজা বাপি বাড়ি যা “দেখলাম, বিষেণ সিংহ বেদী ওঁর নামে অনেক ভাল ভাল কথা বললেন। বেদী কিন্তু অকুণ্ঠ প্রশংসা সবার করেন না। তা হলেই বুঝতে হবে টাইগার কী রকম ক্রিকেটার ছিলেন...।”

সত্যি, শটের ‘টাইমিং’-এ তো ছ’বছরেও ধুলো জমল না!

এবং বাংলা শব্দকোষের কোন শব্দবন্ধে ধরা যায় বুধবার সন্ধের সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে? কোন বিশেষণে বিশ্লেষণ করা যায় এক পূর্বসুরির প্রতি তাঁর সশ্রদ্ধ সম্মানজ্ঞাপন? অনুষ্ঠান শেষের দীর্ঘক্ষণ পরেও উত্তর নেই। বোধহয় হয়ও না।

বেঙ্গল ক্লাব ও ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এর আয়োজনে ‘টাইগার পটৌডি মেমোরিয়াল লেকচার’ বুধবারেরটা ধরে তৃতীয় বর্ষে পড়ল। গ্ল্যামারে, ক্রিকেট-বুদ্ধিতে তাঁর সমকক্ষ এমন শীর্ষস্থানীয় দুই ব্যক্তিত্বকে গত দু’বছরে দেখেছে বাংলা। দেখেছে ইমরান খান, গ্রেগ চ্যাপেলকে বক্তৃতার মাইক তুলে নিতে। কিন্তু দেখেনি এক মোহনায় ভারতীয় ক্রিকেটের দুই ‘টাইগার’-কে এমন ভাবে মিলে যেতে। দেখেনি এমন উচ্চমার্গের অনুষ্ঠানও।

যেখানে বাইশ গজে সৌরভের অক্লান্ত যুদ্ধের কথা শুনতে শুনতে অবধারিত ভাবে মনে পড়বে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বাকিদের সঙ্গে পটৌডির অসম লড়াই। যেখানে টাইগারের ব্যক্তিগত ক্রিকেট-কিট না থাকা, আলসেমির গল্প শোনার পর সৌরভ নিজেই উঠে বলে দেবেন, আলস্য তাঁরও কম ছিল না, একটা সময় শীতের ভোরে দৌড়নোর সময় রাহুল দ্রাবিড় নিয়ম করে অপেক্ষা করতেন। দ্রাবিড়ের ফোনের উত্তরে অনায়াসে বলে দিতেন, এই বেরোচ্ছি, অথচ তিনি তখন সবে লেপটা সরিয়েছেন! যেখানে ভারতীয় ক্রিকেটের দুই দুঁদে অধিনায়কের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কথা শুনতে শুনতে গুরুগম্ভীর পরিবেশ সৃষ্টি হবে না। বরং তাতে মিশে থাকবে হাস্যরস। যা শুনে, অনুষ্ঠানের স্বতন্ত্র আবহে আছন্ন টাইগার-পত্নী শর্মিলা ঠাকুর স্বয়ং বলে ফেলবেন, “এ বারেরটাই বেস্ট!”

অনুষ্ঠানের মুখবন্ধে যে মেজাজের জন্ম। পটৌডি এবং সৌরভের মধ্যে মিল ব্যাখ্যার সময় আনন্দবাজার সংস্থার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার বলছিলেন, “দু’জনেই অধিনায়ক হিসেবে সব সময় ছিলেন যাবতীয় প্রাদেশিকতার উর্ধ্বে। টাইগারের পর শুধুমাত্র গাঙ্গুলি এই স্পিরিটটা টিমে আমদানি করেছিলেন।” যা ঘটনা। বিষেণ সিংহ বেদী মানে একটা সময় বোঝাত উত্তর ভারত। আজহার মানে হায়দরাবাদ। পটৌডির সতীর্থদের কেউ কেউ আজও বলেন, টাইগার তাঁদের ‘ভারতীয়’ হিসেবে মাঠে নামতে শিখিয়েছিলেন। সৌরভও তেমন দীপ দাশগুপ্তকে তত দিন সুযোগ দেননি, যত দিন না তিনি টিমে ঢোকার যোগ্য ছিলেন। সৌরভের কাছে অধিনায়কত্বের সংজ্ঞা কী ছিল? ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক জবাব দেবেন, “বিশ্বাস। বাকি দশের উপর বিশ্বাস।” এবং কোনও দিন একসঙ্গে না খেলে, কোনও দিন সে ভাবে নবাবের ক্রিকেট না দেখেও অক্লেশে নিজের তাজ খুলে দেবেন। বলে দেবেন, তিনি বা অন্য কেউ নন। ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা অধিনায়কের নাম মনসুর আলি খান পটৌডি!

“উনি ভারতীয় ক্রিকেটের শিরা-উপশিরায় ক্রিকেটের শিল্পকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ইংল্যান্ডে খেলে মর্যাদা পাওয়া মোটেও সহজ নয়। টাইগার সেটা পেয়েছিলেন,” একটু থেমে আবার সৌরভ, “শুনলাম, উনি নিজের ব্যাটটাও ঠিকমতো সঙ্গে রাখতেন না। এখনকার ক্রিকেটারদের সঙ্গে দশ-এগারোটা ব্যাট থাকে। কেউ বিন্দুমাত্র চান্স নিতে চায় না এখন। তার উপর উনি একটা চোখ হারিয়েছিলেন। ভেবে দেখুন, উইকেটকিপার আর বোলারের মধ্যে আপনি দাঁড়িয়ে, মাথার টুপিতে ঢাকা একটা চোখ, একটা লাল বল ছুটে আসছে আপনার দিকে, যেটা আপনাকে খেলতে হবে। টাইগারের কিন্তু তার পরেও গড় ৩৫ ছিল। স্পেশ্যাল, তাই না?” এবং শেষে সংযোজন, “ক্রিকেটারদের গ্ল্যামার, ঝলকানিগুলোই আমরা দেখতে পাই। দেখতে পাই না তার পিছনে কতটা পরিশ্রম, প্রতিকুল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে কতটা চোয়ালচাপা যুদ্ধ তার পিছনে থাকে।”

যে যুদ্ধটা তাঁকেও কম লড়তে হয়নি।

নিজের দীর্ঘ ক্রিকেটজীবনের প্রত্যেকটা পাতা আজও মনে আছে সৌরভের। কোনওটা আনন্দের। কোনওটা দুঃখের। কোনওটা প্রকাশিত। কোনওটা এত দিন ধরে অব্যক্ত। ’৯১-এ অস্ট্রেলিয়া সফরে পার্থে ফ্লাইট যখন নামছিল, পাইলট কী বলেছিলেন মনে আছে এখনও। “প্রথমেই বলল, ভারতীয় টিম আপনাদের স্বাগত। পার্থের দ্রুততম পিচে আপনারা নামলেন,” বলছিলেন সৌরভ। তাঁর স্পষ্ট মনে আছে, ওই সফরে প্রথমে যে সিনিয়রের তিনি রুমমেট ছিলেন, তাঁর সঙ্গে প্রথম দু’মাস শুধু ‘গুড মর্নিং’ আর ‘গুড নাইট’ বলে কাটাতে হয়েছে। মনে আছে, টিমের এক বিখ্যাত ক্রিকেটারের সঙ্গে প্রথম ওয়ার্ম-আপ ম্যাচের সন্ধেয় পরিচিত হওয়া, যিনি ডিনারে নিয়ে গিয়ে সতেরোর সৌরভকে বলেছিলেন, তোমার এত অল্প বয়স। এই সফরটায় না এলেই পারতে! “আমি নিজেকে একটা কথা তার পর বলতাম। ভারতের হয়ে খেলব কি খেলব না, জানি না। অধিনায়ক হব কি হব না, সেটাও জানি না। কিন্তু কোনও দিন ওই জায়গাটায় পৌঁছলে জুনিয়রদের কখনও এই কথাগুলো বলব না,” কথাগুলো যখন বলে চলেন সৌরভ, পুরনো যন্ত্রণার আঁচটা এত দিন পরেও পাওয়া যায়। পরে যত দিন অধিনায়কত্ব করেছেন, বিশ্বাস করে এসেছেন স্বচ্ছ্বতায়। প্রথম দল নির্বাচনী বৈঠকের পর মনে হয়েছিল, পারবেন না। বেশি দিন ক্যাপ্টেন থাকা তাঁর হবে না। স্ত্রীকে বলেওছিলেন, “মিটিংয়ে কেউ তারকা, কেউ আগের অধিনায়ক। আমি কী বলব?” ২০০০ সালে এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল পটৌডির সঙ্গে। জিজ্ঞেস করেছিলেন, “স্যর, আমি দেশের হয়ে ন’বছর খেলছি। এখন ক্যাপ্টেন। আপনি আমাকে একটা উপায় বলুন, যাতে এই টিমটাকে একটা জয়ী টিমে পাল্টে দেওয়া যায়।” উত্তরে পটৌডি একটাই কথা সে দিন বলেছিলেন সৌরভকে।

সেই টিমটাকে বাছো, যে টিম তুমি চাও। সেই টিমটাকে বাছো যারা জিততে পারে।


টাইগার পটৌডি স্মারক বক্তৃতায় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ও শর্মিলা ঠাকুর। বুধবার।

বুধবার নিজেই সৌরভ বলছিলেন, সহবাগ-যুবরাজদের নির্বাচন করেছিলেন বলে পরে প্রচুর লোক প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু প্রথমে যখন এনেছিলেন, সহবাগরা কত দূর যেতে পারেন শেষ পর্যন্ত বা আদৌ যাবেন কি না, কোনও কিছুরই ধারণা ছিল না। “আমার স্ট্র্যাটেজি ছিল সেরা প্লেয়ারকে তুলব। তার প্রতিভাকে মেলে ধরার সুযোগ দেব। আমার টিমে সেই প্লেয়ার পছন্দ ছিল যারা বলবে, কেন আমি নেই। আমি তাদের চাইনি যারা টিম লিস্টে নাম দেখে বলবে, আবার আমি কেন!” বলছিলেন সৌরভ। যিনি পরিষ্কার বলে দিলেন, ক্রিকেটে আগাম স্ট্র্যাটেজি করে কিছু হয় না। পরিস্থিতি অনুযায়ী রিঅ্যাক্ট করাকেই স্ট্র্যাটেজি বলে। জয়সূর্যর বিরুদ্ধে এক সময় দিনের পর দিন স্ট্র্যাটেজি করে লাভ হয়নি, উল্টে জয়সূর্য ট্রিপল সেঞ্চুরি করে বেরিয়ে গিয়েছেন। যিনি বিশ্বাস করতেন, প্লেয়ারকে প্রথমেই বলে দেওয়া ভাল তোমার কাছ থেকে কী চাওয়া হচ্ছে, আর তুমি কী দিচ্ছ। যিনি মনে করতেন, ক্যাপ্টেনের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হল সে যখন নিজে ফর্মের বাইরে থাকে। যখন দরকার হয় কোচের।

উদাহরণ ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনালের আগে জন রাইটের তাঁর সঙ্গে ঝামেলা বাঁধিয়ে দেওয়া। প্রেস কনফারেন্সের জন্য নেটে দেরিতে আসা নিয়ে (যা নাকি জন নিজেই বলেছিলেন। বলেছিলেন প্রেস কনফারেন্স সেরে আসতে) ব্যাপারটা এমন জায়গায় চলে গিয়েছিল যে, নাসের হুসেনের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে লর্ডসে সেই ম্যাচ হারলে দু’জনের একজন নাকি থাকতেন। হয় রাইট, নইলে সৌরভ! “ম্যাচটা জেতার পর রাইট আমাকে বলেছিল, ও ওটা ইচ্ছে করে করেছিল। আমাকে তাতিয়ে আমার ফর্ম ফেরাতে। তখন খুব খারাপ খেলছিলাম। পরে এই ব্যাপারটা ২০০৫ সালে আরও একজনের সঙ্গে করতে যাই। কিন্তু তখন আমাকেই বেরিয়ে যেতে হয়েছিল!” বলছিলেন সৌরভ। পরে আরও বললেন, “জানতাম না ম্যানেজারের রিপোর্ট এত গুরুত্বপূর্ণ হয়। পরে দেখলাম, সেটাই হল।” যিনি শাহরুখ খানের তাঁকে বলা একটা কথা প্রবল ভাবে বিশ্বাস করতেন--‘আয়্যাম দ্য বেস্ট!’ যাঁর কাছে অধিনায়কত্ব জীবন শেষ দিন পর্যন্ত ছিল এক বক্সারের মতো।

মার খেতে হবে। উঠতে হবে। আবার পাল্টা মারও দিতে হবে।

শুনলে কোথাও যেন এক যোগসূত্রের খোঁজ পাওয়া যাবে দুই প্রজন্মের দুই অধিনায়কের। পটৌডিকেও জীবনে রুক্ষতা কম দেখতে হয়নি। গাড়ি দুর্ঘটনার পর তো ক্রিকেট খেলার কথাই নয় তাঁর। ঠিক যেমন সৌরভের। বিভিন্ন ক্রিকেটীয় আঘাতে যাঁর ক্রিকেটজীবনও অকালে থেমে যেতে পারত। তাই কোথাও গিয়ে মনে হবে, অতীত আজ না থেকেও ভাল ভাবে বর্তমান তাঁর উত্তরসুরির মধ্যে।

যাহা নবাব, তাহাই মহারাজ!

ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE