Advertisement
E-Paper

বিরাট-রাজের বিক্রমে আবারও বিশ্বজয়ের রাজপথে ধোনিবাহিনী

টিম হোটেলে সকালবেলা দেখছিলাম, দক্ষিণ আফ্রিকান মনোবিদ প্যাডি আপটন তাড়া-তাড়া প্রিন্টআউট-সহ টিমেরই এক কর্তার সঙ্গে আলোচনা-মগ্ন। শুনলাম এগুলো প্লেয়ারদের ঘরে বিলি করার জন্য। অবশ্যই মানসিক বলবর্ধক! একটা নির্দয় ইতিহাসের পরম্পরা সমেত দু’প্লেসির টিম এই টুর্নামেন্টটা খেলতে নেমেছিল। আর সেই ইতিহাসকে অক্ষত রেখেই তারা বিদায় নিল। একটা ডেল স্টেইন, একটা ডে’ভিলিয়ার্স টিমে থেকেও তারা ষোলো বছরে কোনও আইসিসি টুর্নামেন্টে নকআউট ম্যাচ জেতেনি। আপটন প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন সেই ‘চোকার্স’ তকমাটা খসিয়ে দেওয়ার জন্য এবং তিনি সংশয়হীন ভাবে ব্যর্থ।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৫৭
জয়ের উল্লাস। শুক্রবার ঢাকায় বিরাট কোহলি। ছবি: এএফপি।

জয়ের উল্লাস। শুক্রবার ঢাকায় বিরাট কোহলি। ছবি: এএফপি।

টিম হোটেলে সকালবেলা দেখছিলাম, দক্ষিণ আফ্রিকান মনোবিদ প্যাডি আপটন তাড়া-তাড়া প্রিন্টআউট-সহ টিমেরই এক কর্তার সঙ্গে আলোচনা-মগ্ন। শুনলাম এগুলো প্লেয়ারদের ঘরে বিলি করার জন্য। অবশ্যই মানসিক বলবর্ধক! একটা নির্দয় ইতিহাসের পরম্পরা সমেত দু’প্লেসির টিম এই টুর্নামেন্টটা খেলতে নেমেছিল। আর সেই ইতিহাসকে অক্ষত রেখেই তারা বিদায় নিল। একটা ডেল স্টেইন, একটা ডে’ভিলিয়ার্স টিমে থেকেও তারা ষোলো বছরে কোনও আইসিসি টুর্নামেন্টে নকআউট ম্যাচ জেতেনি। আপটন প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন সেই ‘চোকার্স’ তকমাটা খসিয়ে দেওয়ার জন্য এবং তিনি সংশয়হীন ভাবে ব্যর্থ।

বুড়িগঙ্গার ধারে আজ ক্রিকেট ইতিহাসের বিচ্যুতি নয়, তার পরম্পরা রক্ষার দিন ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার যেমন ইতিহাস আছে। তেমনই মহেন্দ্র সিংহ ধোনিরও তো রয়েছে। আজ পর্যন্ত কোনও টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল হারেননি ধোনি। শুক্রবারে প্রথম ব্যাট করে যখন দক্ষিণ আফ্রিকা ১৭২ করে ফেলল, ভারতীয় সাংবাদিকেরা কেউ কেউ তাঁদের ট্র্যাভেল এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। টিম নিশ্চয়ই হারার পর ঢাকায় পড়ে থাকবে না। আর তখন দেশে কে-ই বা পড়বে শ্রীলঙ্কা-দক্ষিণ আফ্রিকা ফাইনালের লেখা! যেমন উদ্দীপ্ত ভঙ্গিতে দুমিনিরা ভারতীয় বোলিংকে আক্রমণ করেছিলেন আর তার পর যখন রানটা এই টুর্নামেন্টের ম্যাজিক সংখ্যা ১৬০ ছাড়িয়ে গেল, মনে হয়েছিল, সম্ভব নয়। কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে একটা গণ-বিপর্যয় থেকে আত্মরক্ষা করা সম্ভব নয়। এক বার খেলা ঘুরে গেল তো গেল। তা-ও আবার বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো প্রেশার কুকারে সেদ্ধ হওয়া ম্যাচে। কিন্তু ওই যে দিল্লি এবং মুম্বইয়ের কোচিং ক্যাম্পে ভারতের বড় ম্যাচের পরের সকালে বলাবলি হয়— আনহোনি কো ধোনি কর দে। ধোনি কো আনহোনি।

ধোনি যখন ব্যাট করতে নামলেন, জেতার জন্য চাই ঠিক ছ’রান। সবাই জানে, অন্তিম দৃশ্য কী হতে যাচ্ছে। তিনি একটা বিশাল ছক্কা মারবেন। ভারত ছ’উইকেটে জিতে যাবে। আর এখানেই মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মাস্তানি। যে ম্যাচে তিনি কিছুই করেননি, সে ম্যাচের আলো নিতে তিনি গররাজি। বরং সেটা ছেড়ে দিতে চান যে ম্যাচটা জেতাচ্ছে, তাকে। ৪৯তম ওভারের শেষ বলটা তাই তিনি এমন মন দিয়ে ডিফেন্স করলেন, পরিস্থিতির বিচারে যেটা কঠিনতম। শতকরা নিরানব্বই ভাগ ওই পরিস্থিতিতে অতশত না বিবেচনা করে স্রেফ উইনিং স্ট্রোকটা মেরে দেবে। তিনি ধোনি, তাই হেনড্রিকসের ছক্কা মারার শর্ট বলটাও ডিফেন্স করলেন। পরের ওভারে প্রথম বলে কোহলির বাউন্ডারি। ভারত তার টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে এমন একটা ম্যাচ পাঁচ বল বাকি থাকতে জিতল, যা চিরস্মরণীয় আখ্যা পাওয়া উচিত।

সাবাশ! অবিশ্বাস্য সেই ক্যারম বলের পর। ছবি: এএফপি।

মিরপুর যেমন ইতিহাসের পরম্পরা রক্ষা করল, তেমনই ইতিহাসকে এগিয়েও দিল। এই ইতিহাস কোহলির টিম ইন্ডিয়ার তারুণ্যের তাজা পাতা। ওয়ান ডে-তে ধোনির আমলে রান তাড়া করে জেতার অনেক কীর্তিস্তম্ভ রয়েছে। কিন্তু কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে এমন রুদ্ধশ্বাস রান তাড়া, ওয়ান ডে-তে সাড়ে তিনশো তাড়া করে জেতার সমতুল্য। তা-ও আবার কি না বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে। তাই চিরস্মরণীয় বলছি।

ভারত বোলিং পরিবর্তন ও ফিল্ডে যেমন স্নায়ুচাপে ভুগছিল, রানটা তাড়া করল ঠিক ততটাই পেশাদারি দক্ষতায়। রবিচন্দ্রন অশ্বিন দুধর্র্র্ষ বোলিং করেছেন।

আমলাকে বোল্ড করা তাঁর ক্যারম বল অনায়াসে ‘ডেলিভারি অব দ্য টুর্নামেন্ট’ হিসেবে নমিনেশন পেতে পারে। ফাইনালে যা-ই ঘটুক, অশ্বিন ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের গাড়িটা পাওয়ার অগ্রগণ্য দাবিদার।

কিন্তু দু’টো অশ্বিনেও ম্যাচটা বার করা সম্ভব ছিল না, একটা বিরাট কোহলি না থাকলে। এই মিরপুর মাঠ অধিনায়ক কোহলিকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল আফ্রিদির দুটো ফাটকাওয়ালা ছক্কায়। ব্যাটসম্যান কোহলিকে বত্রিশ দিন বাদে সেই মাঠই ফিরিয়ে দিয়ে গেল ব্যাটসম্যানশিপের রাজমুকুট। আজকের ৪৪ বলে ৭২ রানের ইনিংসকে কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। জেনারেশন ওয়াই-এ কোহলি সত্যিই তেন্ডুলকরের উত্তরাধিকার। স্ট্রাইক রেট নিছক দেখলে এর চেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া আরও টুর্নামেন্ট ইনিংস পাওয়া যাবে। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে, যে বোলিং এবং চাপের মুখে খেলা হয়েছে, তা এ বারের বিশ্বকাপে নজিরবিহীন। কখনও কখনও তাঁকে সত্যিই আধুনিক ক্রিকেটের ভিভ দেখাচ্ছে।

দুপুরে তেজগাঁও-এ নিজের নতুন অফিসে বসে বাংলাদেশের ডাকসাইটে যোগাযোগ মন্ত্রী এবং অকৃত্রিম সচিন ভক্ত ওবিদুল কাদের নিশ্চিন্ত ভাবে বলছিলেন, “ইন্ডিয়ার স্পিনার অনেক ভাল। অলরাউন্ড টিম। ওরাই জিতবে।” গড়পরতা ধারণাও তা-ই ছিল। সেমিফাইনালে বল বাঁইবাঁই করে ঘুরবে এবং মিশ্র-র সামনে জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে দু’প্লেসিদের। গত কাল ভোররাত্তিরে ঢাকায় অত বৃষ্টি আর বাজ পড়ার পরেও আজ সুষ্ঠু ভাবে খেলা হবে যেমন কেউ ভাবেনি, তেমন ভাবেনি অমিত মিশ্র ওভারপিছু ১২ রানের এমন বেধড়ক ঠ্যাঙানি খাবেন যে, তাঁর কোটা শেষ করানো যাবে না। যে অশ্বিনকে এক ওভার মেডেন উইকেটের পরেও ধোনি আবার আট ওভার পরে আনবেন, যখন খেলা বেরিয়ে যাচ্ছে। তার পর আবার তিনি দু’ওভারে মাত্র ৮ রান দেওয়া ‘স্যর’ জাডেজার ওভারই শেষ করাবেন না। শেষ ওভার দেবেন মোহিত শর্মাকে, যাঁর ভবিতব্যই ছিল মার খাওয়া। আইসিসি নকআউট ম্যাচে অধিনায়ক ধোনিকে এত নড়বড়ে কখনও কোথাও দেখা যায়নি। আর দু’প্লেসিদেরও কখনও দেখা যায়নি লেগস্পিনারের বিরুদ্ধে এমন দাপট দেখাতে।

মিশন দক্ষিণ আফ্রিকা সফল যাঁদের হাত ধরে। শুক্রবার ঢাকায় রোহিত, রায়না, যুবরাজ। ছবি: এএফপি। সবিস্তার...

দক্ষিণ আফ্রিকানদের যতই ক্রিকেটবিশ্ব আজ রাত্তির থেকে আরও ‘চোকার্স’ বলে বিদ্রূপ করুক, তারা তখন মাঠে জঙ্গি আউটফিটের চেহারা নিয়েছিল। প্রথম অর্ধে ভারতীয় স্পিনারদের দাবড়ে দেওয়ার পর বাকি কাজটা ডেল স্টেইনের নেতৃত্বে করার কথা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকান পেসারদের। দ্রুতই তাঁদের ছক পরিষ্কার হল। এমনিতে ওয়ান ডে-তে ওভার পিছু দু’টো বাউন্সার চলে। এই ফর্ম্যাটে একটা। আরও একটা সমস্যা, ঢাকাই সারফেস একেবারেই দ্রুতগামী নয়। ডেল স্টেইনকেও ইশান্ত শর্মা মনে হয়। রোহিত তো একটা স্কোয়্যার কাটে তাঁকে পয়েন্টের ওপর দিয়ে ছক্কাই মেরে দিলেন! দক্ষিণ আফ্রিকানরা দ্রুত চলে এল প্ল্যান বি-তে। তারা বুদ্ধি করে স্লো বাউন্সার শুরু করল। যেগুলো শর্ট, গায়ের ওপর। কিন্তু বাউন্সার হিসেবে ঠিক গণ্য হবে না। গতির ভারসাম্যের এ দিক-ও দিকে করা হচ্ছিল পরপর স্লোয়ার। পার্নেল আর হেনড্রিকস দুই বাঁ-হাতি মিলে এমন গায়ের ওপর স্লো রাখছিলেন যে, যথেচ্ছ মারাটাই সমস্যা। রাহানেরা আটকে আটকে গেলেন।

আর এই জায়গাটাতেই বিরাটীয় মহিমা! এত ভাল পুল খেলেন তিনি যে, শর্ট বলেও আটকানো সম্ভব নয়। ভারতীয় ক্রিকেটে পুল এত ভাল খেলতেন বিজয় মঞ্জরেকর। তার পর মোহিন্দর। সর্বশেষ, রাহুল দ্রাবিড়। তা-ও রাহুলের শুরুর দিকের খেলা শেখা বেঙ্গালুরুর ম্যাটিং উইকেটে, যেখানে বল লাফায়। পুল খেলা অভ্যেস হয়ে যায়। দিল্লির নিস্তেজ পিচে খেলা শেখা কোহলি কী করে পুলে এত ওস্তাদি আনলেন? মনে হয় কৃতিত্বটা অনেকটাই প্রাপ্য তাঁর দূরদর্শী কোচ রাজকুমার শর্মার। যিনি বুঝেছিলেন বিদেশে রান করার জন্য পুল শটটা না শিখলেই নয়। আচরেকরের মতোই শর্মার এ বার পরিচিতি লাভের সময় হয়েছে!

বিরাট-রাজের বিক্রমে ভারত আবার বিশ্বকাপ ফাইনালে। দু’টো দিন তিন বছরের এ দিক-ও দিক। অথচ মনে হচ্ছে কী কাছাকাছি। যেন এই সে দিন ঘটল।

ওয়াংখেড়ে ২ এপ্রিল ২০১১।

মিরপুর ৬ এপ্রিল ২০১৪।

আচ্ছা, এ বার তো শ্রীলঙ্কা দাঁড়িয়ে থাকবে ‘চোকার্স’ শিরোনামের দ্বারপ্রান্তে...তাই না?

দক্ষিণ আফ্রিকা

ডি’কক ক ধোনি বো ভুবনেশ্বর ৬

আমলা বো অশ্বিন ২২

দু’প্লেসি বো অশ্বিন ৫৮

দুমিনি ন. আ ৪৫

ডি’ভিলিয়ার্স ক রোহিত বো অশ্বিন ১০

মিলার ন.আ ২৩,

অতিরিক্ত ৮।

মোট ২০ ওভারে ১৭২-৪।

পতন: ৯, ৪৪, ১১৫, ১২৯।

বোলিং: ভুবনেশ্বর ৪-০-৩৩-১, মোহিত ৩-০-৩৪-০, অশ্বিন ৪-০-২২-৩,

জাডেজা ২-০-৮-০, রায়না ৪-০-৩৫-০, অমিত ৩-০-৩৬-০।

ভারত

রোহিত ক দু’প্লেসি বো হেনড্রিক্স ২৪

রাহানে ক ডি’ভিলিয়ার্স বো পার্নেল ৩২

কোহলি ন. আ ৭২

যুবরাজ ক ডি’ভিলিয়ার্স বো তাহির ১৮

রায়না ক দু’প্লেসি বো হেনড্রিক্স ২১

ধোনি ন.আ ০

অতিরিক্ত ৯।

মোট ১৯.১ ওভারে ১৭৬-৪।

পতন: ৩৯, ৭৭, ১৩৩, ১৬৭।

বোলিং: দুমিনি ৩-০-২৯-০, মর্কেল ২-০-১৭-০, স্টেইন ৩.১-০-৩৬-০,

হেনড্রিক্স ৪-০-৩১-২, পার্নেল ৩-০-৩৩-১, তাহির ৪-০-৩০-১।

gautam bhattacharya icc world t20 india south africa
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy