আজ রাতে গৌতম গম্ভীর ক্রিকেট-দেবতার কাছে একটা অনুযোগ অনায়াসে পেশ করতে পারেন। জিজ্ঞেস করতে পারেন, একটা নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে কেন তাঁর ভাগ্যাকাশে বরাবর এমন অবধারিত দুর্যোগ লেখা থাকে?
গত কালই কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছেন নাইট অধিনায়ক। নবজাতককে দেখে নিজেও টিমের সঙ্গে একই ফ্লাইটে উড়ে এসেছিলেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনির পাড়ায়। কেউ কেউ রাতের দিকে টুইটও করে দেন যে, নাইট ক্যাপ্টেনকে বহু দিন পর প্রাণখোলা হাসতে দেখা যাচ্ছে। শোনা গেল, কেকেআর ক্যাপ্টেন কোনও ভাবেই ম্যাচটা মিস করতে চাননি। চেয়েছিলেন, সিএসকে ম্যাচটা জিতে জীবনে আগত নতুন আনন্দে পরিতৃপ্তির উপাদান যোগ করতে।
কে জানত, আইপিএল সেভেনে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে একপেশে পরাজয়টা তাঁর কপালে আজই লেখা থাকবে? চেন্নাই জিতবে চরম ঔদ্ধত্যে, কেকেআরকে ক্রিকেটের প্রত্যেক বিভাগে মাইক টাইসনের ‘আপার-কাটে’ শুইয়ে দিয়ে!
কে জানত, অদৃষ্টের নির্মম পরিহাসে মাঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরও এক ব্রাত্যজনের ‘ক্রুদ্ধসঙ্গীত’ শুনতে হবে গম্ভীরকে? দেখতে হবে, বৃষ্টিবিঘ্নিত সতেরো ওভারের ম্যাচের প্রথম দশেই কী ভাবে তাঁর আকাশে আবির্ভাব ঘটছে বিপর্যয়ের বজ্রগর্ভ মেঘের। ঘটাচ্ছেন যিনি, গত বার পর্যন্ত কেকেআর সংসারে ছিলেন। ব্রাত্য। ঠিক ক্রিস গেইলের মতো!
আশ্চর্য সমাপতন মনে হতে পারে। কিন্তু কেকেআরের পৃথিবীতে ব্যাপারটা আর ব্যতিক্রম নয়, বর্তমানে নিয়ম। প্রাক্তন নাইটদের পাল্লায় পড়া মানে কেকেআর অবধারিত ম্যাচ শেষে কচুকাটা হয়ে কেকে হার। চরিত্রগুলোই যা বদলায়। কোনও দিন যার নাম হয় ক্রিস গেইল। কোনও দিন ব্রেন্ডন ম্যাকালাম। পরিণতি একই থাকে।
প্রথমে ‘প্রতিশোধ’-এর বজ্রগর্ভ মেঘের আগমন। এবং শেষে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মৃত্যু!
প্রাক্তন নাইট ব্রেন্ডন ম্যাকালাম অবশ্য ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে।
৪০ বলে ৫৬ করে গেলেন সিএসকে ওপেনার। শুক্রবার।
আজ যেমন ম্যাকালাম নৃশংসতার প্রতিশব্দ হিসেবে উদয় হলেন। রবীন্দ্র জাডেজা ১২ রানে চার উইকেট নিয়ে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ হলেন ঠিকই, কিন্তু পুরস্কারটা স্বচ্ছন্দে ম্যাকালামকেও দেওয়া যেত। নিজের পাড়ায় নাইটদের চূর্ণ করার প্রেক্ষাপটই সৃষ্টি হয় না শুক্রবার ম্যাকালামের ৪০ বলে ৫৬ রানের ইনিংসটা না থাকলে। পাঁচটা বাউন্ডারির সঙ্গে দু’টো ছক্কা। গেইলের মতো নৃশংস নয়, কিন্তু গোড়ায় নাইটদের কোমর ভেঙে দেওয়ার জন্য ওটুকু বোধহয় যথেষ্ট ছিল। বিনয়কুমারের শর্ট পিচড ডেলিভারিগুলো এমন প্রচণ্ড গতিতে বাউন্ডারির বাইরে উড়ে গিয়েছে যে দেখে মনে হয়েছে, ম্যাকালাম নয়। ক্রিজে দাঁড়িয়ে কোনও এক আর্নল্ড সোয়ার্জেনেগার। সুনীল নারিন পর্যন্ত নিস্তার পেলেন না! আদ্যন্ত টার্নারে পরের দিকে স্রেফ তাঁকে দেখে খেলে ছেড়ে দিলেন ধোনি-রায়না-জাডেজারা। এবং বাকিদের ধ্বংস করে দেড়শোর কাছাকাছি তুলে ফেললেন।
সতেরো ওভারে ১৪৯ তাড়া করে জেতা টি-টোয়েন্টির বাজারে কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নয়। মুশকিল হচ্ছে, তার জন্য ব্যাটটাও একটু-আধটু করতে হয়! ওভার পিছু সাড়ে আট রান টার্গেট থাকলেই যে প্রতিটা বল বাইরে ফেলে দিতে হবে— এমন কোনও নিয়মের কথা টি-টোয়েন্টির ম্যানুয়্যালে লেখা নেই। রাতে রবিন উথাপ্পা আফশোস করছিলেন, তাড়াহুড়ো করে পরপর তিন-চারটে উইকেট চলে যাওয়াতেই বিপর্যয়টা আটকানো গেল না। কিন্তু ঘটনা হল, তাড়াতাড়ি উইকেট এমনি-এমনি যায়নি। ধৈর্যের অভাবে গিয়েছে। গম্ভীর ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট। জাক কালিস থেকে সাকিব আল হাসান অহেতুক চালাতে গিয়ে। লাভের লাভ? ১-১৭, ২-৩৬, ৩-৩৮, ৫-৬৫, ৬-৮৮... শেষ পর্যন্ত অতি কষ্টে ১১৪-৯!
ইতিহাস বলবে, সিএসকের বিরুদ্ধে কেকেআরের রেকর্ড কোনও দিনই সুখের ছিল না। আজও তাতে পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু এ দিনের পর কয়েকটা কড়া প্রশ্নের সামনে পড়তে হবে কেকেআর ক্যাপ্টেনকে। দু’দিক থেকেই স্পিন দিয়ে শুরু করা, প্রথম ছ’ওভার টানা স্পিনার দিয়ে করিয়ে যাওয়ার স্ট্র্যাটেজি নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু প্রশ্ন উঠবে, বিসলা বাদ কেন? যখন সিএসকের বিরুদ্ধে তাঁকে নিয়ে একটা প্রবাদই আছে— ভিভিএস : অস্ট্রেলিয়া ইকোয়ালস টু বিসলা : সিএসকে! তার চেয়েও বড় ব্যাপার, কোন যুক্তিতে মর্নি মর্কেল বাদ পড়েন? ঢোকেন আন্দ্রে রাসেল? ২ ওভারে রাসেল দিলেন ২৫, ব্যাটিংয়ে ১! মর্কেল এর চেয়ে খারাপ করতেন কি? ৬ ম্যাচে মাত্র ২ জয়ের যন্ত্রণা গিলতে তো হলই। সঙ্গে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে যে সব তথ্য ভেসে উঠল, সেগুলোও যথেষ্ট পীড়াদায়ক।
বৃষ্টির ধাক্কায় এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট পিছিয়ে গেল ভারতের প্রথম আইপিএল সেভেন ম্যাচ।
সিএসকে ওপেনাররা আজ পর্যন্ত কেকেআরের বিরুদ্ধে যে ক’টা হাফসেঞ্চুরি করেছেন, তা নাইটদের বিরুদ্ধে কোনও টিমের করা সর্বাধিক। সংখ্যাটা— ৬।
কেকেআরের বিরুদ্ধে ব্যাট করতে নামলে সিএসকে-র গড় রান প্রতি উইকেট হল ৪৭।
গম্ভীরের অন্যতম প্রধান অস্ত্র পীযুষ চাওলাকে সবচেয়ে বেশি খরুচে আজ পর্যন্ত দেখিয়েছে সিএসকে-র বিরুদ্ধেই।
শোনা গেল, ক্যাপ্টেন কুল গত রাত থেকেই বেশ ফুরফুরে ছিলেন। টিম সিএসকে-কে বাড়িতে ডেকে পার্টির পর নিজের ‘হার্লে ডেভিডসন’ নিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়েতে চক্কর মেরে এসেছিলেন বেশ কিছুটা।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ন্যাশনাল হাইওয়ে ছেড়ে ধোনির সেই ডেভিডসন যে জেএসসিএ স্টেডিয়ামের দিকে ছুটতে শুরু করবে, গম্ভীরের অদৃষ্টের মতো সেটাও বা কে জানত!
চেন্নাই সুপার কিংস
স্মিথ এলবিডব্লিউ সাকিব ১৬
ম্যাকালাম ক পাঠান বো রাসেল ৫৬
রায়না ক যাদব বো সাকিব ৩১
ধোনি ন.আ. ২২
জাডেজা ন.আ.১৭
অতিরিক্তি ৬,
মোট (১৭ ওভারে) ১৪৮-৩
পতন ২০-৯০-১১৯
বোলিং: সাকিব ৪-০-২৫-২, নারিন ৪-০-২৬-০, চাওলা ৩-০-৩১-০,
বিনয় কুমার ৩-০-২৬-০, কালিস ১-০-১০-০, রাসেল ২-০-২৫-১।
কলকাতা নাইট রাইডার্স
উথাপ্পা ক ধোনি বো জাডেজা ৪৭
গম্ভীর রান আউট ৬
কালিস ক মানহাস বো অশ্বিন ৪
মণীশ ক ম্যাকালাম বো জাডেজা ১
সাকিব ক মোহিত বো জাডেজা ০
যাদব এলবিডব্লিউ জাডেজা ৮
ইউসুফ এলবিডব্লিউ মোহিত ৪১
রাসেল বো মোহিত ১
পীযূষ ক দু’প্লেসি বো মোহিত ১
বিনয় কুমার ন.আ.০
নারিন ন.আ. ১
অতিরিক্তি ৪
মোট (১৭ ওভারে) ১১৪-৯
পতন ১৭-৩৬-৩৮-৩৮-৬৫-৮৮-৯১-১১৩-১১৩।
বোলিং: হিলফেনহস ৩-০-২৬-০, ঈশ্বর ২-০-২০-০, মোহিত ৩-০-২২-৩,
অশ্বিন ৪-০-২১-১, জাডেজা ৪-০-১২-৪, রায়না ১-০-১০-০।
ছবি: পিটিআই।