সোমবার রাতে গম্ভীরের ছবি তুলেছেন শঙ্কর নাগ দাস
উইকিপিডিয়ায় ‘রাগ’-এর সংজ্ঞাটা এই রকম—
“মনঃস্তাত্বিক ব্যাখ্যায় কোনও কিছুকে হুমকি বা শাসানি বলে মনে হলে বিপদের আশঙ্কায় যে আবেগতাড়িত প্রতিক্রিয়া হয় সেটাই রাগ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাগ তখনই হয় যখন কোনও ব্যক্তির মৌলিক সীমাগুলো লঙ্ঘিত।”
হ্যাঁ, রবিবার সানরাইজার্স ম্যাচে আমাকে ভুল আউট দেওয়ায় আমি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
ওই সময় মাথায় হানা দিয়েছিল একরাশ ‘কী হবে’!
প্রথমত: আমি আউট হয়ে গেলাম। এ বার যদি রবিন উথাপ্পাও আউট হয়ে যায় তা হলে কী হবে?
দ্বিতীয়ত: রাজস্থান রয়্যালসের বিরুদ্ধে আমদাবাদের ম্যাচে দল যে ভাবে বিনা উইকেটে ১২১ থেকে ১২৩ রানে ছ’উইকেট খুইয়ে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছিল, সে রকম যদি আবার হয় তা হলে কী হবে?
তৃতীয় এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আশঙ্কা: সহজ উইকেটে মাত্র ১৪২ তাড়া করতে নেমে আমরা যদি হেরে বসি আর দশ পয়েন্টে আটকে যাই, তা হলে কী হবে?
কী হবে...কী হবে...কী হবে...ভাবতে ভাবতে মনে হচ্ছিল মাথার ভিতর তক্ষুনি একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে যাবে! বাজে সিদ্ধান্তে আউট হয়ে ক্রিজ থেকে ডাগ আউটে ফেরার পথে তাই এমন বাছাবাছা কিছু শব্দ ব্যবহার করছিলাম, আমার ঠোঁটের নড়াচড়া থেকে লিপ রিডাররা যেগুলো পড়ে দারুণ আনন্দ পেয়েছেন!
বেশির ভাগ দিন নিজেকে এক জন সহজ সরল ঠান্ডা মাথার মানুষ বলেই ভাবতে আমার ভাল লাগে। আমার তিনটে কুকুর—
জুনিয়র, টাইসন আর বাডি। ওরা তিন জন আমাকে ভীষণ ভালবাসে, আর আমার তো ওরা নয়নের মণি! পরিবারের দাবি, আমার উপস্থিতিই নাকি বাড়িটাকে বাড়ি করে তোলে। কয়েকজন খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে যাদের হাবেভাবে মনে হয়, ওরা আমার সঙ্গ পছন্দ করে। এমনকী শ্বশুর-শাশুড়ির মুখেও নিজের সম্পকের্র্ বেশ ভদ্রস্থ রিভিউ-ই শুনেছি। যদিও বিশ্বাস করুন, আমি কিন্তু সেই আগ মার্কা কথায় কথায় ‘পেরি পেন্না’ বলে পেন্নাম ঠোকা সুবোধ পঞ্জাবি জামাইদের দলে পড়ি না।
একমাত্র প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশেই আমার ভিতরের লড়াকু সত্তাটা বেরিয়ে আসে। মেনে নিচ্ছি, আমি হারতে ঘৃণা করি। হার ব্যাপারটা একেবারেই মেনে নিতে পারি না। রবিবার আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতার জন্য আমার পনেরো শতাংশ ম্যাচ ফি জরিমানা হওয়ার আগেই জানতাম, আম্পায়াররাও মানুষ তাই ওঁদের দু’একটা ভুল ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। কিন্তু মুশকিল হল, প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলোয় আবেগ ব্যাপারটা এতটাই তীব্র যে, সহ্যের সীমাগুলো বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
ক্রিকেটারদের মধ্যে সাধারণত একটা মানসিকতা কাজ করে যে, আমাদের কাছে যখন কেউ একশো শতাংশের কম প্রত্যাশা করে না, তখন আম্পায়ারদের ক্ষেত্রে ভুলচুকের এত ছাড় দেওয়া হবে কোন যুক্তিতে? হতে পারে এ ভাবে ভাবাটা আম্পায়াদের প্রতি অবিচার।
মাঠে চল্লিশ হাজার দর্শক লাগাতার চিৎকার করছেন। বোলার বল করছে ১৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। এ দিকে, ফ্রন্টফুট নো বলের নিয়মটা চালু হওয়ায় আম্পায়ারকে বোলারের সামনের পায়ের দিকে নজর রেখে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফেরাতে হচ্ছে ব্যাটসম্যানের দিকে। এবং এর সবটাই ঘটে যাচ্ছে আধ সেকেন্ডেরও কম সময়ে। ভুল হতেই পারে!
মেনে নিচ্ছি, আম্পারের কাজটা মোটেই সহজ নয়।
এই পশ্চাদপট মাথায় রাখলে আমার প্রতিক্রিয়া মোটেই শোভন ছিল না। ওই ঘটনার অনেক পরের কথা, ততক্ষণে আমরা ম্যাচটা জিতে গিয়েছি আর আমার মাথাও ঠান্ডা হয়েছে। এক টিমমেট এসে মনে করিয়ে দিয়ে গেল যে, আমি এখন মেয়ের বাবা। খুব শিগগিরই আমার ছোট্ট পরি তার বাবার খেলা দেখা শুরু করবে।
মানছি, মেয়ের কাছে ওর একমাত্র হিরো হয়ে উঠতে চাই আমি। কিন্তু এটাও জানি, রবিবারের মতো আচরণ করলে কোনওদিনও ওর হিরো হয়ে উঠতে পারব না।
আমি আপাতত সেই দিনটার অপেক্ষায় যে দিন ওকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় আসতে পারব। বাবা আর বাবার টিমের জন্য কলকাতার মানুষের এই এত ভালবাসা দেখলে ও নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে গর্ব বোধ করবে। কলকাতা আমার দ্বিতীয় বাড়ি। বিমানবন্দর থেকে টিম হোটেল পর্যন্ত রাস্তা, দু’ধারের দৃশ্যগুলো, সব আমার সিস্টেমের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। এ বার হোটেলে চেক ইন করতে আমাদের বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। তাই পৌঁছেই প্রতিবার যেটা সবচেয়ে পছন্দের প্রথম কাজ—
হোটেলের জলাধারে মাছেদের খাওয়ানো, সেটা এ বার করতে পারিনি।
আজ অবশ্য দিনটা একেবারে অ্যাকশন প্যাকড যাবে। নিজেদের ডেরায় পেয়ে চেন্নাই সুপার কিংসকে হারানো আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। তার জন্য নিজেদের সমস্ত শক্তি একজোট করে লড়ব। জানি দিনটা মঙ্গলবার। তবু আমি নিশ্চিত, কমকরে আশি হাজার মানুষ আমাদের হয়ে গলা ফাটাতে ইডেনে হাজির থাকবেন।
হে ভগবান! ইডেনের শব্দব্রহ্ম তো আম্পায়ারদের জন্য আরও বড় চ্যালেঞ্জ! তবে এ বার মাঠে যা-ই হোক না কেন, আবেগের রাশ শক্ত হাতে ধরে রাখব।
যতই হোক, এটা মেয়ের নায়ক হয়ে ওঠার প্রশ্ন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy