Advertisement
E-Paper

যতটুকু চিনি, সচিনের ইনিংস এখনও শেষ হয়নি

অঞ্জলি তেন্ডুলকরের বেস্ট ফ্রেন্ড এবং ব্যাচমেট। দু’জনই স্বর্ণপদক জয়ী চিকিৎসক। অধুনা বিশিষ্ট লেখিকাও। আজ সচিন তেন্ডুলকরের জন্মদিনে মুম্বই থেকে আনন্দবাজারের জন্য বিশেষ কলাম লিখলেন ডাঃ অপর্ণা শান্তানমসচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বহুদিনের। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের স্বামী। সেই সুবাদে আমার জামাইবাবু। আর আমি ওর শ্যালিকা। নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন আমাদের সম্পর্কটা ঠিক কেমন! সচিনের সঙ্গে অঞ্জলির পরিচয় আর পরিণয় পর্বের শুরুর বছরগুলোয় অবশ্য ওর সঙ্গে আমি আজকের মতো এতটা স্বচ্ছন্দ ছিলাম না। উল্টে সেই দিনগুলোয় সচিনকে নিয়ে একটা অদ্ভুুত দ্বৈত অনুভূতি কাজ করত। আমি ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট-পাগল এবং সচিন তেন্ডুলকরের ক্রিকেট প্রতিভার প্রেমে একেবারে হাবুডুবু ছিলাম। অন্য দিকে, সেই সচিনই আবার ব্যক্তিগত জীবনে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের বর! বুঝুন ব্যাপারখানা!

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৪ ০৪:০১
জন্মদিনের প্রস্তুতি। মোরাদাবাদে স্কুল ছাত্ররা। ছবি: পিটিআই।

জন্মদিনের প্রস্তুতি। মোরাদাবাদে স্কুল ছাত্ররা। ছবি: পিটিআই।

সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বহুদিনের। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের স্বামী। সেই সুবাদে আমার জামাইবাবু। আর আমি ওর শ্যালিকা। নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন আমাদের সম্পর্কটা ঠিক কেমন!

সচিনের সঙ্গে অঞ্জলির পরিচয় আর পরিণয় পর্বের শুরুর বছরগুলোয় অবশ্য ওর সঙ্গে আমি আজকের মতো এতটা স্বচ্ছন্দ ছিলাম না। উল্টে সেই দিনগুলোয় সচিনকে নিয়ে একটা অদ্ভুুত দ্বৈত অনুভূতি কাজ করত। আমি ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট-পাগল এবং সচিন তেন্ডুলকরের ক্রিকেট প্রতিভার প্রেমে একেবারে হাবুডুবু ছিলাম। অন্য দিকে, সেই সচিনই আবার ব্যক্তিগত জীবনে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের বর! বুঝুন ব্যাপারখানা!

মনে আছে, প্রথম প্রথম আমাদের সামনে সচিন বেশ অন্তর্মুখী থাকত। তবে বরাবরই ভীষণ অমায়িক। ওর সঙ্গে আমাদের দেখাও হত কম। সচিন ব্যস্ত থাকত ক্রিকেট ট্যুর আর খেলার সূচিতে। আমরাও তখন ডাক্তারি পাশ করার চ্যালেঞ্জ সামলাচ্ছি। সব মিলিয়ে একটা দূরত্ব থাকায় আমাদের জন্য জামাইবাবু সচিন যতটা না বাস্তব ছিল, তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল একটা কল্পনা!

তবে দূরত্বটা কমার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেট রূপকথার আড়ালের রক্তমাংসের মানুষটাকে চিনতে কিন্তু একদম সময় লাগেনি। সচিনের সরল জীবনদর্শন আর আদ্যপান্ত বিনয়ী স্বভাবটাই ওর বৈশিষ্ট। সাফল্যের সব থেকে উঁচু শৃঙ্গে রাজ্যপাট করার সময়েও যে মূল্যবোধগুলোকে এক মুহূর্তের জন্য কাছছাড়া করেনি।

বহু ব্যবহারে ‘জিনিয়াস’ শব্দটা আজকাল এতটাই ম্যাড়ম্যাড়ে যে সচিন সম্পর্কে ব্যবহার করতে গেলে মনে হয় যেন ইয়ার্কি মেরে অসম্মান করা হচ্ছে। এটা ঠিক যে ক্রিকেটার হওয়া সচিনের ভবিতব্য ছিল। কিন্তু সচিনের মতো পঁচিশ বছর ধরে এমন সাধনায় ডুবে থাকতে আর ক’জন পেরেছে? ক’জন পেরেছে পঁচিশ বছরে প্রতিদিন সেরাটা উজাড় করে দিয়ে নিজের ক্ষমতার প্রতি সুবিচার করতে? কঠিন পরিশ্রম ব্যাপারটায় সচিন শুধু বিশ্বাসই করে না, ও নিজেই মূর্তিমান ‘কঠিন পরিশ্রম’! যে কখনও নিজেকে কোনও ব্যাপারে এতটুকু ছাড় দেয় না।

সচিন বরাবরই একটু লাজুক। পাশাপাশি আশ্চর্য রকমের ফাজিল! তীক্ষ্ন আর দুষ্ট রসবোধে হাসাতে হাসাতে পেটে ব্যথা ধরিয়ে দেবে! শালি হওয়ার সুবিধে হল, আমার সামনে নিঃসংকোচে ফাজলামিগুলো করে। মনে আছে, একবার আমরা অঞ্জলির একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়েছি। জনা পঞ্চাশ অতিথির সবাই সচিনের সঙ্গে কথা বলতে মরিয়া। সচিন আবার যতটা সম্ভব গুটিয়েসুটিয়ে ঘরের এক কোণায় প্রায় লুকিয়ে বসে। ওর পাশে আমি। গল্প করতে করতে সচিন কবুল করল, এই ধরনের পারিবারিক জমায়েতে ও ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে। লজ্জায় চুপ মেরে যায়। কিন্তু লাজুক জামাইয়ের তত্ত্ব অতিথিরা কেন মানবে? তারা অন্তত এক বার ক্রিকেট মহানায়কের সঙ্গ চায়। প্রতি মুহূর্তেই কেউ না কেউ এসে আলাপ করছে বা কুশল জানতে চাইছে। আর সচিন একেবারে জ্যাক ইন দ্য বক্সের মতো তড়াক করে লাফিয়ে উঠে অ্যাটেনশনে দাঁড়িয়ে হাত মেলাচ্ছে, হাসছে, দু’চার কথা বলছে। বসতে না বসতে আবার কেউ হাজির। সচিনও ফের তড়াক করে সেই জ্যাক ইন দ্য বক্স!

এমন খানিক্ষণ চলার পর কাউকে এগোতে দেখলেই সচিন বলা শুরু করল লোকটা এসে ওকে ঠিক কী বলবে, কেমন ভঙ্গিতে বলবে। আর বিশ্বাস করুণ, প্রতিবার মিলিয়ে দিল! আমার তো হাসি চাপতে চাপতে বেদম অবস্থা। শেষে হেসে এমন গড়াগড়ি খেতে লাগলাম যে নিজেকে সামলাতে উঠে চলে যেতে হল। সচিন কিন্তু নিপাট ভালমানুষের মতো একই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলল, ওর অমায়িক আচরণে কোনও রকম হেলদোল ছাড়াই।

দেশে-বিদেশে সচিনের অবিশ্বাস্য ফ্যান-ফলোয়িং অনেকের কাছেই রীতিমতো গবেষণার বিষয়। কী রসায়নে কোটি কোটি মানুষের কাছে ও ভক্তের ভগবান, সেটা অনেকেই বুঝতে পারেন না। কিন্তু লোকে জানে না, অনুরাগীদের নিঃশর্ত ভালবাসার জবাব সচিনও ঠিক ততটাই ভালবাসায় ফিরিয়ে দেয়।

একটা সন্ধ্যার গল্প শোনাই। অঞ্জলি আর সচিন আমার বাড়িতে ডিনারে এসেছে। মিনিট দশেকের মধ্যে দেখলাম গোটা পাড়ায় পুরোদস্তুর সার্কাস বসে গিয়েছে। রাস্তায় থিকথিকে ভিড়। কোনও বাড়ির ছাদেও তিল ধারণের জায়গা নেই। উপচে পড়া সেই ভিড় আবার শুধু উঁকি-ঝুঁকিতেই খান্ত নয়। রীতিমতো ক্যামেরা বাগিয়ে ফটাফট শাটার টিপে যাচ্ছে। আমাদের তো মাথায় হাত! কী করা যায়? সমাধান শেষে সচিনই বের করল। লেন্স-ওয়ালাদের ফাঁকি দিতে ও ফ্ল্যাটের মেঝেয় হামাগুড়ি দিয়ে চলাফেরা শুরু করল! আড্ডা জমাল মাটিতে বসে। যাতে জানালার ফাঁক দিয়েও নাগাল পাওয়া না যায়।

ডিনার সেরে বেরোতো রাত একটা হল ওদের। কিন্তু গভীর রাতেও রাস্তার ভিড় সেই একই রকম। প্রত্যেকে অটোগ্রাফ চায়। অবাক হয়ে দেখলাম, সচিন হাসিমুখে প্রত্যেককে অটোগ্রাফ দিল। তার পরেও এক ভদ্রলোক সচিনের গাড়ির সামনে রাস্তায় আড়াআড়ি শুয়ে পড়লেন। সচিনকে কিছুতেই চলে যেতে দেবেন না। সচিন কিন্তু তাতেও এতটুকু বিরক্ত হল না। একবারের জন্যও না।

আজকাল সেলিব্রিটিরা দেখেছি ভক্তদের অনুরোধ রাখতে গিয়ে বুঝিয়ে দেন, তাঁর সময় নষ্ট হচ্ছে। সেখানে সচিনের আচরণ থেকেই পরিষ্কার, নিজের ভক্তদের ও কতটা ভালবাসে আর সম্মান করে। এবং এই সম্মানটা প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ, তিনি সমাজের যে স্তরেরই হোন না কেন।

ব্যক্তিগত জীবনে সচিনের জন্য পুরনো বন্ধুত্বগুলো ভীষণ দামি। পঁচিশ বছরে মানুষ হিসাবেও এতটুকু পাল্টায়নি। খ্যাতি আর সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেও সচিন আর অঞ্জলি একদম মাটির কাছের চরিত্র। এই মূল্যবোধ আর মানসিকতা নিজেদের দুই সন্তানের মধ্যেও চারিয়ে দিয়েছে ওরা। সারা আর অর্জুন নিজেদের সেলিব্রিটি বলে ভাবতেই শেখেনি। সচিন ওদের কাছে নিছকই ‘বাবা’। যাকে ওরা ভালবাসে, সম্মান করে। আবার কখনও কখনও আর পাঁচটা বাচ্চার মতো ঠোঁট উল্টে বলে বসে, “বাবা আবার এ সবের কী জানে!” সারা-অর্জুনের সঙ্গেই সচিন বোধহয় সবচেয়ে বেশি খোলামেলা। সারাক্ষণ পিছনে লাগছে, খুনসুটি করছে, রাগিয়ে মজা পাচ্ছে আবার প্রয়োজনে বকাঝকাও দিচ্ছে। বহির্বিশ্বে সচিনের যে অতিমানবিক ভাবমূর্তি, তার কোনও ছায়া ওদের দৈনন্দিন জীবনে নেই। অবাক হয়ে দেখি, কী স্বাভাবিক আর সুন্দর পরিবার!

অবসরের দিন সচিনের ভাষণটা শুনে কোটি কোটি ভারতবাসীর সঙ্গে আমিও কেঁদেছিলাম। আজ সচিন ভারতরত্ন! জীবনে এক জন মানুষ যা যা কামনা করতে পারে, সব পেয়েছে। আজ ও সুখী, সন্তুষ্ট। কিন্তু অবসরের পরেও একই রকমের উদ্যমে জীবনের নতুন অধ্যায়ের দিকে তাকিয়ে। জীবনের এই দ্বিতীয় ইনিংসটা সচিনের জন্য সম্ভবত প্রথমটার মতো অত অসাধারণ হবে না। ভাবলে মন খারাপ হয় যে, ভারতের জার্সিতে ওকে আর দেখতে পাব না। আমার এক বন্ধু বলে, সচিন নামটাতেই প্রত্যেক ভারতীয়ের মুখে হাসি ফোটে। আমিও মানি, আমাদের সময়ের একমাত্র সুপার হিরো সচিন। তাই আজ, ও যখন আরও এক বছর বয়স কমিয়ে ফেলার মুখে, তখন মনে হচ্ছে, অবিশ্বাস্য সব ক্রিকেটীয় কীর্তি সত্ত্বেও সচিনের সেরাটা বোধহয় আমরা এখনও দেখিনি। যতটুকু সচিনকে চিনি, ওর ইনিংস এখনও শেষ হয়নি!

হ্যাপি বার্থ ডে, সচিন!

dr aparna santhanam sachin birthday
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy