Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শ্রদ্ধার ফুলের সঙ্গে কটাক্ষের কাঁটাও রেখে গেলেন কপিল

কপিল দেব নিখাঞ্জকে জিজ্ঞেস করলে এত দিন পরেও নিঃসন্দেহে খামের রংটা বলে দিতে পারতেন! প্রচারের প্রাচুর্যের সঙ্গে যে খেলার বন্ধন আষ্টেপৃষ্টে, যে খেলায় মাঠে এক ঘণ্টার স্ফুলিঙ্গ ক্রীড়াবিদের জন্য সৃষ্টি করে দিতে পারে আজীবনের গৌরব, সেখানে একটা খামের আর কতটুকু জায়গা হওয়া উচিত ক্যাবিনেটে? কপিল দেব নিখাঞ্জ যে খেলাটা খেলতেন, বাইশ গজের পৃথিবীতে ষোলো বছর ধরে যে যে গর্বের চূড়ো আরোহণ করেছেন, ছোট খামটাকে ভুলে গেলেও কেউ কিছু বলত না। কী যায় আসে?

শহরে কপিলের পটৌডি-স্মারক বক্তৃতা। মঙ্গলবার।

শহরে কপিলের পটৌডি-স্মারক বক্তৃতা। মঙ্গলবার।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:৪৫
Share: Save:

কপিল দেব নিখাঞ্জকে জিজ্ঞেস করলে এত দিন পরেও নিঃসন্দেহে খামের রংটা বলে দিতে পারতেন!

প্রচারের প্রাচুর্যের সঙ্গে যে খেলার বন্ধন আষ্টেপৃষ্টে, যে খেলায় মাঠে এক ঘণ্টার স্ফুলিঙ্গ ক্রীড়াবিদের জন্য সৃষ্টি করে দিতে পারে আজীবনের গৌরব, সেখানে একটা খামের আর কতটুকু জায়গা হওয়া উচিত ক্যাবিনেটে? কপিল দেব নিখাঞ্জ যে খেলাটা খেলতেন, বাইশ গজের পৃথিবীতে ষোলো বছর ধরে যে যে গর্বের চূড়ো আরোহণ করেছেন, ছোট খামটাকে ভুলে গেলেও কেউ কিছু বলত না। কী যায় আসে?

কপিল দেব নিখাঞ্জের আজও যায় আসে। ভারতবর্ষের প্রথম বিশ্বজয়ী অধিনায়ক, দেশের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের তাজের মালিক হয়েও কপিল দেব নিখাঞ্জ ভুলতে পারেন না খামের মধ্যে রাখা চিঠির শব্দগুলো।

‘খেলাটা ছেড়ো না। কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো।’

ভারতীয় ক্রিকেটে টাইগার পটৌডির অবদান নিয়ে দু’টো বই লিখে ফেলতে পারবেন ক্রিকেট-লিখিয়েরা। সতীর্থদের ‘ভারতীয়’ হিসেবে মাঠে নামতে শেখানো, ভারতীয় ক্রিকেটে ক্যাপ্টেন শব্দের প্রথম চলমান উদাহরণ কম উল্লেখ্য তো নেই। কিন্তু মনসুর আলি খান পটৌডি তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের এক কিংবদন্তির কেরিয়ারটাও কয়েকটা শব্দে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন, মঙ্গলবার সন্ধের আগে ক’জন জানত? জানল, যখন আনন্দবাজার সংস্থার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার কপিলকে মঞ্চে ডাকলেন খামের কথাটা বলে।

’৮৪-’৮৫-তে টিম থেকে বাদ পড়ার পর কপিল দেব নিখাঞ্জ ঠিক করেছিলেন খেলাটাই ছেড়ে দেবেন!

“টাইগার বললেন, ক’টা দিন অপেক্ষা করো। পনেরোটা বছর তার পর অপেক্ষা করলাম,” কথাগুলো যখন মধ্য কলকাতার অভিজাত হোটেলের বলরুমে বলছিলেন দেশের প্রথম বিশ্বজয়ী অধিনায়ক, হাসি আর করতালি হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে পাশাপাশি পাঁচ মিনিট। কিন্তু বেঙ্গল ক্লাব ও দ্য টেলিগ্রাফের যৌথ উদ্যোগ এবং সহযোগী ওবেরয় গ্রুপের আয়োজনে অনুষ্ঠিত চতুর্থ পটৌডি স্মারক বক্তৃতায় এসে কপিল যেমন বিলিয়ার্ডস এবং স্নুকারে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পঙ্কজ আডবাণী সমেত উপস্থিতদের সামনে পূর্বসূরির প্রতি অসীম শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের ফুল ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন, যেমন মিনিটে-মিনিটে কৌতুক আমদানিতে বক্তৃতার পরিবেশ ভাবগম্ভীর হতে দিলেন না, তেমনই আবার কিছু সূক্ষ্ম কটাক্ষ কোথাও কোথাও নিপুণ ভাবে ছেড়ে রেখে গেলেন, যা নিয়ে ভবিষ্যতে আলোচনার মশলা থাকল।

গ্রেগ চ্যাপেল ভারতীয় ক্রিকেটে কতটা পূজনীয়, নতুন ব্যাখ্যার দরকার নেই। কপিলই প্রথম ভারতীয় যিনি এ দিন গ্রেগ-দর্শন প্রকাশ্যে সমর্থন করলেন। অর্থাত্‌, ভারতীয় ক্রিকেটে গ্রেগের আমদানি করা যুব-নীতির। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির প্রসঙ্গে তখন বলছিলেন কপিল। অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজের মাঝপথে ধোনির অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়ে। “এমএস একটা নতুন দর্শন আমদানি করল যে, তোমাকে সারা জীবন খেলে যেতে হবে তার কোনও মানে নেই। ও যখন বুঝল আর টানার মানে নেই, ঠিক তখনই সরে গেল। ওয়েল ডান ধোনি। ইউ আর মাই বয়,” কপিল যখন এত পর্যন্ত বলছিলেন, ঠিক ছিল। কিন্তু তার পর হঠাত্‌ই বলতে শুরু করেন, “গ্রেগ চ্যাপেল বলত যদি কোনও ক্রিকেটার সময়ে না ছেড়ে কেবল টেনেই যায়, তা হলে সে শুধু নিজেকে নয়, পরের তিনটে প্রজন্মকেও শেষ করে দেয়। ধোনি চাইলে একশোটা টেস্ট খেলতে পারত। কিন্তু করেনি।”

আপাতদৃষ্টিতে ধোনির প্রশংসা। কিন্তু অলক্ষ্যে নিশানা এক বেঁটেখাটো মরাঠি থেকে গেলেন না তো? অনুষ্ঠান শেষে প্রশ্নটা কিন্তু উঠল। কয়েক মাস আগে আত্মজীবনীতে কপিলকে খোঁচা দিয়েছেন মরাঠি। কপিল কি তা হলে মরাঠির এক নম্বর শত্রুর দর্শনকে মর্যাদা দিয়ে তাঁকে পাল্টা দিয়ে রাখলেন?

বিরাট কোহলি তিনিও সম্পূর্ণ নিস্তার পেলেন না। কপিল নিজের অধিনায়কত্বের দিনগুলো ব্যাখ্যা করছিলেন। বলছিলেন, অধিনায়ক হিসেবে চাইতেন প্রত্যেক পূর্বসূরির ভাল দিকগুলো নিতে। যেমন তাঁর প্রথম অধিনায়ক বিষেণ সিংহ বেদীর মাঠের বাইরের জীবনটা। যেখানে বেদী ছিলেন কপিল-বর্ণিত ‘টিপিক্যাল সর্দারজি’। মাঠের ভেতরের জীবনটা অনুকরণ করতে চাইতেন সুনীল গাওস্করের থেকে! “বেদীর মতো অত বড় হৃদয় ছিল না সুনীলের। কিন্তু ওর চিন্তাভাবনা দুর্দান্ত ছিল। এগুলোর সঙ্গে আমার নিজস্ব এগ্রিকালচারাল ব্যাপারটাকে মেশালাম! মাঠে প্রতিপক্ষকে সব রকম পাল্টা দেওয়ার ব্যাপারটা। কিন্তু তাই বলে বিরাট কোহলির মতো নয়। ও তো কেউ হ্যালো বলার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ে!”


শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে কপিল দেব। মঙ্গলবার।

অর্থাত্‌, খোঁচা।

মৃদু-মৃদু যা থাকল। যেমন কপিল মনে করেন ক্রিকেটে কোচ নয়, বেশি দরকার ম্যান ম্যানেজমেন্টের। মনে হয়, কোচ কাউকে ধরতে হলে ধরবেন গাওস্করকে। যিনি বলে দিতে পারবেন কপিল, ক্লোজ টু দ্য স্টাম্প রেখে যাও তো। তোমার আউটসুইঙ্গারগুলো ওখানে পড়লে খেলতে অসুবিধে হচ্ছে! ক্রিকেটীয় যোগসূত্র থাকবে, এমন কাউকে কপিল কোচ বলে মানবেন, বাকিদের নয়। ঠিক তেমনই কপিল মনে করেন, বোর্ড যদি তিন ফর্ম্যাটে তিন জনকে অধিনায়ক রাখে, দেশেরই ভাল। টেস্ট প্লেয়ারের পক্ষে টি-টোয়েন্টি ক্যাপ্টেন্সিতে দাপট দেখানো সম্ভব না-ও হতে পারে। কিন্তু টি-টোয়েন্টি ক্যাপ্টেনের পক্ষে দাপুটে টেস্ট অধিনায়ক হওয়া অসম্ভব।

কেন শ্রদ্ধার বেদীতে এমন কটাক্ষের কাঁটা? কে জানে, ষোলো বছরের ক্রিকেটজীবনে নানা রুক্ষতা সামলানো হয়তো একটা কারণ। কম তির্যক মন্তব্য হজম, অপমানে কম রক্তাক্ত তো তাঁকেও হতে হয়নি। টিমে ঢোকার সময় থেকে মুম্বই লবি তাঁকে ‘জে বি’ বলে ডেকেছে। সহজে, জাঠ বুদ্ধি! কপিল ভোলেননি। ভোলেননি, ভাল ইংরেজি না বলতে পারায় এক নির্বাচকের বলে ফেলা, ওকে কী ক্যাপ্টেন করবে? ইংরেজিটাই তো বলতে পারে না!

“উত্তরটাও দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, তা হলে অক্সফোর্ড থেকে কাউকে নিয়ে এসো। সে ইংরেজি বলবে। আমি ক্রিকেটটা খেলব,” আবার হাসি, আবার হাততালি। সেই যন্ত্রণা বোধহয় আজও আছে। রসিকতার সঙ্গে একটু-একটু সেগুলো মেশে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে বসে ক্যারিবিয়ান ইংরেজি ধরতে না পারার অকপট স্বীকারোক্তি যেমন পাওয়া যায়, বিন্দুমাত্র ইংরেজি না জেনে নিউজিল্যান্ডে বক্তৃতা দিয়ে দশ হাজার ডলার রোজগারের গল্প যেমন শোনা যায়, তেমন আবার উপস্থিতদের জন্য প্রশ্নও থাকে আপনাদের একঘেয়ে লাগছে না তো? উত্তরে না শুনে, “নিশ্চয়ই আমার ইংরেজি শুনে!”

আর এই মোহনাতেই বোধহয় দেখা হয় দুই প্রজন্মের দুই অধিনায়কের। দেখা হয় বিলেতে পড়া ছাত্রের সঙ্গে ‘জাঠ বুদ্ধির।’ কপিলের মতো টাইগার পটৌড যখন এক হরিয়ানভির ক্রিকেট দেখার জন্য মাইলের পর মাইল দৌড়ত আর এক হরিয়ানভি!

ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE