Advertisement
E-Paper

সাত গোলের লজ্জায় জ্বলে উঠল আগুন

হলুদের মহাসমুদ্র মনে হচ্ছিল এস্তাদিও মিনেইরোকে। খেলা সাতাশ-আঠাশ মিনিট গড়াতে না গড়াতে সেই সমুদ্রের কোনায় কোনায় দেখা গেল পলি পড়ে গিয়েছে। আসলে তখনই ০-৫ হয়ে গিয়েছে। আর সেই মর্মবেদনা সহ্য করতে না পেরে শত শত হলুদ জার্সি তখনই মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছেন! মারাকানায় সেই চৌষট্টি বছর আগের ক্ষতকে অ্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল মারাকানাজো। মারাকানার মর্মভেদী আঘাত। মঙ্গলবারের বেলো হরাইজন্তের কালো সন্ধেকে কী বলা হবে? মিনেইরোজো?

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৪ ০৪:০৫
দুর্গ ধূলিসাৎ। রক্ষকও ভেঙে পড়েছেন হতাশায়। ব্রাজিলের গোলকিপার জুলিও সিজার। ছবি: উৎপল সরকার

দুর্গ ধূলিসাৎ। রক্ষকও ভেঙে পড়েছেন হতাশায়। ব্রাজিলের গোলকিপার জুলিও সিজার। ছবি: উৎপল সরকার

হলুদের মহাসমুদ্র মনে হচ্ছিল এস্তাদিও মিনেইরোকে। খেলা সাতাশ-আঠাশ মিনিট গড়াতে না গড়াতে সেই সমুদ্রের কোনায় কোনায় দেখা গেল পলি পড়ে গিয়েছে। আসলে তখনই ০-৫ হয়ে গিয়েছে। আর সেই মর্মবেদনা সহ্য করতে না পেরে শত শত হলুদ জার্সি তখনই মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছেন!

মারাকানায় সেই চৌষট্টি বছর আগের ক্ষতকে অ্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল মারাকানাজো। মারাকানার মর্মভেদী আঘাত। মঙ্গলবারের বেলো হরাইজন্তের কালো সন্ধেকে কী বলা হবে? মিনেইরোজো?

কিছু ভাবাই যাচ্ছে না! উনিশশো পঞ্চাশের ম্যাচটায় তো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ফুটবল হয়েছিল। প্রথমে এগিয়েও ব্রাজিল হেরেছিল ১-২। আজকেরটা তো হার নয়। পেলে-সহ ব্রাজিলীয় ফুটবলের একরাশ মহারথীর সামনে ব্রাজিল ফুটবলের বস্ত্রহরণ! ব্রাজিলে ফুটবল খেলার প্রতিষ্ঠা মোহনবাগান ক্লাব জন্ম নেওয়ার ঠিক পাঁচ বছর বাদে ১৮৯৪-এ। তা একশো কুড়ি বছরের ফুটবল-ইতিহাসে এত বড় লজ্জার দিন আসেনি! বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের ইতিহাসে এত গোল আর কোনও টিমকে হজম করতে হয়নি! সময়-সময় মনে হচ্ছিল ভারত বুঝি খেলছে জার্মানির সঙ্গে!

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্রাজিলীয় কোচের মনোভাব। টিম নিঃশেষিত। বন্যার মতো জার্মান আক্রমণ উঠছে দেখেও তিনি স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইলেন। ০-৫ পিছিয়েও কোনও টিম একটাও প্লেয়ার বদলায় না, কেউ দুঃস্বপ্নেও কখনও দেখেছে! এ দিনের বিহ্বল করে দেওয়া ব্রাজিল সেটাই দেখাল!

অবিশ্বাস্য যেমন ফলটা, তেমনই অবিশ্বাস্য গোল হওয়ার ভঙ্গিগুলো। বিশ্ব ক্লাব পর্যায়েও এখন পাঁচ-ছয় গোল হয়েই থাকে। বায়ার্ন থেকে রিয়াল সবাই গোল খায়। কিন্তু ব্রাজিল যে ভঙ্গিতে খেল, বিশ্বকাপ ইতিহাসে এমন অসহায়তা কোনও সুপার-পাওয়ার কখনও দেখিয়েছে কি না সন্দেহ।

প্রথম গোল কর্নার থেকে ফাঁকায় দাঁড়ানো টমাস মুলার হালকা ভলিতে করে গেলেন! আচ্ছা টমাস মুলার যদি এমনি কারও নাম হয়, আর সে ফুটবল খেলে তা হলেও লোকে সম্ভ্রমে তাকে মার্ক করবে। আর ইনি তো আসল টমাস মুলার! তাঁকে কেউ কর্নার হওয়ার সময় ফাঁকা ছেড়ে দেয়?

এর পর মিরোস্লাভ ক্লোসে যখন তাঁর বিশ্বরেকর্ডটা করে গেলেন, তাঁর আশেপাশে অন্তত তিনটে হলুদ জার্সি। তাতেও তিনি শটের সুযোগ পেলেন। সেটা জুলিও সিজার আটকালেন। আবার ফিরতি বলে ক্লোজে মেরে দিলেন। সেই যে দু’গোল হয়ে গেল, তার পর থেকে এটা যে বিশ্বকাপ ম্যাচ হচ্ছে বোঝার কোনও উপায় ছিল না। ল্যাপটপে কম্পোজ করতে করতেও ভাবছি, কেউ কোনও মাদক-টাদক খাইয়ে দেয়নি তো! সত্যিই ব্রাজিলকে দেখলাম প্রেসবক্সের সামনের দিকের পোস্টে পাঁচ গোল খেতে! ব্রাজিল তো, যারা ১১ থেকে ২৯ মিনিটের মধ্যে পাঁচ গোল খেয়ে গেল!

ব্রাজিল দেশের মাঠে উনচল্লিশ বছর পর প্রথম কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ম্যাচ হারল, এটা তো একটা হিসেব। আসল হিসেব হল, বিশ্বকাপের চুরাশি বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ফল এ দিন ঘটে গেল! ফ্রেড বলেছিলেন, এ বার দেশবাসীর মারাকানার ঘা মুছিয়ে দেবেন। তা তাঁরা এমন ফুটবল খেললেন যে, আধুনিক ব্রাজিলীয় প্রজন্মেরও নতুন ঘা হয়ে গেল। তারা যত দিন বাঁচবে, জার্মানদের কাছে হেনস্থা হওয়ার এই মলিন ইতিহাস নিয়ে বাকি জীবন কাটাবে!

খেলা শুরুর আগে দুই বিশ্ববিখ্যাত কোচের সঙ্গে মিডিয়া সেন্টারে দেখা হল। আর্সেন ওয়েঙ্গার আর বোরা মিলুটেনোভিচ। ম্যাচে কী হবে? দু’জনের কেউই পূর্বাভাসে গেলেন না। জমবে খুব, বলে ওয়েঙ্গার চলে গেলেন টিভি বক্সের দিকে।

গোটা পৃথিবীও তাই জানত, যে-ই হারুক, যে-ই জিতুক, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হবে। নেইমারের জার্সি নিয়ে মাঠে এসেছে গোটা টিম। বাসে নেইমার লেখা ফেট্টি বেঁধে সবাই নামছে। খেলার আগে দি’স্তেফানোর মতো বড় ফুটবলারের প্রয়াণে এক মিনিট নীরবতা পালনের ব্যবস্থা নেই, অথচ নেইমারের দশ নম্বর জার্সি হাতে নিয়ে দাভিদ লুইজ জাতীয় সঙ্গীতের সময় দাঁড়িয়ে!

এমন বল্গাহীন আবেগ কে কোথায় বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে দেখেছে। আর এই অতিরিক্ত আবেগেই ব্রাজিল ধ্বংস হয়ে গেল কি না, এ বার তার ময়নাতদন্ত বহু বছর চলবে। বিশ্বকাপ পাওয়ার সবচেয়ে বড় দাবিদার আঠারো মিনিটে পাঁচ গোল খেতে পারে, জীবনে কেউ ভেবেছে!

সবচেয়ে আশ্চর্য আবার লাগছে, গোলগুলো হওয়ার ভঙ্গিতে। নিজেদের মধ্যে ছ’টা-সাতটা পাস খেলে বিপক্ষ চলে যাচ্ছে। বিনা বাধায় গোল করে আসছে। আর হলুদ জার্সি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। দাভিদ লুইজ গোটা টুর্নামেন্ট এত ভাল খেলে ব্রাজিলীয় ফুটবলের সবচেয়ে নারকীয় ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেন! স্কোলারির তো চাকরি যাবেই। লুইজকে জনতা কী ভাবে আগামী ক’দিন নেয়, সেটা দেখার।

দাঁতেকে নেওয়া হয়েছিল বুন্দেশলিগার অভিজ্ঞতার জন্য। তাঁকে একটা ট্যাকলেও পাওয়া যায়নি। মার্সেলো ওভারল্যাপেই থাকছিলেন যেন ডিফেন্স করাটা তাঁর কাজের মধ্যে পড়ে না। ফার্নান্দিনহো দু’টো গোল খাওয়ালেন। আর এত সব যখন হচ্ছে, দাভিদ লুইজ ডুবন্ত জাহাজ ছেড়ে দেওয়া ক্যাপ্টেনের মতো হঠাৎ ম্যাচ থেকে হারিয়ে গেলেন। মাঝমাঠে যে কোনও মার্কার নেই। ফ্রেড যে অচল, প্রথম ম্যাচ থেকে আন্তর্জাতিক মিডিয়া লিখছে। স্কোলারি তাতে কর্ণপাত করেননি। ঐতিহাসিক এত বড় মাসুল তাই তাঁকে দিয়ে যেতে হল। যত দিন বাঁচবেন, সাত গোল খাওয়া জুলিও সিজার আর তাঁকে দিয়ে যেতে হবে!

ব্রাজিলীয় সমর্থকেরা অতুলনীয়। যাঁরা বেরিয়ে গেলেন, বেরিয়ে গেলেন। বাকিরা ০-৫-এর পরেও চিৎকার করে যাচ্ছিলেন ব্রাজিল, ব্রাজিল বলে। জার্মানি ছয় গোল করে ফেলার পর প্রথম দেখলাম তাঁদেরও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে। ব্রাজিল ফুটবলে শতাব্দীর কালো সন্ধে চলাকালীন স্কোলারি অবশেষে তিনটে পরিবর্তন করেছেন। তাতে কাজের মধ্যে ম্যানুয়েল নয়্যারকে ওয়ান টু ওয়ানে দু’টো দারুণ গোল বাঁচাতে হল, ওই অবধি।

ব্রাজিলের পরবর্তী প্রজন্ম যখন চিরদিন অবিশ্বাসীর মতো এই সাত গোলের ম্যাচের দিকে তাকাবে, তখন তারা হয়তো বুঝতেও চাইবে না ম্যাচের শুরুতে আক্রমণ করছিল ব্রাজিলই। একটা কর্নারও দ্বিতীয় মিনিটে জোগাড় করেছিল। কিন্তু জেরোম বোয়াতেংয়ের নেতৃত্বে এমন অসাধারণ তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যে ঠিক শাটার টেনে দিতে পারে। আর ডিফেন্ডাররা কখনও প্যারালাল লাইনে যায় না!

বোয়াতেংয়ের নাম গোলকারীদের তালিকায় নেই। কিন্তু কেউ জানে না প্রথম দশ মিনিটে ব্রাজিল গোল পেয়ে গেলে অন্তত কিছুটা লড়াই হত কি না!

মারাকানাও ব্রাজিলের ফুটবল জীবনে এত অভিশাপ বয়ে আনেনি যা আনল এস্তাদিও মিনেইরো। যত দিন ফুটবল থাকবে, তত দিন পেলের হাজার গোল। তাদের পাঁচ বারের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি এই সাত গোলের লজ্জাটাও থাকবে! বেরোনোর মুখে এক স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে দেখা হল। যে ম্লান মুখে কাঁদছে আর বলছে, হে ঈশ্বর সে দিন চিলিকে জিতিয়ে দিলে না কেন!

পুনশ্চ: গ্যালারিতে কান্নার রোল আর যেন স্বপ্নের চিতা জ্বলছে! দাভিদ লুইজ এই বেরিয়ে যাচ্ছেন কাঁদতে কাঁদতে একরাশ বিদ্রূপের মধ্যে। অস্কারের নব্বই মিনিটে করা ১-৭-এ কোনও প্রলেপ পড়েনি। টিভিতে শুনছি, অ্যালান শিয়েরার বলছেন, এই টিমটা বাকি জীবন এর থেকে কী ভাবে উঠে দাঁড়াবে জানি না!

fifaworldcup gautam bhattacharya brazil germany
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy