ব্রেকফাস্ট টেবিলে শুক্রবার রবি শাস্ত্রীকে চেঁচিয়ে ডাকলেন জাহির আব্বাস, “ওহে শোনো, বব উলমার কীসে মারা গিয়েছে, আমি এত দিনে বার করে ফেলেছি।” প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা না করে জাহির নিজেই উত্তরটা দিয়ে দিলেন, “স্রেফ টেনশনে। টিমের দায়িত্বে থাকার সময়ে জীবনে এই রকম এক-একটা ইন্ডিয়া ম্যাচ এলে তো ভাই হার্ট এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।”
রোহিত শর্মা-শিখর ধবন ওপেনিং জুড়িতেই যখন পঞ্চাশের ওপর উঠে গেল, তখন ভাবছিলাম যাক, জাহিরের হার্ট অন্তত এ দিন নিষ্কৃতি পেল। মনে হয় না আজ তাঁর ওপর বাড়তি চাপ পড়ার কথা। চাপ তো তখন হয়, যখন একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাপার থাকে। এ তো ভারত-পাক টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে সর্বকালের সবচেয়ে একপেশে ম্যাচটা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ভারত দশ উইকেটে জিতলেও আশ্চর্য হওয়ার ছিল না। বারো ওভারে রানটা তুলে দিলেও না। আঠারো দিন আগে এ মাঠেই আফ্রিদির জোড়া ছক্কার বদলা তারা সুদসমেত ছিনিয়ে নিল।
পাকিস্তানের এমন সার্বিক হারের পরেও নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই যে, এ মাঠেই তৃতীয় সাক্ষাৎ বাকি থেকে গেল কি না। কে বলতে পারে, হপ্তাদুয়েকের মধ্যে সেটা ফাইনালেই ঘটবে না?
কারণটায় আসছি। তার আগে বলি, গুলশন হল আভিজাত্যে ঢাকার আলিপুর! সেখানকার এক কোরীয় রেস্তোরাঁ এত সাড়া ফেলেছে যে, কলকাতা থেকে অনেক ভোজনবিলাসী স্রেফ উইকএন্ডে ওখানে খেতে আসেন। ভারতীয় ক্রিকেটাররাও সে দিন আধ ঘণ্টার রাস্তা উজিয়ে গিয়েছিলেন ‘কোরিয়ানা’ নামের সেই রেস্তোরাঁয়। সোনারগাঁও থেকে গুলশন— ট্র্যাফিকে এতটা সময় চলে যাওয়ায় দ্বিতীয় দিন যাওয়া হচ্ছে না বলে অশ্বিনরা আক্ষেপ করছিলেন। এমনিতে অবশ্য এ দেশে ভোজনপ্রেমীদের আক্ষেপের কোনও কারণ থাকা উচিত নয়। ঢাকা শহরে ইলিশের জন্য ‘কস্তুরী’। খিচুড়ির জন্য ‘ঘরোয়া’। বিরিয়ানির জন্য ‘ফকরুদ্দিন’। লাজানিয়ার জন্য ‘শেরাটন’। পালং চিংড়ির জন্য ‘ময়ূরী’। বাংলাদেশের অন্য সব শহরেও জিভে জল এসে যাবে, এমন ইনস্ট্যান্ট বন্দোবস্ত। সিলেটের বিখ্যাত সাতকারা আচার। নাটোরের কাঁচাগোল্লা। টাঙ্গাইলের চমচম। আর বগুড়ার দই।
রানের জন্য মরিয়া। শুক্রবার ঢাকায় শিখর ধবন।
সমস্যা হল, বাংলাদেশের খাবারে যত বৈচিত্র, ক্রিকেট উইকেটে ঠিক ততটাই বৈচিত্রের অভাব। মাস্টারদা’র শহর থেকে শেখ মুজিবের কর্মভূমি সব ক্রিকেট পিচই যেন একটা আর একটার ফটোকপি। স্লো, নিচু হয়, স্পিন করে। মিরপুরেরটা একই ছাঁচে। কেবল আরও আঠার মতো। অনেকটা ঢাকার ট্র্যাফিক। বল নড়ে আর না। ওই যানজটে আপনাকে যেমন নিজে বেরিয়ে চেষ্টাচরিত্র করতে হয় বা ধৈর্য ধরতে হয় গাড়িতে ঠায় বসে, এখানেও তাই। ব্যাটসম্যানকে রান ধারণের জন্য হয় উইকেট ছেড়ে বেরোতে হবে। বা শেষ অবধি বলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
গত বারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর এই অ্যাসেজজয়ী উদ্দীপ্ত অস্ট্রেলিয়া দু’টোই তুখোড় টিম। কিন্তু মিরপুরের এমন চটচটে স্পিনিং পিচে ঘূর্ণিজাল কেটে বেরোতে পারবে? স্পিন খেলতে এত অভ্যস্ত পাকিস্তানকেই তো ঘূর্ণি-ফাঁসে আটকে দিতে পারল ভারত! তিন ভারতীয় স্পিনার ৩৩ ডট বল-সহ তিন উইকেট নিলেন। শুধু এই পরিসংখ্যানেই গোটা ম্যাচের ছবি প্রতিফলিত। আর যেটা এতে বোঝা যাচ্ছে না দারুণ অধিনায়কত্ব করলেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। গত ক’দিন খুব চর্চা হচ্ছিল যে, তাঁর শরীরী ভাষা সাম্প্রতিক বিতর্কে কিছুটা বিক্ষত হয়ে গিয়েছে। আগের সেই অচঞ্চল ভাবটা নেই। মাঠে দেখে মনে হল, জল্পনা। এবং দ্রুত ট্র্যাশে পাঠানোর মতো। অবিকল এই ম্যাচটাই। কোহলি ক্যাপ্টেন। এক ফল হত কি না, নিশ্চিত হতে পারছি না। উইকেটটা চমৎকার বুঝে সেই অনুযায়ী স্ট্র্যাটেজি সাজিয়েছিলেন ধোনি। অশ্বিনকে দিয়ে বোলিং ওপেন করানোই শুধু নয়। প্রত্যেক বোলারকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ব্যবহার করেছেন। পাকিস্তান ব্যাটিংয়ের ওপর এমন একটা স্পিন সম্মোহন জারি রেখেছিলেন যে, তারা বেরোবার রাস্তাই খুঁজে পায়নি। মালিক বা আফ্রিদির মতো কেউ কেউ উদ্ধত মারের রাস্তা বাছতে গিয়েছেন। কিন্তু এত চটচটে সারফেসে তাতে কোনও জীবনবিমা সম্ভব নয়।
স্টার স্পোর্টস টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের যে প্রোমো নিয়মিত দেখায়, তাতে এক ওভারই খেলার গতি ঘুরিয়ে দেয়। যা থেকে তাদের বিজ্ঞাপনী স্লোগান— ‘দুনিয়া বদলেগি বস এক ওভার মে’। শুক্রবারে এমন অমিত-গুরুত্বপূর্ণ কোনও ওভারের খোঁজ পাওয়া যায়নি। বরং দুনিয়া বদলেছে পুরো পাক ইনিংসে। কে বলে টি-টোয়েন্টি নিছক মারদাঙ্গার খেলা? কোনও শিল্প নেই, কোনও ভাবনা নেই, কোনও স্ট্র্যাটেজি নেই? অন্তত প্রথম দশ ওভারেই ধোনি যে ভাবে বোলার ও ফিল্ড বদলে বদলে যাচ্ছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল টেস্ট ক্রিকেটের আস্ত দু’টো সেশনেও এত মগজাস্ত্র চালাতে হয় না। অশ্বিনকে প্রথম ওভারে নিযুক্ত করা থেকে অমিত মিশ্রকে দ্রুত দিক বদলানো— এত কৌশলী ছিল ভারতীয় ছক যে পাকিস্তান আপ্রাণ চেষ্টাতেও বড় রানের রেসিপি যে তুফানি ছন্দ, সেটাই তৈরি করতে পারল না।
পাক-বধের অন্যতম কারিগর মহম্মদ শামি। উমর আকমলকে আউট করে। শুক্রবার ঢাকায়।
সকাল থেকেই ক্রিকেটমহলে জল্পনা চলছে, ম্যাচ কোন দিকে যেতে পারে? এরই মধ্যে বিখ্যাত টিভি ভাষ্যকার খবর আনলেন, ডানকান ফ্লেচারকে নাকি সকালে প্রকাশ্যে হাসতে দেখা গিয়েছে। ফ্লেচারের হাসি এতটাই ব্যতিক্রমী ব্যাপার যে দ্রুত প্রাক্তন ক্রিকেটারদের মধ্যে জল্পনা শুরু হয়ে গেল, ম্যাচে তা বাড়তি কোনও ইঙ্গিতবাহী হবে কি না? যেমন প্রমীলার বামেতর নয়ন নাচিয়াছিল! শেষ পর্যন্ত অবশ্য ভারতীয় কোচের হাসি কোনও ওলট-পালট বয়ে আনেনি। বরঞ্চ অধুনা বলিউডের এক নম্বর গায়ক অরিজিৎ সিংহ আজ ঢাকার অন্য প্রান্তে নিজের অনুষ্ঠানে শ্রোতার সবচেয়ে ফরমায়েশি ‘হম তেরে বিন অব রহে নহি সকতে’ গাইবার আগেই পাকিস্তান ম্যাচ থেকে এক রকম বিদায় নিয়েছে। তারা তখনই শরশয্যায়। আর শোয়েব আখতার বিড়বিড় করছেন মিডিয়া সেন্টারে, “আমাদের ব্যাটিং! জীবনে শোধরাবে না! আগে ব্যাট করলে যা, পরে নামলেও তাই।” শুনতে শুনতে মনে পড়ল শাহিদ আফ্রিদি টিভি বিশ্লেষক শোয়েবের নামকরণ করেছেন, ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড। “আমি রান পেলেই ও ডক্টর জেকিল হয়ে যায়। আর রান না পেলে ভোল বদলে যা-তা বলে। তখন শোয়েবকে আমি বলি মিস্টার হাইড।”
ভারতীয় ইনিংস যখন ১৩১ রানের লক্ষ্যে শুরু হচ্ছে, একটা টুইট নজরে পড়ল। ‘বিরাট আছে। বাকিরা ৩১ রান করলেই চলবে।’ কোহলির অবশ্য সেঞ্চুরির সুযোগ ছিল না। অপরাজিত ৩৬ থেকে গেলেন তিনি। আর সেটাই কি না ম্যাচের সর্বোচ্চ স্কোর। অসম্ভব তৃপ্ত দেখাল বিরাটকে। এই মাঠে তাঁর একটা ব্যক্তিগত জ্বালা জুড়োনোর ব্যাপার ছিল যে! সুরেশ রায়না তিনটে ক্যাচ আর অপরাজিত ৩৫। এই টুর্নামেন্টটা তাঁরও জ্বালা জুড়নোর সফর যে, বেশ বোঝা যাচ্ছে। যুবরাজ সিংহের একমাত্র চূড়ান্ত খারাপ গেল! ১ রান, একটা ক্যাচ মিস, এক ওভারে ১৩ রান। তাঁর অপেক্ষা থাকবে পরের কোনও ম্যাচের জন্য।
পাকিস্তানের বিশ্বকাপ-অপেক্ষা অবশ্য কবে কাটবে, কেউ জানে না। টানা বাইশ বছর ধরে তারা বিশ্বকাপে ভারতকে হারাতে পারেনি। ভুল লিখলাম। পঞ্চাশ বা কুড়ি ওভার, কোনও ফর্ম্যাটেই ভারতকে কখনও ওয়ার্ল্ড কাপে হারাতে পারেনি। বেশ কিছু সমর্থক এ দিন মিরপুরে হাফিজের টিমের জন্য ছিল। ফেরার সময় তারাই তীব্র শোরগোল তুলল টিম বাসের কাছে। ভুয়া ভুয়া। এটা এখানকার ক্রীড়াদর্শকের জনপ্রিয় গালাগালি। প্রথমে শুনলে মনে হয় বুয়া বুয়া। আসলে ভুয়া ভুয়া। কলকাত্তাইয়া বাংলায় ভুয়ো। মেকি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভক্ত অবশ্য বলবে, বিশ্বকাপ চোকার। যারা ভারতকে এই টুর্নামেন্টে সামনে পেলেই ঘাবড়ে যায়। আচ্ছা আফ্রিদির ছক্কাগুলোও কি ভুয়া? নইলে আঠারো দিনে এ ভাবে রেশ মিলিয়ে যাবে কেন?
পাকিস্তান
কামরান রান আউট ৮
শেহজাদ স্টাঃ ধোনি বো অমিত ২২
হাফিজ ক ভুবনেশ্বর বো জাডেজা ১৫
উমর ক রায়না বো শামি ৩৩
শোয়েব ক রায়না বো অমিত ১৮
আফ্রিদি ক রায়না বো ভুবনেশ্বর ৮
মাকসুদ রান আউট ২১
ভাট্টি নঃআঃ ০
অতিরিক্ত ৫
মোট ২০ ওভারে ১৩০-৭।
পতন: ৯, ৪৪, ৪৭, ৯৭, ১০৩, ১১৪, ১৩০।
বোলিং: অশ্বিন ৪-০-২৩-০, ভুবনেশ্বর ৩-০-২১-১, শামি ৪-০-৩১-১,
অমিত ৪-১-২২-২, জাডেজা ৪-০-১৮-১, যুবরাজ ১-০-১৩-০।
ভারত
রোহিত বো আজমল ২৪
ধবন ক আজমল বো গুল ৩০
কোহলি নট আউট ৩৬
যুবরাজ বো ভাট্টি ১
রায়না নট আউট ৩৫
অতিরিক্ত ৫, মোট ১৮.৩ ওভারে ১৩১-৩।
পতন: ৫৪, ৬৪, ৬৫।
বোলিং: হাফিজ ৩-০-১৪-০, জুনেইদ ৩-০-২৩-০, আজমল ৪-০-১৮-১,
গুল ৩.৩-০-৩৫-১, আফ্রিদি ৩-০-২৪-০, ভাট্টি ২-০-১৭-১।
ছবি: এএফপি।