E-Paper

রিক্ত হওয়ার দৌড়

কোনও মেয়ে বলবে, “আগে লিখতাম ভালোবাসা। ছেলেকে পড়াতে গিয়ে জানলাম, ও-কার নেই। ভালবাসা নতুন করে শিখলাম।”

ঈশানী দত্ত রায়

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:২৩
উড়ান: বিশ্বকাপ জয়ের পর অধিনায়ক হরমনপ্রীত কউরের উচ্ছ্বাস। ২ নভেম্বর।

উড়ান: বিশ্বকাপ জয়ের পর অধিনায়ক হরমনপ্রীত কউরের উচ্ছ্বাস। ২ নভেম্বর। ছবি: রয়টার্স।

আমার সকল হৃদয় উধাও হবে’—

কোথায়?

কবি লিখেছেন, ‘তারার মাঝে, যেখানে ওই আঁধারবীণায় আলো বাজে।’

এত শান্ত, সব ছেড়ে দেওয়ার গান, যেখানে বাতায়নে দীপ জ্বালানোর আর প্রয়োজন নেই। আছে শুধু অপেক্ষা। সকল পথ খোঁজা যখন সারা হয়, শেষের অপেক্ষাই থাকে শুধু, কিন্তু তা নিয়ে কোনও উচাটন নেই, নেই দুঃখ— আছে শুধু নিজেকে ছেড়ে দেওয়া আর শান্ত অপেক্ষা।

ওই যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নামের মানুষটি কী আশ্চর্য কারুণ্যে গাইলেন ‘আমার সকল হৃদয় উধাও হবে’, সব অভিমান-টভিমান ঝেড়ে ফেলে সে টুপ করে বসে পড়ল ডিসেম্বরের সন্ধেয়, যেখানে মনখারাপই সূর্যাস্তের মতো সত্য, সব ভুল বোঝা মিটিয়ে ফেলার আকুলতা। তার পরেই প্রশান্তি। জয়ের পর মুহূর্তের জন্য নিজের মুখোমুখি হওয়ার মতো একা। কী থাকে সেখানে?

হাতের মুঠোয় বলটা ধরে যখন পাখির মতো ডানা ছড়িয়ে দৌড় দিলেন হরমনপ্রীত কউর, হাতে ধরা অদৃশ্য বিশ্বকাপ এবং অসংখ্য লাঞ্ছনা। তার পর? সতীর্থদের আলিঙ্গনের পর চিত্রসাংবাদিকের ক্যামেরায় ধরা পড়া একটা মুহূর্তই সেই সত্য। গ্যালারিতে অসংখ্য মোবাইল টর্চের আলো তারার মতো ফুটে আছে আকাশের গায়ে, আর হরমনপ্রীত মাটির দিকে তাকিয়ে, আত্মমগ্ন, কিছুটা বা বিষণ্ণ। পরাজয়ের মতো জয়েরও নিজস্ব বেদনার মুহূর্ত থাকে, উৎসবের পর রিক্ততার মতো, ‘যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী’র মতো। আর একটা এমন রাত হয়তো আসবে আবার। কিন্তু এমনই আর হবে না। এই যার জন্য তুমি এত কষ্ট করেছ, এত বিদ্রুপ, অপমান, লাঞ্ছনা, সব ছাপিয়ে জয়, আর জয় মানেই আর একটা জয়ের আগে মধ্যবর্তী এক শূন্যতা, সদ্য কাটা ধানের খেতের মতো। সেখানে আবার কর্ষণ, যন্ত্রণা, অনেকটা দীর্ঘ দৌড়, আবার কিছু, হয়তো কিছুই নয়। মধ্যবর্তী সেই সব প্রহর যা বছরের পর বছর বুনে যায়।

ভিনসেন্ট ভ্যান গখ ভাই থিয়োকে যেমন লিখছেন, আজ তিনি ছোট চিঠি লিখছেন, কারণ আজ আর একটি ক্যানভাসে তিনি আঁকবেন। কখনও লিখছেন, কয়েকটা স্ট্রোকের মাধ্যমে কী করে একটা অবয়ব আঁকা যায়, এখনও তা আঁকা আমাকে শিখতে হবে। পুরো শীত জুড়ে এই নিয়ে থাকব, এক বার শিখে গেলে বুলেভার্ডে মানুষ হেঁটে বেড়াচ্ছে, রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আঁকতে পারব। তাঁর মতো কে জানে গমখেতের প্রাচুর্য আর রিক্ততা?

সেই রিক্ত হওয়ার জন্যই হয়তো আমাদের দৌড়। হরমনপ্রীতের মতো যে দৌড় আমরা মনে মনে সক্কলে এক দিন না এক দিন দৌড়তে চাই, ছড়ানো দু’হাতে কেটে যাওয়া বাতাস সব অপমান, ব্যঙ্গ, ব্যর্থতা, আমাদের সব প্রতিকূলতা পিছনে ছুড়ে দিচ্ছে আর আমরা দৌড়চ্ছি। আর তার পর আমরা নিজের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছি— যেখানে জয় নেই, পরাজয় নেই। আছে পূর্ণতা, আছে রিক্ততা। সমরেশ মজুমদারের দৌড় উপন্যাসের চিত্ররূপে নায়ক রাকেশের শয্যাবন্দি প্রেমিকা (অভিনয়ে মহুয়া রায়চৌধুরী) স্বপ্নে দু’হাতের ক্রাচ ছুড়ে দিয়ে দৌড়ে বেড়ান সমুদ্রসৈকতে, ‘হারে রে রে রে রে, আমায় ছেড়ে দে রে, দে রে’-র সঙ্গে। সেই মেঘের মধ্যে মিশে যাচ্ছে দু’টি ক্রাচ, আর হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছেন মহুয়া।

একক মায়ের লড়াই, নিজের পায়ের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কোণঠাসা উইনস্টন গ্রুমের উপন্যাসের নায়ক ফরেস্ট গাম্প দৌড়তে শুরু করেছিল স্কুলে মারধর থেকে বাঁচতে। পরিবার, যুদ্ধ, ভিয়েতনাম সব পার করে দৌড়বীর হয়ে ওঠা ফরেস্ট বলেছিল, “কোনও কারণ ছিল না। একটুখানিক দৌড়ব ভেবেছিলাম, রাস্তার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত দৌড়লাম, তার পর ভাবলাম আর একটু দৌড়ই না কেন— তখন শহরের শেষ পর্যন্ত দৌড়লাম, তার পর ভাবলাম তা হলে গ্রিনবো কাউন্টিটা পুরো দৌড়ে নিই না কেন, এই ভাবে আলাবামা স্টেট এ ফালা-ও ফালা করে ফেলা দৌড়ে, একটি জায়গায় পৌঁছে আবার দৌড়ে যাওয়া আর এক প্রান্তে।”

সবুজ ময়দান, তবে কাছে গেলে এবড়োখেবড়ো, ধুলো ভরা। সেখানেই বালককে বলা হল দৌড়ো যেমন খুশি। সে দৌড়য় পায়রার ঝাঁকের পিছনে পিছনে। রেস-এ জেতার মতো দৌড় নয়, শেষের লাল ফিতে সকলের আগে ছোঁয়ার মতো উদগ্র খিদে থেকে জ্যা মুক্ত তিরের মতো তো নয়ই, বরং খানিকটা ল্যাগবেগে, এঁকেবেঁকে, কিছুটা ঢলঢলে হাতে। সে জেতার মতো দৌড়তে পারে না, সে দৌড়তে শেখেইনি সে ভাবে, তার মাঠ নেই। হয়তো তার মন পড়ে ফুটবলে, মাটিতে ‘কোন’ কাটিয়ে কাটিয়ে ড্রিবলিংয়ের প্রথম পাঠে। কিছু ক্ষণ আগেই সে বলেছে, “ওরা আমাকে নিয়ে হাসে রোজ, সে দিন ভাবলাম গোল আমাকে করতেই হবে। দিয়েছি দুটো গোল। ফাটিয়ে দিয়েছি।”

ওরা হাসে কেন তোকে নিয়ে?

“গোল করতে পারি না, তাই।”

‘আমার সকল হৃদয় উধাও হবে’?

কোথায়? হয়তো একটু দূরে। বসে আছেন কমল গুহ। শোভাবাজার স্পোর্টিংয়ের। মতি নন্দীর লেখা স্টপার-এ, তাঁর শেষ ম্যাচের আগের দিন মাটিতে এঁকে সহ-খেলোয়াড়দের কৌশল বোঝান কমল, আর উদ্বাস্তু কলোনির ছেলে একরোখা শম্ভু বলে ওঠে, “কমলদা, আমি কিন্তু ওদের একটাকে নিয়ে বেরোব।” মনে পড়ে কমল গুহের গোল, বাঁ দিক থেকে একটা পা ঝলসে উঠল এবং বলে আঘাত করল, বল জালে জড়িয়ে গেল।

কিন্তু আমরা সকলেই তো শেষ ম্যাচে জিতব না।

আর একটা বছর শেষ হবে। পাওনাদারদের থেকে বাঁচতে, কিডনি বেচবেন বলে কলকাতাহয়ে কম্বোডিয়া চলে যাবেন মহারাষ্ট্রের কৃষক সদাশিব খুড়ে।

সেই শিশু যখন আকাশে তারাকে সাক্ষী রেখে আবার জন্ম নেবে বেথলেহেমে, গাজ়ার শিশু তখন দৌড়বে একটা রুটি আনতে, এক বস্তা ময়দা আনতে, এক জেরিক্যান জল আনতে, আর ত্রাণের নামে এক জায়গায় টেনে এনে মুখোমুখি গুলির হাত থেকে বাঁচতে।

কিন্তু সে বাঁচবে না, সে মরবে।

লাল টি শার্ট আর নীল প্যান্ট পরা আয়লান কুর্দি উপুড় হয়ে মরে থাকবে শরণার্থী নৌকা উল্টে।

ভোপালের মৃত শিশুর মুখ জেগে থাকবে বিষস্তূপের ভিতরে। মাঝে মাঝে প্রতীকী ছবি হয়ে ভেসে ওঠার জীবন তার।

আমরা এমন নানা মৃত্যুর কোলাজ হব। জীবন লুকোচুরি খেলবে।

তারই মধ্যে কোনও মেয়ে বলবে, “আগে লিখতাম ভালোবাসা। ছেলেকে পড়াতে গিয়ে জানলাম, ও-কার নেই। ভালবাসা নতুন করে শিখলাম।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Indian cricketer Harmanpreet Kaur Indian Women Cricket team

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy