উত্তর-পূর্বের দুর্গম রাজ্যের প্রথম মেডিক্যাল কলেজ। শিক্ষাবর্ষ ধরলে বয়স মাত্র তিনে পড়েছে। আর সেই মেডিক্যাল কলেজের হাল ধরে আছেন এক বাঙালিনি।
শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সত্যি যে, নাগাল্যান্ডে ২০২৩ সালের আগে কোনও মেডিক্যাল কলেজ ছিল না। ১৯৬৩ সালে ভারতভুক্তির পর থেকে এতগুলো বছরে সেখানে কোনও মেডিক্যাল কলেজ গড়ে ওঠেনি। ২০২৩ সালে যাত্রা শুরু করেছে নাগাল্যান্ড ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসার্চ (এনআইএমএসআর)। রাজ্যের প্রথম মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ডিরেক্টর এবং ডিন হয়েছেন কলকাতার মেয়ে, চিকিৎসক সৌম্যা চক্রবর্তী (বিবাহ সূত্রে ভট্টাচার্য)।
কী ভাবে নাগাল্যান্ডে এসে পৌঁছলেন? কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৮৮ সালের স্নাতক সৌম্যার এই নিয়ে তিন-তিনটি মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা হল। এমবিবিএস পাশ করার পরেই বিয়ে হয়েছিল চিকিৎসক শ্যামলকুমার ভট্টাচার্যের সঙ্গে। শ্বশুরবাড়ি নেপাল-বিহার সীমান্তের মধুবনী সংলগ্ন একটি গ্রামে। বিয়ের পরে দু’জনে স্নাতকোত্তর পড়তে গেলেন বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। শ্যামল নিলেন মাইক্রোবায়োলজি, সৌম্যা অ্যানাটমি। পাশ করার পরে সুযোগ এল নেপাল যাওয়ার। নেপালের ধারানে তখন নেপাল সরকার আর ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হচ্ছিল। সেটা ১৯৯৪ সালের শেষ। দু’জনেই শিক্ষক হিসাবে যোগ দিলেন সেখানে। ১৮ বছর নেপালে ছিলেন। ওই প্রতিষ্ঠানেই ওঁরা প্রথম ডিন হলেন। ওখান থেকেই চিকিৎসাবিদ্যা পঠনপাঠনের প্রশিক্ষণের জন্য বহু দেশে যাওয়া। ফিলাডেলফিয়ার ফেমার ইনস্টিটিউট থেকে স্বাস্থ্য শিক্ষায় ফেলোশিপ। মাঝখানে বছরখানেক সৌম্যা দিল্লিতে এসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাতেও কাজ করে গেলেন। তার পর আবার নেপাল।
ভারতে ফেরা ২০১৩ সালে। এ বার চাকরি, জোকা ইএসআই কলকাতায়। দু’বছর পরে শ্যামলও চলে আসেন ইএসআই-তে। তবে অল্প দিন পরেই উনি চলে যান অরুণাচল প্রদেশ মেডিক্যাল কলেজে। ২০২০-২০২১ নাগাদ সৌম্যাও অরুণাচলে ডিনের পদ পেয়েছিলেন। কিন্তু তা আর করে ওঠা হয়নি। সেই সময়েই কেন্দ্রীয় সরকার ডিনেরই দায়িত্ব দিয়ে ওঁকে পাঠিয়ে দিল বিহারের বিহিটাতে। দানাপুর আর আরা-র মাঝামাঝি বিহিটায় মেডিক্যাল কলেজ ২০১৯ থেকে তৈরি হয়ে পড়েছিল। সেটা চালু করতে হবে। ৫০-৬০ একর জায়গা জুড়ে ক্যাম্পাস, আর সৌম্যা সেখানে একমাত্র লোক। বলছিলেন, ‘‘২০২১-এর মার্চ মাস সেটা। কোভিড চলছে। কোভিডে এর আগে ইএসআই-তে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিলই। বিহারে এসেও প্রথমেই ওই হাসপাতালটাকে কোভিড হাসপাতাল করে ফেলতে হল। কোভিড চলে যাওয়ার পরে কলেজের নিজস্ব কাজ শুরু হল।’’ ২০২২ অবধি বিহারেই ছিলেন সৌম্যা। তার পর আবার অল্প দিনের জন্য জোকাতে ডিনের পদে। তখনই অবশ্য নাগাল্যান্ডের জন্যও ইন্টারভিউ দিয়ে রেখেছিলেন। সেটা হয়ে গেল। ২০২২-এর ডিসেম্বরে নাগাল্যান্ডচলে গেলেন।
নাগাল্যান্ডের অভিজ্ঞতা সব দিক থেকেই অনন্য। ‘‘নাগাল্যান্ড নিয়ে আমার উৎসাহের প্রধান কারণ ছিল যে, আমি পড়েছিলাম, এটাই হচ্ছে ভারতের একমাত্র রাজ্য, যার নিজস্ব কোনও মেডিক্যাল কলেজ নেই।’’ যদিও ২০১৪ সালেই এই কলেজটার অনুমোদন এসে গিয়েছিল। ২০১৯-এ নির্মাণের কাজও শুরু হয়। কিন্তু অনেক দূর এগোনোর পরে ধসে সবটা ভেঙে যায়। নতুন করে তৈরি করতে হল। সৌম্যার কথায়, ‘‘যখন এখানে যোগ দিলাম, আমি একাই ফ্যাকাল্টি। কাজ তখনও চলছে। আমিও ঘুরে ঘুরে প্রথম মেডিক্যাল কলেজ তৈরির কাজে তদারকি করছি।’’
২০২৩-এর অগস্টে প্রথম ব্যাচের পড়ুয়ারা এল। ১০০ জন ছাত্রছাত্রী। ৮৫ জন নাগাল্যান্ডের, বাকি বাইরের। সৌম্যা বলেন, ‘‘আমি তালিকা করে কোন ভবনগুলো আগে করতে হবে, কতটা করতে হবে বলে দিয়েছিলাম। দোতলা অবধি উঠে গেলে পঠনপাঠন চালু করা যাবে। বাকি কাজ তার পরেও হতে থাকবে। যেমন আমরা ঠিক করেছিলাম, হস্টেলের কাজ হবে সকালে। যখন ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে থাকবে। আর কলেজের কাজ হবে রাতে, যখন ছাত্রছাত্রীরা হস্টেলে থাকবে। আমার টিম, রাজ্য সরকার, কোহিমার মানুষ সকলেই খুব সহযোগিতা করেছেন।’’
নাগাল্যান্ডে কাজ করে খুবই তৃপ্ত সৌম্যা। বিশ্ব ব্যাঙ্ক অনেকখানি সহায়তা করেছে। থ্রিডি ডিসেকশন টেবিল আছে, স্মার্ট ক্লাসরুম আছে। সত্তর জনের উপর শিক্ষক আছেন। আর আছে অতি আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন স্কিল ল্যাব। ‘‘ছাত্রছাত্রীদের নিয়েও আমি খুবই গর্বিত। ৬৫ শতাংশই মেয়ে। খুব ভদ্র, বিনয়ী, নিয়মনিষ্ঠ। দেশের অন্যত্র যা দেখেছি, তার চেয়ে অনেক আলাদা।’’ অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল— ভৌগোলিক চ্যালেঞ্জ, বহিরাগত হয়ে জনজাতি সমাজের সঙ্গে মানিয়ে চলার চ্যালেঞ্জ, যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, নেটওয়র্কের সমস্যা। মহিলা হিসাবে বাড়তি সমস্যা? সৌম্যা বললেন, ‘‘না। এখানে মেয়েরাই অগ্রবর্তিনী। সেটা নিয়ে সমস্যা হয়নি। আমি যখনই যেখানে গিয়েছি, খুব সম্মান পেয়েছি। বিহারে কাজের অভিজ্ঞতাও চমৎকার।’’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? সদ্য স্বামীকে হারিয়ে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত তিনি। একমাত্র মেয়ে দিল্লির আইএসডিএমে কৌশল বিশ্লেষকের পদে নিযুক্ত। অনেকেই সৌম্যাকে কলকাতায় ফিরতে বললেও নাগাল্যান্ডের হাতছানি যেন এড়ানো যায় না। কর্মব্যস্ততা, মানুষের সরলতা, রামধনুর রং, স্নিগ্ধ পরিবেশ আর শিটজু কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে সৌম্যা নাগাভূমিতেই তাঁর জীবনীশক্তি খুঁজে নিচ্ছেন। দিশা দিচ্ছে রবীন্দ্রনাথের গান: ‘‘যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা...।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)