Advertisement
E-Paper

সর্ষে ইলিশ ঢাকার মেনুতেই, পাতে শুধু ক্রিকেট

মেনুতে জ্বলজ্বল করছে সর্ষে ইলিশ! এক প্লেট আটশো টাকা। এলাকার নাম পল্টন। পুরনো ঢাকা। রেস্তোরাঁর নাম কস্তুরী। বাংলাদেশের বিখ্যাত সিগনেচার রেস্তোরাঁ, যেখানে ইলিশ খেতে ভিড় করে দূর-দূরান্তের পেটুক মন। সোমবার দুপুরে সেখানে উদয় হওয়া বিদেশি অতিথিদের অবশ্য ওয়েটারদের লজ্জিত মুখে বারবার বিকল্পের সন্ধান দিতে হল।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৪ ০২:৫০
নতুন চমক। বল লাগলেই জ্বলে উঠছে বেল আর স্টাম্পের আলো। সোমবার মিরপুরে। ছবি: রয়টার্স।

নতুন চমক। বল লাগলেই জ্বলে উঠছে বেল আর স্টাম্পের আলো। সোমবার মিরপুরে। ছবি: রয়টার্স।

মেনুতে জ্বলজ্বল করছে সর্ষে ইলিশ! এক প্লেট আটশো টাকা।

এলাকার নাম পল্টন। পুরনো ঢাকা। রেস্তোরাঁর নাম কস্তুরী। বাংলাদেশের বিখ্যাত সিগনেচার রেস্তোরাঁ, যেখানে ইলিশ খেতে ভিড় করে দূর-দূরান্তের পেটুক মন। সোমবার দুপুরে সেখানে উদয় হওয়া বিদেশি অতিথিদের অবশ্য ওয়েটারদের লজ্জিত মুখে বারবার বিকল্পের সন্ধান দিতে হল।

“চিতল মাছের মুইঠ্ঠা খেতে পারেন। দারুণ লাগবে। ভাল পাবদা আছে। তেল-কই দিতে পারি। ইলিশ এখন খাওয়াতে পারব না। পঁচিশে বৈশাখ একদিনের জন্য দূর থেকে আনব। তার পর আবার জুনে।” ওয়েটার সরিয়ে এ বার দোকানের মালিক সদৃশ কেউ উদয় হয়েছেন। মনে হল, আমাদের রেস্তোরাঁর আর কোনও শাখা নেই-এর মতো বোর্ডে এটাও ঝোলানো যেতে পারত, এখন ইলিশ মেনুতেই শুধু আছে। এই ক’টা মাস পাতে দিতে পারব না।

অবশ্য বাংলাদেশি রেস্তোরাঁগুলোর মেনু কার্ডে যা আইটেমই থাক, আপাতত এ দেশে পর্যটকের পাতে একটাই বস্তুক্রিকেট!

মধ্যিখানে শোনা গিয়েছিল, জগমোহন ডালমিয়া চেষ্টা-চরিত্র করছেন যাতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দু’চারটে ম্যাচ কলকাতায় এনে ফেলা যায়। সেটা যে ঘটেনি অসীম সৌভাগ্য। কারণ, এই আবেগ ক্রিকেট-নবীন কোনও আকুল দেশের পক্ষেই দেখানো সম্ভব। বড় ক্রিকেট এবং আইপিএল দেখে দেখে চিরঅভ্যস্ত মানসিকতায় এমন স্বতঃস্ফূর্ত বিচ্ছুরণ হতেই পারে না। দুপুরে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে বার হওয়ার সময় কিছুই টের পাওয়া যায়নি। এর পর যেন ফিল্মের এক-একটা রিলের মতো দৃশ্যগুলো খুলতে শুরু করল।

একটু এগোলেই বঙ্গবন্ধুর বিশাল ছবি-সহ হোর্ডিংলং লিভ বাংলাদেশ। লং লিভ ক্রিকেট। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বিশাল বিশাল লোগো আর দেশগুলোর সিম্বল-সহ কাটআউট। বিভিন্ন হোর্ডিংয়ে শেখ হাসিনা। জাতির উদ্দেশ্যে নানান বক্তব্য সহকারে। কিন্তু তারই সঙ্গে তিনি আবার দশ-পনেরোটা হোর্ডিংয়ে সবুজ জার্সিধারী বাংলাদেশি কিছু ক্রিকেটারের পাশে। পাশে কপিরাইটারের অনবদ্য লাইনতোমাদের চোখে স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ। নতুন ঢাকার দিকে আরও এগোলে আরও নতুন নতুন বিলবোর্ড। যেখানে লেখাদুই বাঘ একসঙ্গে। সাকিব-আল-হাসান আর ব্যাঘ্রশাবক। বছর তিনেক আগে বিশ্বকাপের সময়েও ঢাকার রাস্তায় অনেক উত্তেজক আর সাকিবের টিমের মনোবলবর্ধককারী শব্দগুচ্ছ দেখে গিয়েছি। কিন্তু এ বারের মতো গোটা শহর জুড়ে তার বিস্তার ছিল না।

ধোনিদের এখানকার ডেরার নাম প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল। গোটা হোটেলটা আপাতত ক্রিকেটের থিম জোনে রূপান্তরিত। কফিশপে ওয়েটার সার্ভ করছে সবুজ বাংলাদেশি জার্সিতে। চারধারে ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস, হেলমেটের রেপ্লিকা। সেই ক্রিকেট-কাউন্টারগুলোর সামনে দুপুর দুপুর দেখা হয়ে গেল শাহিদ আফ্রিদির সঙ্গে। অবাকই লাগল। একটু পরে পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্র্যাকটিস ম্যাচ শুরু হবে। তিনি সাধারণ পোশাকে হোটেলে কী করছেন? পরে জানলাম, তখুনি করাচি থেকে এলেন। চোট সারিয়ে ফেরার জন্য তাঁকে পাক বোর্ড বাড়তি দু’দিন দিয়েছে। ঢাকা যেমন পুরনো এবং নতুন আফ্রিদিও তাই। পুরনো আফ্রিদি বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে হারের পর করাচি বিমানবন্দরে ডিম, টোম্যাটোর লক্ষ্যবস্তু হয়েছিলেন। সেই রেশটা এশিয়া কাপের শুরুতেও ছিল। যখন তীব্র তাচ্ছিল্যে প্রাক্তন পাক নক্ষত্ররা বলছিলেন, আফ্রিদি ব্যাট করুক কিন্তু বারো নম্বরে। এর পর এশিয়া কাপের ২ মার্চের রাত আর নতুন আফ্রিদি। ভারতের সঙ্গে শেষ ওভারের ম্যাচ জেতানো ওই দু’টো ছক্কা তাঁকে দেশে অসংখ্য পুরস্কারে আমির করে দেওয়া ছাড়াও ডাউনটাউন করাচিতে এমন পাঁচ কাঠা জমি দিয়েছে যার দাম ভারতীয় টাকার অঙ্কে পাঁচ কোটি!

স্রেফ দু’টো ছক্কায় জীবন আমূল বদলে যাওয়ার মতোই যেন ভোজবাজিতে অন্য রকম দেখাচ্ছে সোনারগাঁও হোটেল থেকে মীরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়াম যাওয়ার লম্বা অ্যাভেনিউটা। গোটা এলাকাটা সবুজ। দু’ধারে সুন্দর সুন্দর গাছ লাগানো। বুলেভার্ডগুলো সুসজ্জিত। এমনিতে এই রাস্তাটা তর্কযোগ্য ভাবে ক্রিকেটবিশ্বের সবচেয়ে যানজট কবলিত কুখ্যাত রাস্তা। কুড়ি মিনিটের দূরত্ব সময় নেয় দেড় ঘণ্টা। সোমবার নেহাত শেখ মুজিবের জন্মদিনে অফিসকাছারি বন্ধ বলে ভারতীয় টিমবাস শ্রীলঙ্কা প্র্যাকটিস ম্যাচের দু’ঘণ্টা আগে বার হওয়ার বিলাসিতা দেখাতে পারল। কিন্তু রাস্তাটা যতই কুখ্যাত হোক, লোকে যানজটে দাঁড়িয়েও তারিফ করার মতো কিছু পাবে। আইসিসি বা বাংলাদেশ বোর্ডের পক্ষে এত সর্বাত্মক বদল সম্ভব হত না খুলনার মন্টু বা চট্টগ্রামের আজিজও জানে। হাসিনার নির্দেশে ১১৫ কোটি টাকা শহরের সৌন্দর্যায়নে ব্যয় হয়েছে। আর কাজটা কন্ট্রাক্টররা ঠিক ভাবে করছে কি না তা দেখার নির্দেশ দেওয়া ছিল দেশের সামরিক বাহিনীর ওপর। সিলেটেও এ দিন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বলীয়ান চা বাগান আর ফোয়ারায় ভরা আধুনিক আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম জন্ম নিয়েছে। গত কাল সাকিবদের আফগান-বধের পর জাতীয় উন্মাদনা এতই বেড়েছে যে, প্রধান বিরোধীপক্ষ বিএনপি-ও যে প্রয়োজন মনে করলেও এখন কোনও হরতাল-টরতালের ডাক দেবে না, বোঝাই যাচ্ছে।

ক্রিকেট স্টাম্পে বল লাগলে লাল লাইট জ্বলছে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নবতম এই প্রযুক্তি আমদানির মতোই এ বারের বাংলাদেশি ক্রিকেটজনতার মনোভাবও যেন অভিনব। তারা ওয়ান ডে-র চেয়ে কুড়ি ওভারের ম্যাচে অনেক বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। স্থানীয় কর্পোরেট কর্তা ব্যাখ্যা করলেন, “ক্রিকেট দেখে একমাত্র সেই গোষ্ঠী যারা ক্রিকেট ভালবাসে। টি-টোয়েন্টি দেখে বৃহত্তর আমজনতা যারা ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহী না হয়েও বিনোদন ভালবাসে।” এখানকার দৈনিকগুলোয় এ দিন দেখছিলাম, রোববার বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে হিন্দুদের দোল খেলার ছবি বেরিয়েছে। বগুরা, ঢাকা, পাবনা, ময়মনসিংহ। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও কাল দোলের ছুটি ছিল।

দোলের চব্বিশ ঘণ্টা বাদে ঢাকা মুলুকে বসে অবশ্য মনে হচ্ছে, দোল তো স্রেফ একদিনের উৎসব ছিল। টি-টোয়েন্টি উৎসবে সব ধরনের মানুষের রং দেওয়া-নেওয়া চলবে তিন সপ্তাহ ধরে। আগামী ৬ এপ্রিল পর্যন্ত। নিঃসন্দেহে গত কয়েক বছরের মধ্যে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বসন্তোৎসব!

ইলিশ পাতে পড়ুক না পড়ুক, আজ পদ্মাপারে ক্রিকেট-বসন্ত!

gautam bhattacharya icc t20 world cup t20 bangladesh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy