Advertisement
০৭ মে ২০২৪
Gaighata

দলের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ বিধায়ক নিজেই

বিধানসভা ভোটে শাসকদলের অস্বস্তি বাড়াচ্ছে আমপানে ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি টাকা বিলি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ।

সংস্কারের অভাবে গাইঘাটায় যমুনা নদীর অবস্থা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

সংস্কারের অভাবে গাইঘাটায় যমুনা নদীর অবস্থা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

সীমান্ত মৈত্র  
গাইঘাটা শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:২৬
Share: Save:


নিজের দলেই গুরুত্ব পাচ্ছেন না, অভিযোগ খোদ বিধায়কের। এ শুধু তাঁর অভিযোগ, নাকি অভিমান?

ভোটের মুখে গাইঘাটার বিধায়ক পুলিবিহারী রায়ের কথায় ‘বেসুর’ স্পষ্ট। তাঁকে নাকি মর্যাদা দেওয়া হয় না দলে। দলীয় কর্মসূচিতে ডাকা হয় না। এলাকায় অনুন্নয়নের বহু অভিযোগ। দলের একাংশও তাঁর ভূমিকায় সন্তুষ্ট নন। ভোটের আগে পরিস্থিতি সামলানোর দায় আছে দলের, মনে করেন তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশ।

বিধায়কের কথায়, ‘‘আমি নাম বলতে চাই না, তবে বিধানসভা কমিটির চেয়ারম্যান হওয়া সত্ত্বেও আমাকে ব্লক সভাপতি বা অঞ্চল সভাপতি নিয়োগ করার কোনও ক্ষমতা, অধিকার দেওয়া হয়নি। অথচ, নিয়ম অনুযায়ী ব্লক সভাপতিদের নিয়োগ করার দায়িত্ব আমার থাকা উচিত ছিল। নিয়োগ করার ক্ষমতা আমার না থাকায় ওরা আমায় মানবে কেন?’’

কথা বলতে গিয়ে দলের বিরুদ্ধে পরতে পরতে ক্ষোভ চাপা থাকে না বিধায়কের। বলেন, ‘‘আমাকে চূড়ান্ত অপমান করা হয়েছে। হাত থেকে মাইক কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কটূক্তি করা হয়েছে। হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। অসম্মান করা হয়েছে। ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের পরে দিদিকে জানিয়েছিলাম। সমস্যা মেটেনি।’’

গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তথা তৃণমূলের গাইঘাটা বিধানসভার কোর কমিটির চেয়ারম্যান গোবিন্দ দাস অবশ্য জানিয়েছেন, বিধায়ক বিধানসভা কমিটির চেয়ারম্যান। কিন্তু এখানে নতুন করে কোর কমিটি তৈরি হয়েছে। ফলে বিধানসভা কমিটির কার্যক্ষমতা এখন নেই। চেয়ারম্যান হিসেবে বিধায়ক তাঁর দায়িত্ব পালন করেননি বলেও তাঁর অভিযোগ। এ বিষয়ে তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘উনি ঠিক কথা বলছেন না। উনি নিজেই নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন।’’

গাইঘাটার ভোটে মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক বড় নির্ণায়ক। এখানেই আছে মতুয়াদের পীঠস্থান, মতুয়া ঠাকুরবাড়ি। লোকসভা ভোটে তৃণমূলের ভরাডুবি হয়েছিল গাইঘাটা কেন্দ্রে। পঞ্চায়েত ভোটে সন্ত্রাস, বামেদের ভোট বিজেপির দিকে চলে যাওয়া, দলীয় নেতাদের একাংশের দুর্নীতি-স্বজনপোষণের মতো কারণ উঠে আসে দলের অন্তর্তদন্তে। সেই ক্ষত মেরামত করাই এখন চ্যালেঞ্জ শাসক শিবিরে।

মতুয়াদের নিয়ে শাসক-বিজেপি টানাপড়েন এখানে ভোটে গুরুত্বপূর্ণ। ইতিমধ্যে মতুয়া-মন পেতে নানা কর্মসূচি নিতে শুরু করেছে তৃণমূল। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মতুয়া উন্নয়ন পর্ষদ গঠন করেছেন। মতুয়াদের ধর্মগুরু হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথি মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশীতে রাজ্য সরকার ছুটি ঘোষণা করেছেন। মতুয়া সমাজের মাথাদের নিয়ে বৈঠকে বসছেন। নাগরিকত্ব আইন প্রয়োগের দাবি জোরদার করে মতুয়াদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়ে চলেছেন সাংসদ শান্তনু ঠাকুরও। বিধানসভা আসনে ভোটযন্ত্র ভরাতে তারও ভূমিকা থাকবে বলে মনে করে স্থানীয় রাজনৈতিক মহল। ৩০ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ঠাকুরবাড়িতে আসার কথা। তিনি কী বার্তা দেন, সে দিকে তাকিয়ে সব পক্ষই। পঞ্চায়েত ভোট থেকেই বিজেপি গাইঘাটায় সাংগঠনিক শক্তি বাড়িয়ে চলেছে। শান্তনু নিজের মতো করে সংগঠন মজবুত করছেন। দিন কয়েক আগে তাঁর দাবি মতো বিজেপি নেতৃত্ব বনগাঁকে আলাদা সাংগঠনিক জেলা করেছে। সভাপতি করা হয়েছে শান্তনু-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত বিজেপি নেতা মনস্পতি দেবকে।

অতীতে এখানে সিপিএম তথা বামেদের একচেটিয়া দাপট ছিল। লোকসভা ভোটে বামেদের সরিয়ে বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। তবে নতুন করে সংগঠন মজবুত করছে সিপিএম। তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে এসেছে বলে দাবি দলের নেতাদের। আমপান, করোনা পরিস্থিতিতে বাম কর্মীরা মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। ধারাবাহিক কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে।
তবে স্থানীয় সমস্যাগুলি অমীমাংসিত থেকেই গিয়েছে। গাইঘাটা বিধানসভা এলাকার বড় সমস্যা পানীয় জলে উচ্চমাত্রায় আর্সেনিকের উপস্থিতি। অভিযোগ, এলাকার অনেক মানুষকে এখনও আর্সেনিকযুক্ত জল পান করতে হয়। সরকারি ভাবে কিছু গভীর নলকূপ ও পানীয় জলের প্ল্যান্ট বসানো হলেও সমস্যা মেটেনি।

আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, গত পাঁচ বছরে এলাকার অনেকেই আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। এখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন পঞ্চাশজনের বেশি মানুষ। আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা ও প্রোটিন যুক্ত খাবারের দাবিতে কয়েকবার প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। কমিটির সম্পাদক অশোক দাস বলেন, ‘‘এলাকার আর্সেনিক সমস্যার কথা বিধায়ক ভেবেছেন বলে মনে হয়নি।’’

এই বিধানসভা এলাকার মধ্যে রয়েছে গোবরডাঙা গ্রামীণ হাসপাতাল। হাসপাতালটির উপরে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ নির্ভর করেন। অনেক ধরে বছর ধরে মানুষ কার্যত সেখান থেকে পরিষেবাই পান না। এলাকাবাসীর দাবি, হাসপাতালটিকে স্টেট জেনারেল হাসপাতাল হিসাবে চালু করতে হবে।

দিন কয়েক আগে হাসপাতালটি কোভিড হাসপাতাল হিসেবে চালু করেছে স্বাস্থ্য দফতর। যদিও মানুষের দাবি, পূর্ণাঙ্গ সাধারণ হাসপাতাল করতে হবে। এলাকার নিকাশির প্রধান মাধ্যম ছিল খাল-বিল-নদী। যথেষ্ট ভাবে জলাভূমি ভরাট করা হয়েছে। যমুনা নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার হয়নি। নাব্যতা হারিয়ে নদী মৃতপ্রায়।

প্রতি বছর ভারী বৃষ্টিতে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। কৃষিজমিতে জল জমে ফসল নষ্ট হয়। এ ছাড়া, জবরদখল হয়ে গিয়েছে চালুন্দিয়া নদী। নদী দখল করে বেআইনি নির্মাণ গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ। চাঁদপাড়া ও গাইঘাটা বাজার এলাকায় যানজট সমস্যা মেটেনি। যশোর রোড সম্প্রসারণের কাজ হয়নি।

বিধায়কের কাজ নিয়ে কী বলছেন বিরোধীরা?

বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি মনস্পতি দেব বলেন, ‘‘পাঁচ বছরে বিধায়কের কাজ হতাশাজনক। কোনও মানুষ ওঁকে দেখতেই পাননি। কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বিধায়ককে দেখতে কেমন, কেউ বলতে পারবেন না।’’ সিপিএম নেতা রমেন আঢ্যও বলেন, ‘‘বিধায়কের তো দর্শনই পাওয়া যায়নি। উনি এলাকায় থাকতেন না। এখানকার লোক নন। নজরে পড়ার মতো উল্লেখযোগ্য কাজ তিনি করেননি। যমুনা নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কার হয়নি। সরকারি আনুকূল্যে খাল-বিল-নদীর জমি বেআইনি ভাবে পাট্টা দেওয়া হয়েছে।’’ বিধায়কের কাজ নিয়ে গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তৃণমূলের গোবিন্দ দাস বলেন, ‘‘বিধায়কের কাজ নিয়ে বলব না। তবে এলাকার রাস্তাঘাট-সহ যাবতীয় উন্নয়নের ৯০ শতাংশ কাজ আমরা পঞ্চায়েত সমিতি পক্ষ থেকে করে দিয়েছি।’’

কী বলছেন বিধায়ক?

তাঁর কথায়, ‘‘বিধায়ক তহবিলের ৩ কোটি টাকার প্রায় সবটাই খরচ করেছি। গোবরডাঙায় টাউন হলে বিদ্যুদয়নের জন্য ৩ লক্ষ টাকা দিয়েছি। ৩টি অ্যাম্বুল্যান্স দিয়েছি। রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করেছি। এ ছাড়া, রাস্তা করেছি। নিকাশি নালা করেছি। পানীয় জলের টিউবওয়েল বসিয়েছি। আর্সেনিক সমস্যা মেটাতে নৈহাটি থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে গঙ্গার জল আনার প্রকল্পের কাজ চলছে। ওই জল পরিস্রুত করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হবে। যমুনা নদী সংস্কারের পরিকল্পনা করা হয়েছে।’’ এলাকায় তাঁর দৃশ্যমানতা নিয়ে অভিযোগ মানছেন না বিধায়ক। তাঁর কথায়, ‘‘কেউ ডাকলেই ছুটে যাই।’’

বিধানসভা ভোটে শাসকদলের অস্বস্তি বাড়াচ্ছে আমপানে ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি টাকা বিলি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ। তবে অনিয়ম নজরে পড়লে তা ঠেকিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP TMC Gaighata WB assembly election 2021
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE