দ্য টেলিগ্রাফ ডিবেট-এর অনুষ্ঠানে (বাঁ দিক থেকে) অমিত মিত্র, শত্রুঘ্ন সিনহা, অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি, সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়, মোহনদাস পাই, প্রফুল্ল কেতকার, কে সি ত্যাগী। রবিবার কলকাতায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
সভায় ছিলেন না তাঁরা। তবে নরেন্দ্র মোদী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কেউই সহজে ছাড় পেলেন না!
রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে ঠেস দিয়ে আজকের ‘নতুন ভারত’ উদ্যাপন করতে বললেন ইনফোসিসের প্রাক্তন চিফ এগ্জিকিউটিভ অফিসার (সিইও) মোহনদাস পাই। বললেন, ‘‘এই ভারত পরিবারতন্ত্র বা বনেদিয়ানার নয়, সাধারণের উত্থানের! মোদীকে খাটো করবেন না। বংশকৌলীন্য বা টাকার জোরহীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতা অর্জনেও গর্ব করুন।’’ পাইয়ের খোঁচা, ‘‘মমতার মন্ত্রিসভায় অমিতবাবুর ক্ষমতা কি একেবারে শূন্য? হুম...সবার মুখ বন্ধ দেখেই বিষয়টা বোঝা যাচ্ছে!’’ রবিবার ক্যালকাটা ক্লাবের বিতর্কসভার শ্রোতা-দর্শকেরা এ বার ‘হো হো’ করে উঠলেন।
পরক্ষণেই মোদী-প্রশাসনের স্বচ্ছতা প্রসঙ্গে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক-কাহিনি তোলায় সেটা বুমেরাং হয়ে ফিরে গেল পাইয়ের দিকে। তিনি বলছিলেন, ‘‘রঘুরাম রাজন শিকাগো যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। উর্জিত পটেলও গভর্নর-পদ নিজে ছাড়তে চেয়েছিলেন।’’ বিদগ্ধ জনতাও এ বার ‘ও-ও-ও’ স্বরে মেঠো আওয়াজে সরব। বিতর্কসভার সঞ্চালক, চিকিৎসক সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়ও হেসে ফেলেন, ‘‘রঘুরাম রাজন কি বিবেকানন্দের ভঙ্গিতে শিকাগো অভিযানে শামিল হচ্ছিলেন!’’
দ্য টেলিগ্রাফ জাতীয় বিতর্কসভার আসরে এমন সরস মুহূর্ত তৈরি হল অজস্র। সভার মত, ‘দ্য আইডিয়া অব ইন্ডিয়া নিডস টু বি রেস্টোরড’। ইংরেজির ‘রেস্টোর’ শব্দটার মানে কি পুনঃপ্রতিষ্ঠা, না সংস্কার বা মেরামতি? ভারত কি এক জরাজীর্ণ ভাঙাচোরা খণ্ডহর? প্রশ্নটা গোড়াতেই উস্কে দেওয়া হয়েছিল। সভার পক্ষে বক্তা কংগ্রেসের আইনজীবী-মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘবি, বলিউড-খ্যাত বিক্ষুব্ধ বিজেপি শত্রুঘ্ন সিনহা বা অমিতবাবুরা ভোটের বছরে প্রত্যাশিত ভাবেই ২০১৯-এর ভারত-পরিস্থিতি নিয়ে তোপ দেগেছেন। উল্টো পিঠে উইকেট বাঁচানোর দায়িত্বে মোহনদাস পাই, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)-এর ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘অর্গানাইজ়ার’-এর সম্পাদক প্রফুল্ল কেতকর এবং দিল্লিতে সংযুক্ত জনতা দলের মুখ, রাজ্যসভার সদস্য তথা প্রবীণ নেতা কেসি ত্যাগী।
দেশে ‘ওয়ান ম্যান শো’ বা ‘টু ম্যান আর্মি’ই কি ইন্ডিয়া? প্রশ্নটা ছুড়েছিলেন অধুনা কট্টর মোদী-বিরোধী ‘শটগান সিনহা’-ই! তবে ‘বাংলার বাঘিনি’ মমতাকে স্মরণ করে বক্তৃতা শুরু করায় তাঁর উদ্দেশে সঞ্চালক মশাইয়ের রসিকতা, ‘‘আপনি কি ইদানীং ওয়ান উওম্যান শো’-এ মজেছেন?’’
সভার উপজীব্য ‘ইন্ডিয়া’ থেকে কিছুটা সঙ্ঘের বহুচর্চিত বিষয় ‘ভারত’-এর দিকে ঘোরাতে চেয়েছিলেন অর্গানাইজ়ার সম্পাদক। বললেন, ‘‘মার্ক্স, মিল, মেকলের চশমায় দেখাটাই গোলমাল। প্রাচীন ভারতাত্মাকেই ফেরাতে হবে।’’ তাঁর আক্ষেপ, তিনি নিজেও জেএনইউ-এর ছাত্র। চিন্তার জগতে মগজধোলাইয়ের ফলে একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে। আখলাকের মৃত্যু নিয়ে সংবাদমাধ্যম সরব, উল্টোটা ধরা হচ্ছে না!’’ অমিতবাবু রামকৃষ্ণের ‘যত মত, তত পথ’ বা বিবেকানন্দের ‘মূর্খ চণ্ডাল ভারতবাসী’র ভারত-দর্শনের সঙ্গে সঙ্ঘের মতাদর্শের ফারাক তুলে ধরলেন। দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গোলওয়ালকরের হিটলার-প্রীতি ও ইহুদি-বিদ্বেষ সমর্থনের নমুনা পেশ করলেন তিনি। ভারতাত্মার নির্যাস বলতে নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত রচনা বা বাংলার ঘরে ঘরে নেতাজির সৈনিক শাহনাওয়াজ় খানদের ঘিরে আবেগের কথা তুলে ধরলেন। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘আজকের ভারতে এই আবেগও নিন্দিত হত। কারণ, এখন সেকুলারিজ়ম একটি অপশব্দ।’’
অমিতবাবু বা কংগ্রেসের সিঙ্ঘবিরা মোদী-জমানায় সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, আমলাকুল বা সংবাদমাধ্যমের কোণঠাসা হওয়া নিয়ে সরব। চিরকেলে ফিল্মি কায়দায় শত্রুঘ্ন সিনহার সংলাপ: রাফালে চুক্তি নিয়ে জবাব দিলে মোদীর ৫৬ ইঞ্চি ছাতি কি কমে ছ’ইঞ্চি হয়ে যেত?’’
প্রবীণ রাজনীতিবিদ ত্যাগী যা বলার বললেন তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার নিরিখে। জরুরি অবস্থা, ভাগলপুরের দাঙ্গা প্রভৃতি উদাহরণে সকলকে এক বিভীষিকাময় ইতিহাস-সফরে নিয়ে গেলেন। তাঁর যুক্তি, গোরক্ষার নামে লুম্পেনবাজি, খুনোখুনির ঘটনা দিয়েই ভারত আগের থেকে খারাপ হয়েছে, বলা যায় না। হাত তুলে সভার মত সমর্থনে জনতা শেষমেশ ২০১৯-এর পরিস্থিতিকেই গুরুত্ব দিয়েছে। অতীতে খারাপ কিছু ঘটে থাকলেও বর্তমানে যা ঘটছে, সেটাও মেনে নেওয়া যায় না, জনতার এই নিরুচ্চার অভিমত বিরোধী শক্তিকে কিছুটা হলেও হয়তো মনোবল জোগাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy