Advertisement
E-Paper

বিনোদিনীর পরে

ওঁর মতোই যাঁরা ব্রাত্য। লিখছেন সুকৃতি লহরীখ্যাতির একেবারে মাঝ-আকাশে দাঁড়িয়ে থিয়েটার ছেড়েছিলেন বিনোদিনী। এর পরেও এক দিনের জন্য কিন্তু থিয়েটার বন্ধ হয়নি। বিনোদিনীর মেন্টর গিরিশচন্দ্র ঘোষ তৈরি করে নিয়েছিলেন কিরণবালাকে। ‘বেল্লিকবাজার’-এর সখীর দলের কিরণবালা একের পর এক নাটকে তখন বিনোদিনীর জায়গায়। প্রথম দিকে বিনোদিনীর ‘কার্বন কপি’ হলেও ‘স্বর্ণলতা’র নাট্যরূপ ‘সরলা’ রেকর্ড গড়ল।

শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
ছবি: তারাসুন্দরী ও কুসুমকুমারী

ছবি: তারাসুন্দরী ও কুসুমকুমারী

খ্যাতির একেবারে মাঝ-আকাশে দাঁড়িয়ে থিয়েটার ছেড়েছিলেন বিনোদিনী।
এর পরেও এক দিনের জন্য কিন্তু থিয়েটার বন্ধ হয়নি। বিনোদিনীর মেন্টর গিরিশচন্দ্র ঘোষ তৈরি করে নিয়েছিলেন কিরণবালাকে।
‘বেল্লিকবাজার’-এর সখীর দলের কিরণবালা একের পর এক নাটকে তখন বিনোদিনীর জায়গায়। প্রথম দিকে বিনোদিনীর ‘কার্বন কপি’ হলেও ‘স্বর্ণলতা’র নাট্যরূপ ‘সরলা’ রেকর্ড গড়ল। বিনোদিনী-স্মৃতিকে এর পরই কি খানিকটা ঝাপসা করে দিলেন কিরণবালা?
বিনোদিনীর চেয়েও আরও কম সময়ের মঞ্চ-আধিপত্য তাঁর। মারা যান মাত্র বাইশ বছরে। তার জেরে তিন মাস বন্ধ থাকে স্টার।
বিনোদিনীর জন্যও যা হয়নি!
আর তিনকড়ি দাসী? ‘গিরিশপ্রিয়া’? তাঁকে তো প্রাণ ঢেলে তৈরি করেছিলেন গিরিশ ঘোষ।
বড্ড বেশি লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। এক দিকে মা। অন্য দিকে থিয়েটার।
মা তো চাইবেনই মেয়ে তাঁরই পেশায় থাক। বন্দোবস্তও করে ফেলেন ‘ভদ্দরলোক’ ডেকে। সুন্দরী, দীর্ঘাঙ্গী, সুগায়িকা তিনকড়ির শরীর জুড়ে বিদ্যুৎ। কিন্তু তত দিনে যে তিনি বাঁধা পড়ে গিয়েছেন থিয়েটারে!
গিরিশ ঘোষ তখন ‘ম্যাকবেথ’-এর অনুবাদ নিয়ে পাগলপারা। নামভূমিকায় প্রমদাসুন্দরী। তাঁর বেশ নামডাক। দেমাকও খুব। প্রথম দিনে তিনকড়িকে থিয়েটারে দেখে আঙুল তুলে বললেন, ‘‘এটি কে? এটি বুঝি আজ নূতন এল?’’ প্রমদাসুন্দরী কি তখন ভেবেছিলেন এই ‘নূতন’টিই তাঁর জায়গা নেবে!
নাট্যাচার্যের কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না প্রমদাসুন্দরীর অভিনয়। পার্ট পড়ালেন তিনকড়িকে দিয়ে। তার পরই প্রমদা ‘আউট’, তিনকড়ি ‘ইন’। পুরো বাদ অবশ্য নয়, প্রমদাকে গিরিশ দিলেন ‘লেডি ম্যাকডাফ’। ও দিকে সাত-আট মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে লেখাপড়া না-জানা এক দেহোপজীবিনী হয়ে উঠলেন ‘লেডি ম্যাকবেথ’।

আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তিনকড়িকে। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অভিনেত্রী মিসেস সিডনসের সঙ্গে তুলনা চলতে লাগল তাঁর। তবু থিয়েটার করতে গিয়েও যে ‘বাবু’র হাত থেকে রেহাই নেই! বাবু যদি বক্সে বসেন, তো থিয়েটার মাথায় ওঠে।

‘করমেতিবাঈ’-এর প্রথম শো। হাউসফুল। তবু নাটক শুরুই করা যাচ্ছে না। গ্রিনরুমে বেঁকে বসেছেন তিনকড়ি। বিধবার সাজে তিনি কিছুতেই মঞ্চে উঠবেন না। কেন? করমেতিবাঈ যে বিধবাই।

তা’ও না। তাঁর ‘বাবু’ যে সে দিন বক্সে। তিনকড়ি তাঁর সামনে থান পরে স্টেজে উঠবেন, তা হয় নাকি? এ দিকে দর্শকের চেঁচামেচিতে গোল বাধে প্রায়! শেষে অনেক অনুনয়-বিনয় করে বাবুটিকে বাড়ি পাঠিয়ে তবে শুরু হল নাটক।

তবু ‘বাবু’রা কি আর পিছু ছেড়েছে তাঁর! তিনকড়ি যখন এক্কেবারে খ্যাতির শীর্ষে, নজরে পড়েন উত্তর কলকাতার এক পয়সাওয়ালা ‘ভদ্দরলোক’-এর। তাঁর সিঁথির বাগানবাড়িতে তখন মাঝেমধ্যেই মেহফিল বসে। মেহফিলের মধ্যমণি তিনকড়ি। গিরিশ ঘোষও যান। তিনকড়িকে পাওয়ার জন্য ‘বাবু’টি গিরিশ ঘোষকে খুনের ছক পর্যন্ত কষে ফেলেন। ভাগ্যিস সে-চেষ্টা ব্যর্থ হয়!

শুধু মোহিনী অভিনেত্রী নন, তিনকড়ি এক অদ্ভুত মানুষও। তাঁর উইলটি যেমন। চমকে দেওয়ার মতো। দুটো বাড়ি দান করেছিলেন বড়বাজার হাসপাতালকে। একটি তাঁর ‘বাবু’র ছেলেকে। গয়নাগাটি বিক্রির কিছুটা টাকা গরিব পড়শিদের। বাকিটা রেখেছিলেন নিজের শ্রাদ্ধের জন্য।

গিরিশ-তিনকড়ির মতো থিয়েটারে এমন যুগলবন্দি কত যে আছে! অপরেশচন্দ্র-তারাসুন্দরী, অমরেন্দ্র-কুসুমকুমারী…। চমৎকার কেমিস্ট্রি আর তাতে কত যে আলোআঁধারির খেলা!

কুসুমকুমারী গ্ল্যামার-ক্যুইন। যেমন তাঁর নাচ-গান। তেমন অভিনয়। ক্লাসিক থিয়েটারে ‘আলিবাবা’ তখন সুপারহিট। কুসুম সেখানে মর্জিনা। বাড়ি ফাঁকা করে লোকে ছোটে তাঁর টানে।

অথচ কালের ফেরে এই ‘মর্জিনাকে’ই কিনা চার আনা পয়সার জন্য শেষ জীবনে হাত পাততে হয়! প্রখ্যাত অভিনেত্রী অপর্ণাদেবীর স্মৃতিতে ধরা তার ছবি—

‘‘আমি মঞ্চের পিছনে গ্রীনরুমের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছি। এমন সময় নাট্যনিকেতনের ভিতরে একজন মহিলা প্রবেশ করলেন। শীর্ণ শরীর। পরনে অত্যন্ত ময়লা একটা ছেঁড়া থান, অনাহারে অনিদ্রায় মহিলাটি রীতিমতো ধুঁকছিলেন। আমি সামনেই ছিলাম। মহিলা ক্ষীণস্বরে বললেন, ‘আমাকে চার আনা পয়সা দেবেন?’ আমি বিনা বাক্যব্যয়ে মহিলার হাতে চার আনা পয়সা তুলে দিলাম।’’

পাশেই ছিলেন নীহারবালা। বললেন, ‘‘…আমাদের শেষজীবন যে কত ভয়ংকর হয় তার প্রমাণ ওই মহিলা। উনি কে জানো? উনি প্রখ্যাত অভিনেত্রী কুসুমকুমারী।’’

শেষ জীবনে অর্থাভাব, আর মধ্যজীবন? খ্যাতি যখন শিখরে? দোলাচল, টানাপড়েন, অনিশ্চয়তা কি তখনও ছিল না তাঁদের? আর বায়নাক্কা? তাঁদের থিয়েটারে ধরে রাখতে ‘মেন্টর’-দের কী না কী করতে হত!

অমরেন্দ্রনাথ দত্ত। বাংলা নাটমঞ্চের নেপোলিয়ান। এক মামলার সাক্ষী হয়েছেন। সংলাপটি এ রকম—

‘‘আপনার রক্ষিতা রমণী আছে?’’

‘‘আমার রক্ষিতা আছে। আমার যে ব্যবসায় তাহাতে রক্ষিতা না রাখিলে চলে না। ভাল অভিনেত্রী বাজারে পাওয়া যায় না, গড়িয়া লইতে হয়। রক্ষিতা করিয়া না রাখিলে ধনী বাবুদের গ্রাস হইতে তাহাদের কেমন করিয়া রক্ষা করিব?’’

গোলাপসুন্দরী-বিনোদিনী-তিনকড়ির মতো এমন কণ্টকাকীর্ণ পথেই হেঁটেছেন বসন্তকুমারী-সুশীলবালা-হরিসুন্দরী (ব্ল্যাকি), নরীসুন্দরী, চারুশীলা— কত কত অভিনত্রী।

প্রভাদেবী যেমন। নিষিদ্ধপল্লির অন্ধকার ঘরেই তো জন্ম। তিনকড়ি তাঁকে কাছে টেনে নিলেন। নাম দিলেন প্রভা। পরে শিশির ভাদুড়ির নিজের হাতে তৈরি সেই প্রভার অভিনয়ে ভেসে যায় সমকাল। ভাবীকালও।

‘সীতা’য় তিনি প্রমাণ দিয়েছেন বারবার। ‘বিন্দুর ছেলে’-তে বড় বৌ প্রভা যখন বলতেন, ‘তুই কাকে কি বললি লা ছোট বউ!’ শম্ভু মিত্রের কাছে তা ‘পৃথিবীর বিখ্যাত অভিনয়ের মধ্যে গণনীয়।’

আদরের মেয়ে বুলা যে দিন মারা যায়, সে দিনও ছিল প্রভার থিয়েটার। শোকে পাথর হয়েও তিনি চাননি থিয়েটার বন্ধ করতে! বলেছিলেন, ‘‘আমি থিয়েটার করব। এক বুলার জন্য হাজার হাজার মানুষ কেন থিয়েটার দেখা থেকে বঞ্চিত হবে!’’

ত্যাগ। ভালবাসা। শ্রদ্ধা। মমতা। —কোনও একটি শব্দে এই অনুভবের ব্যাখ্যা হয়? হয় না। হবেও না।

তবু এত কিছুর পরেও ‘অচ্ছুৎ’ তকমাটা কিন্তু ওঁদের ঘোচেনি বহু বহু কাল। একে মেয়ে তায় বারাঙ্গনা!

গিরিশ ঘোষের স্মরণ-অনুষ্ঠান। গণ্যমান্যদের। টাউন হলে ঢুকতেই দেওয়া হল না তাঁদের। অভিমানে ফেটে পড়লেন সুশীলবালা। বসন্তবালা, রানীসুন্দরী, নরীসুন্দরী সব্বাইকে নিয়ে লিখিত প্রতিবাদ করলেন অমরেন্দ্রনাথ দত্তের কাছে। উনি মেনে নিলেন।

এর পর?

আবেগে, শ্রদ্ধায় ভেসে গেল ‘স্টার’। — ‘‘পতিতা আমরা, সমাজবর্জিতা বটে— কিন্তু আমরা মানুষ। আপনারা মনে না করিতে পারেন, কিন্তু সুখ-দুঃখ অনুভব করিবার শক্তি আপনাদের ন্যায় আমাদেরও আছে।’’

এর পরও রাগ, ঘৃণা, কষ্ট দিয়ে বোনা ‘নিষিদ্ধের’ এই উচ্চারণ সত্যিই কি লজ্জায় ফেলেছিল বিশুদ্ধবাদীদের?

জানা নেই।

আজও কি তার উত্তর মেলে?

কে জানে!

ঋণ: তিনকড়ি, বিনোদিনী ও তারাসুন্দরী (উপেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ), রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী (অমিত মৈত্র), সোনার দাগ (গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ)

sukriti lohori theatre girls noti binodini girish chandra ghosh tinkoridasi girishpriya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy