Advertisement
E-Paper

অক্লান্তকণ্ঠ এক সংগীত-সন্ন্যাসী তিনি

তাঁর মুখে হাসি, গলায় গান, দু’হাতে কাজ, দান-ধ্যান। লখনউয়ের মুকুটহীন সম্রাট, ব্যারিস্টার অতুলপ্রসাদ সেনের জীবন পূর্ণ ছিল কর্মে, প্রার্থনায়। লিখছেন শিশির রায়তাঁর মুখে হাসি, গলায় গান, দু’হাতে কাজ, দান-ধ্যান। লখনউয়ের মুকুটহীন সম্রাট, ব্যারিস্টার অতুলপ্রসাদ সেনের জীবন পূর্ণ ছিল কর্মে, প্রার্থনায়। লিখছেন শিশির রায়

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
অতুলপ্রসাদ সেন

অতুলপ্রসাদ সেন

সে  সব কী দিনই না ছিল! ভাবুকের সঙ্গে মনের যোগ ছিল কর্মীর। গায়কের সঙ্গে বিজ্ঞানীর। দেশনেতার সঙ্গে চিত্রশিল্পীর। কবির সঙ্গে ব্যারিস্টারের। দুরন্ত প্রযুক্তি ছিল না, চিঠিপত্রের গতায়াতে সময় লাগত বিস্তর। দেশ জুড়ে কত ওঠানামা, ঘটনার বুড়বুড়ি অন্য প্রান্তে পৌঁছনোও সময়ের ব্যাপার। তবু মনের যোগ ছিল বলেই দূর এসে যেত কাছে। আর সৌভাগ্যের কথা, সব যুগেই থাকেন কিছু মানুষ— গোটা দেশকে একসূত্র রাখেন প্রজ্ঞা, প্রতিভা আর হৃদয়বত্তায়। অতুলপ্রসাদ সেন যেমন। ঊনবিংশ-বিংশ শতকের ভারতে এক বিস্তীর্ণ সেতুবন্ধ।

কারও কাছে ‘অতুলদা’, কারও ‘ভাইদাদা’। ‌আরও অনেকের কাছে ‘এ পি সেন’, ‘সেনসাহেব’, লখনউয়ের শ্রেষ্ঠ ব্যারিস্টার। কারও ‘প্রিয়বরেষু’, ‘কবিবন্ধু’। সব সম্বোধনের পিছনে সদাশিবের মতো মানুষটি, মুখে হাসি, গলায় গান, দু’হাতে কাজ, দান-ধ্যান। সেই মানুষটি, যিনি কাগজে বিবেকানন্দের শিকাগো-জয়ের খবরে উচ্ছ্বসিত হয়ে সেলিব্রেট করেন, রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী পালনে উঠেপড়ে লাগেন, মহাত্মা গাঁধীর ডাকে ছুটে গিয়ে গান শোনান, তিনি অতুলপ্রসাদ। তিনি অওধ বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট, আবার প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের কান্ডারি। তাঁকে ছাড়া লখনউয়ের মুশায়েরা, ঠুমরি-গজলের মজলিশ পূর্ণ হয় না। তিনি দীনের সহায়, লখনউয়ের রাস্তায় যেতে যেতে ঘুমন্ত দরিদ্রের বালিশের তলায় টাকা গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে আসেন নিঃশব্দে। অন্তরের গহনতম প্রদেশে সেই মানুষটাই নীরব কান্নাকে সমর্পণ করেন প্রার্থনায়। সব যন্ত্রণার শেষ ঘটান নির্মাণে— গান রচনায়, সুর-সাধনায়।

১৮৭১-এ ঢাকায় জন্ম, বাবা রামপ্রসাদ সেন ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহভাজন, মহর্ষিই তাঁকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে সাহায্য করেন। ঢাকার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, ঋষি কালীনারায়ণ গুপ্তের মেয়ে হেমন্তশশীর সঙ্গে বিয়ে হয় উদার, বুদ্ধিমান তরুণটির। জন্মাবধি অতুলপ্রসাদ দেখেছেন উনিশ শতকীয় সংস্কারমুক্ত খোলা একটা আকাশ। বাবা রামপ্রসাদ নববিধানের, দাদু কালীনারায়ণ ভারতীয় ব্রাহ্মসমাজের সদস্য ছিলেন। শ্বশুর-জামাতার মতান্তর মনান্তরে রূপ নেয়নি কখনও। শিশু অতুল দেখেছেন রবিবারের প্রার্থনায় দু’জনেরই প্রণত যোগদান। কালীনারায়ণের কাছে আসতেন বহু দীনজন। দানসামগ্রী যা কিছু শিশু অতুলের হাত দিয়ে দেওয়াতেন মাতামহ। অতুলপ্রসাদ বড় হতে হতে দেখেছেন, দাদু একটা কালো পাথরের থালায় ভাত খান, নিজের হাতে থালা ধুয়ে তাতেই ভাত বেড়ে দেন লক্ষ্মীবাজারের বাড়ির বহু দিনের পুরনো মেথরকে, সে খেয়ে উঠলে নিজে সেই থালা ধুয়ে রাখেন ফের। উচ্চবর্ণের, সচ্ছলতার গুমোর ভেঙেছিল রোজকার সহজ শিক্ষায়, আমৃত্যু সেই শিক্ষা ভোলেননি।

রামপ্রসাদের মৃত্যুর পর অতুলপ্রসাদের মা হেমন্তশশীর দ্বিতীয় বার বিয়ে হয়— চিত্তরঞ্জন দাশের জ্যাঠামশাই, ব্রাহ্ম নেতা দুর্গামোহন দাশের সঙ্গে। তরুণ অতুলপ্রসাদ বাড়ির বড় ছেলে, ছোট তিনটি বোন ঘরে। কলকাতায় বড়মামা কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্তের বাড়িতে থাকেন তখন, অভিমানে মায়ের কাছেই ঘেঁষেন না। অভিমান থেকে এসেছে জেদ, প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ে, পরে বিলেত গিয়ে হতে হবে ব্যারিস্টার। একা নিজের ঘরে মায়ের জন্য কাঁদেন, তখন কাছটিতে এসে বসে মামার মেয়ে হেমকুসুম। সান্ত্বনা দেয়, প্রেরণা জোগায়। বড় হতে হবে জীবনে, অনেক বড়। হেমকুসুমের সঙ্গ অতুলপ্রসাদকে তিরতির কাঁপায়।

সম্পর্কে সৎবাবা, তাতে তো স্নেহ আটকায় না। দুর্গামোহনই ব্যবস্থা করে দিলেন অতুলপ্রসাদের বিলেত যাওয়ার প্যাসেজ মানি, ভারী শীতপোশাকের। ১৮৯০ সালে ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ডে পাড়ি দিলেন বছর কুড়ির অতুল। জাহাজে ভেনিস হয়ে আসার পথে গন্ডোলা-চালকরা একটা গান গাইছিল, কী মিষ্টি! সেই সুরই অতুলপ্রসাদকে দিয়ে লিখিয়ে নিল একটা গান। ‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী, উঠ আদি জগৎজনপূজ্যা/ দুঃখ-দৈন্য সব নাশি, কর দূরিত ভারতলজ্জা...’ যে গান পরে বিংশ শতাব্দীর ভারতে জাতীয়তাবাদের আবহে মানুষের মুখে মুখে ঘুরবে। লন্ডনে মিডল টেম্পল-এ পড়েন, ব্রিটিশ মিউজিয়াম দেখেন অবাক চোখে। সেখানেই তখন চিত্তরঞ্জন দাশ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অরবিন্দ ঘোষ, সরোজিনী নাইডু— অতুলপ্রসাদ এঁদের সবার বন্ধু। পড়ার সমান্তরালে চলে অপেরা, পাশ্চাত্য সংগীত, বিশ্বসাহিত্যের পাঠ। কলকাতায় ফিরে হাইকোর্টে নাম লেখালেন, লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের ‘জুনিয়র’ হিসেবে শুরু হল কর্মজীবন।

স্ত্রী হেমকুসুম, পুত্র দিলীপ

কঠিন ব্যারিস্টারি পরীক্ষা পাশ করে ছেলে দেশে ফিরেছে, হেমন্তশশী-দুর্গামোহন খুব খুশি। মায়ের কাছে যেতে তবু পা সরে না, মাঝে কী এক দুর্লঙ্ঘ্য বাধা। পরিস্থিতি জটিলতর হল, যখন অতুলপ্রসাদ-হেমকুসুম ঠিক করলেন, বিয়ে করবেন। আত্মীয়রা শিউরে উঠল। মামাতো-পিসতুতো ভাইবোন, বিয়ে হবে কী! ব্রিটিশ বা হিন্দু, কোনও আইনেই এ বিয়ে সিদ্ধ নয়। সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ পরামর্শ দিলেন, বিয়ে করতে হলে বিদেশে গিয়ে করো। স্কটল্যান্ডে গ্রেটনাগ্রিন গ্রামের গির্জায়, সেখানকার নিয়মে বিয়ে করলেন হেমকুসুম-অতুলপ্রসাদ। বিংশ শতাব্দীর শুরুর বছরটি তখন চোখ মেলেছে সবে।

বিয়ে হল, কিন্তু দেশে ফেরা? কিছু দিন চেষ্টা করেছিলেন, বিলেতেই যদি থাকা যায়। রোজগার বড় বালাই। দুই পুত্র দিলীপকুমার-নিলীপকুমার জন্মেছে, সংসার চালাতে হবে। সাত মাসের মাথায় জ্বরে নিলীপকুমার মারাও গেল। কাজ জুটছে না, হেমকুসুম গয়না বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। কলকাতায় ফিরলেন, কিন্তু প্র্যাকটিস জমানো মুখের কথা নয়। মুখ ফিরিয়ে-থাকা পরিজন-বন্ধুর মাঝে বাঁচাও মুশকিল। ব্যারিস্টার বন্ধু মমতাজ হোসেন বুদ্ধি দিলেন, লখনউ চলুন। উত্তরপ্রদেশের নবাবি নগর, ঠুমরি-টপ্পা-শায়েরির লখনউয়ে বহু বাঙালির বাস; গোমতীর তীর আলো করছেন শিক্ষা-সাহিত্য-শিল্পে। গুণীর কদর করে লখনউ, মানীর মান রাখে। অতুলপ্রসাদ লখনউ এলেন, ক’জন বন্ধুও এগিয়ে এলেন সাহায্যে। লখনউ বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হলেন, প্র্যাকটিস শুরু করলেন লখনউ কোর্টে।

শুরু হল নতুন জীবন। অতুলপ্রসাদ উর্দু শিখলেন, বন্ধুতা হল শহরের গণ্যমান্য বিদ্বজ্জনদের সঙ্গে। প্রিয়দর্শন, সহাস্য মানুষটি অচিরেই প্রিয় হয়ে উঠলেন সবার। কোর্টে তালুকদারি শরিকি ঝগড়া মেটান পেশাদারি দক্ষতায়, সারস্বত সমাজেও তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি। কলকাতায় যে জীবন চেয়েছিলেন, তা পেলেন লখনউতে। কত যে কাজ করার আছে! হরিজন মানুষের মধ্যে কাজ, অতুলপ্রসাদ হাজির। কাশীতে বিধবা আশ্রম প্রতিষ্ঠা, অতুলপ্রসাদ আছেন। গোমতীর বন্যায় দুর্গতদের জন্য পথে পথে ঘুরে গান গেয়ে অর্থসংগ্রহ, অতুলপ্রসাদকে দেখে লোকে এগিয়ে আসেন। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা লাগল এক বার শহরে, ছুটে গেলেন। উন্মত্ত মানুষ একে অন্যকে আঘাত করছে রাজপথে, আর তাঁদের মধ্যে ছুটে গিয়ে অতুলপ্রসাদ বোঝাচ্ছেন, ভুল হচ্ছে কোথাও, এ ঠিক নয়। রাতে ঘরে ফিরে কলম তুলে নিয়েছিলেন হাতে: ‘পরের শিকল ভাঙিস পরে, নিজের নিগড় ভাঙ রে ভাই... সার ত্যজিয়ে খোসার বড়াই! তাই মন্দির মসজিদে লড়াই। / প্রবেশ করে দেখ রে দু’ভাই— অন্দরে যে একজনাই।’

লখনউয়ে অতুলপ্রসাদের বাড়ি

গান ছিল তাঁর প্রাণ। কর্মমুখর জীবনে নিজের জন্য সময় রাখেননি, গানের জন্য রেখেছেন। দিলীপকুমার রায় লিখেছেন, ‘‘আমাদের আগেকার যুগে ভক্তির গানে ফুলের মতন ফুটে উঠছিলেন চারজন কবি: দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ, রজনীকান্ত ও অতুলপ্রসাদ। এঁদের মধ্যে অতুলপ্রসাদ সর্বকনিষ্ঠ তথা অনলংকৃত কবি... তাঁর গান শুনতে শুনতে মনে হয়, দৈনন্দিন ঘরকন্নার মধ্য দিয়ে যেন একটি সরল উচ্ছ্বাসী কবি-হৃদয় নিজের মনের কথা বলে চলেছে তার আনন্দ বেদনা আশা-নিরাশার পসরা নিয়ে।’’

কতশত উপলক্ষেই যে গান লিখেছেন অতুলপ্রসাদ! একুশ শতকের উৎসবসর্বস্বতার ভিড়ে দেশবন্দনার গানগুলি পিছু হটতে হটতে এখন ১৫ অগস্ট, ২৩ কি ২৬ জানুয়ারির দেওয়ালে এসে ঠেকেছে, তবু ‘জনগণমন অধিনায়ক’ বা ‘আমার সোনার বাংলা’-র পরেই এখনও যে গানগুলি শুনলে পরাধীন এক দেশে মানুষের চকচকে চোখ আর দৃঢ়বদ্ধ মুষ্টির কথা মনে পড়ে, তার অনেকগুলিরই রচয়িতার নাম অতুলপ্রসাদ সেন। ‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী’, ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’, ‘হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর’, ‘বলো বলো বলো সবে, শত–বীণা-বেণু-রবে’— অতুলপ্রসাদের গান কোন বাঙালি গায়নি? গান-বাঁধার উপলক্ষগুলিও মনে রাখার মতো। বিলেতে ইংরেজ গায়িকার গান শুনে লিখেছিলেন ‘প্রবাসী চল রে, দেশে চল’। লোকমান্য তিলক কারারুদ্ধ হয়েছেন, দেশ জুড়ে প্রতিবাদ। অতুলপ্রসাদের বাড়িতে সে দিন অতিথি বিপিনচন্দ্র পাল ও শিবনাথ শাস্ত্রী। তাঁদের সামনেই গাইলেন ‘কঠিন শাসনে করো মা শাসিত’। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেলজয়ের পর অতুলপ্রসাদের নিজস্ব গুরুবন্দনা ছিল ‘মোদের গরব মোদের আশা’-র দু’টি কলি: ‘বাজিয়ে রবি তোমার বীণে/ আনল মালা জগৎ জিনে...’ শান্তিনিকেতনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শোনাচ্ছেন ‘মোর সন্ধ্যায় তুমি সুন্দরবেশে এসেছ, তোমায় করি গো নমস্কার...’ আর প্রত্যুত্তরে অতুলপ্রসাদ গাইছেন, ‘ওগো আমার নবীন সাথী, ছিলে তুমি কোন বিমানে?’ দার্জিলিংয়ে টয়ট্রেনে গান বেঁধেছেন, আপনমনে গেয়েছেন মধুপুরে, শিমুলতলায়, সুন্দরবনে স্টিমারে। মামলার কাগজের ফাঁক থেকেও উদ্ধার হয়েছে অতুলপ্রসাদের গান।

লখনউয়ের নবাবি সাজে

রবীন্দ্রনাথ ওঁকে ভালবাসতেন খুব। ১৮৯৬ সালে রবীন্দ্রনাথ গড়েছিলেন ‘খামখেয়ালী সভা’, সদস্য ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল, মহারাজা জগদীন্দ্রনারায়ণ রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লোকেন্দ্রনাথ পালিত... আরও অনেকে। অতুলপ্রসাদ সর্বকনিষ্ঠ সভ্য। নিয়ম আর সময়ের ঘুড়ি ভোকাট্টা সেখানে; গানবাজনা, সাহিত্য— সবই হত মজার ঢঙে। অতুলপ্রসাদ নিজেই দিয়েছেন সেই আনন্দসভার বিবরণী: ‘খামখেয়ালীর মজলিসকে মজগুল রাখিতেন পরম হাস্যরসিক দ্বিজেন্দ্রলাল রায়... আমরা সকলে তাঁর হাসির গানের কোরাসে যোগ দিতাম, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কোরাসের নেতা। দ্বিজেন্দ্রলাল গাহিতেন— ‘হোতে পাত্তেম আমি একজন মস্ত বড় বীর’ আর রবীন্দ্রনাথ মাথা নাড়িয়া কোরাস ধরিতেন— ‘তা বটেইত, তা বটেইত’... অধিবেশন এক একজন সদস্যের বাড়ীতে হইত। যেদিন আমার বাড়ীতে অধিবেশন হয় সেদিন কবি বাড়ি গেলেন রাত্রি বারোটার পরে, মহারাজ নাটোর বাড়ি গেলেন একটা-দু’টার সময় আর দ্বিজেন্দ্রলাল ও আমরা কয়েকজন সারারাত কীর্তন শুনিয়া ও তাঁর হাসির গান শুনিয়া কাটাইলাম। তারপর দিন প্রাতে হাস্যরাজকে আমি বাড়ি পৌঁছাইয়া আসি। মনে আছে, তাঁর স্ত্রী বড়ই চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছিলেন...’

কুমায়ুনের রামগড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ, লখনউ থেকে ডেকে পাঠালেন অতুলপ্রসাদকে। পাহাড়ে প্রবল বর্ষা, দিন-রাত অঝোর বৃষ্টি। একদিন বর্ষার আসর বসল, বিকেল থেকে শুরু করে রাত দশটা পর্যন্ত চলছে কবির বর্ষার কবিতা পাঠ, বর্ষার গান। প্রতিমা দেবী খেতে ডাকছেন, ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। রবীন্দ্রনাথের গান-রচনারও সাক্ষী অতুলপ্রসাদ। ভোরে সূর্যোদয়ের আগে রবীন্দ্রনাথ বেরিয়ে পড়েছেন, অতুলপ্রসাদ লুকিয়ে পিছু নিলেন। দেখলেন, কবি গিয়ে বসেছেন একটি পাথরের উপরে, সামনে ভোরের আকাশ, অনন্ত হিমালয়। গুনগুন করে গান রচনা করছেন রবীন্দ্রনাথ, ‘এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর’। অতুলপ্রসাদ এই গানের জন্মক্ষণের গোপন প্রত্যক্ষদর্শী, আড়াল থেকে শুনে পালিয়ে এলেন ঘরে। দু’তিন দিন পরে কবি যখন ‘এই লভিনু’ গেয়ে শোনাচ্ছেন প্রকাশ্যে, অতুলপ্রসাদ বললেন, এই গান আমি আগেও শুনেছি। কবি তো অবাক! অতুলপ্রসাদ রহস্য ভাঙলে রবীন্দ্রনাথের প্রশ্রয়ী মন্তব্য, ‘তুমি ত ভারি দুষ্টু, এইরকম করে রোজ শুনতে বুঝি?’ রবীন্দ্রনাথ লখনউয়ে এসেছেন, তাঁর জন্মবার্ষিকীর সংবর্ধনা সভায় অতুলপ্রসাদ নিজে গান লিখে, তরুণ পাহাড়ী সান্যালকে সেই গান তুলিয়ে, গাইয়েছেন— ‘এসো হে এসো হে ভারতভূষণ...’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পরিশোধ’ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন অতুলপ্রসাদকে।

সেই যুগে ৩৩ হাজার টাকা দিয়ে লখনউয়ের কেশরবাগে বিরাট বাড়ি করেছিলেন অতুলপ্রসাদ। গাইয়ে-বাজিয়েদের আসর বসত সেখানে। বড় ভালবাসতেন ঠুমরি, নিজের গানে ঠুমরির চলন-ঠাট এনেছিলেন অনায়াস দক্ষতায়। দিলীপকুমার রায়, পাহাড়ী সান্যাল, সাহানা দেবীকে সেই গীতিসম্পদ শিখিয়ে, বিলিয়ে গিয়েছেন নিজে হাতে ধরে। কলকাতা তো বটেই, রামপুর, গ্বালিয়র, মথুরা, ইনদওর, কাশী, হায়দরাবাদ, সব শহরের তাবড় শিল্পীর ঠিকানা ছিল লখনউয়ে সেনসাহেবের বাড়ি। এসেছেন স্বয়ং বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডেজি ও তাঁর সুযোগ্য শিষ্য শ্রীকৃষ্ণরতনজানকার। শ্রীকৃষ্ণরতনজানকারের গলায় ‘ভবানী দয়ানী মহাবাক্‌বাণী’ শুনে অতুলপ্রসাদ ভৈরবীতে বেঁধেছিলেন ‘কে ডাকে আমারে/ বিনা সে সখারে রহিতে মন নারে!’ যেখানে ভাল গান, সুকণ্ঠের সন্ধান পেতেন, সেখানেই ছুটে যেতেন এই সংগীত-সন্ন্যাসী। সাহানা দেবী লিখেছেন, ‘গান শুনে অত খুশি হয়ে উঠতে (অন্য কাউকে) আমি কমই দেখেছি। কি যে করবেন ভেবে পেতেন না।’ অমল হোম তাঁকে বলেছেন ‘অক্লান্তকণ্ঠ’।

রবীন্দ্রনাথের অতুল-স্মরণ

গানের সঙ্গে ঘর-করা মানুষ নরমসরম হয়, কর্মী হয় না, এমন ভাবনার চল আছে বাঙালির মনে। অতুলপ্রসাদ ছিলেন এই ধারণার মূর্তিমান ব্যতিক্রম। পেশায় তিনি ব্যবহারজীবী, অওধ বার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনিই এই পদে প্রথম ভারতীয়। বিচারপতি আর আইনজীবীদের মন-কষাকষি সে যুগেও ছিল, তার জেরে লখনউ কোর্টের বদনামও হচ্ছিল। নিজের হাতে সামলে, আদালতের হৃত সম্মান ফিরিয়ে এনেছিলেন ব্যারিস্টার অতুলপ্রসাদ সেন। লখনউয়ে প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ধারাটি ফলবতী রাখতে শুরু হয়েছিল প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন (এখন নাম নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন)। লখনউ, ইলাহাবাদ, কাশী, নানা শহরে হত প্রবাসী বাঙালিদের সভা। বাংলা থেকে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ সহ বহু সারস্বত। অতুলপ্রসাদ ছিলেন এই সাহিত্যযজ্ঞের ঋত্বিক। গুণিজনসংবর্ধনার আয়োজন করেছেন, সভামুখ্য হয়েছেন। সাহিত্য সম্মেলনের পত্রিকা ‘উত্তরা’ প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন নিজের অর্থ দিয়ে। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য, উপাচার্য থেকে অধ্যাপক সকলেই তাঁর গুণমুগ্ধ। লখনউয়ের রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের সঙ্গে যোগ ছিল গভীর। সেবাশ্রমে বাবা-মায়ের নামাঙ্কিত ‘রামপ্রসাদ হল’, ‘হেমন্তশশী শুশ্রূশালয়’ তৈরি করে দিয়েছিলেন নিজ ব্যয়ে, উদ্বোধনের দিন নিজে কীর্তন গেয়েছিলেন। রোগীদের জন্য বেঙ্গল কেমিক্যাল থেকে কয়েকশো টাকার ওষুধ আনিয়ে দিয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আনুকূল্যে। মৃত্যুর আগে নিজের ইচ্ছাপত্রে মাসিক ২৫ টাকা বরাদ্দ করে গিয়েছেন সেবাশ্রমের ওষুধের জন্য! কলকাতায় মা সারদার কাছে এসেছিলেন, জানিয়ে গিয়েছিলেন অন্তরের প্রার্থনা, যন্ত্রণা।

তাঁর দাম্পত্যজীবন দীর্ণ ছিল যন্ত্রণায়। স্ত্রী হেমকুসুম লখনউতেই দীর্ঘকাল আলাদা বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। অতুলপ্রসাদ তাঁর মা হেমন্তশশীকে নিজের কাছে এনে রাখতে চান, রেখেওছেন, তাতে হেমকুসুমের রাগ। অতুলপ্রসাদ সবার এত কাছে, কাজে থাকেন, তাঁর কাছে থাকেন না, তাই অভিমান। অথচ দু’জনের মধ্যেই ভালবাসার পূর্ণপাত্র। এমনও হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনা, হেমকুসুম এসে সমস্ত আয়োজন করেছেন হাসিমুখে নিজে হাতে, অনুষ্ঠান-শেষে ফিরে গিয়েছেন অভিমানী ভাড়াবাড়িতেই, অতুলপ্রসাদের ঘরে নয়। সুশিক্ষিতা হেমকুসুমের গলায় বিচ্ছেদকালে ঠাঁই পেত অতুলপ্রসাদেরই গান। অতুলপ্রসাদও বহু বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন চোখের জলে, গান লিখে-গেয়ে। গ্যেটেকে উদ্ধৃত করে দিলীপকুমার রায় লিখেছেন, ‘গভীর দুঃখ পাওয়াও সার্থক যদি সে-দুঃখে একটি গানও ফুটে ওঠে আঁধারে তারার মতো।’ অতুল-আকাশ ভরা ছিল অগণিত গীতি-নক্ষত্রে।

তবু হাসতেন, হা-হা করে। প্রিয় বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘‘আমি কি প্রার্থনা করি ভগবানের কাছে জান? শ্মশানে যেদিন আমাকে নিয়ে যাবে সেদিন চিতায় শুয়ে হঠাৎ যেন সকলের দিকে চেয়ে একবার হেসে তবে চোখ মুদি।’’ ২৫ অগস্ট ১৯৩৪-এর গভীর রাতে মৃত্যু এল। সকালে গোটা লখনউ ভেঙে পড়েছিল শোকে। শ্রাদ্ধবাসরে আচার্য ছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। শোকসভায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন আসল কথাটি, ‘‘তাঁর দয়া, দান, দাক্ষিণ্য জানাবার লোক এ-সভায় নেই— তাঁরা অত্যন্ত গরীব— অখ্যাত অজ্ঞাত অজানা লোক। তাঁরা যদি আসতে পারতেন, তাহলে বলতেন কত বিপদের মধ্য দিয়ে নিঃশব্দে অতুলপ্রসাদ দিয়েছেন।’’ অলক্ষ্যে তখন বুঝি বাজছিল: সবারে বাস্‌ রে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবে না রে...

Atul Prasad Sen Lawyer Singer Lyricist Composer অতুলপ্রসাদ সেন
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy