‘অর্গান’-এর নির্দেশনায়, পাশে কন্যা চৈতী ঘোষাল
মানিকদার ‘চারুলতা’ করতে গিয়েই ওঁর সঙ্গে আলাপ। সে ষাটের দশকের মাঝামাঝি হবে।
কিছু দিনের মধ্যেই বুঝে গিয়েছিলাম, নষ্টনীড়-এর উমাপদ যদি উত্তরের হন, তাঁর চরিত্রে অভিনয় করা মানুষটি একেবারে দক্ষিণের।
উমাপদ চারুর ভাই। ভূপতির শ্যালক। তাঁর ‘সেন্টিনেল’ পত্রিকার ম্যানেজার। ধূর্ত, স্বার্থপর। এক সময় যে ভূপতির টাকা আত্মসাৎ করে পালায়। এতটাই ধড়িবাজ। ও দিকে মাটির মানুষ বলতে যা বোঝায় শ্যামলবাবু ঠিক তাই। এত কোমল মনের মানুষ ইন্ডাস্ট্রিতে খুব কমই দেখেছি।
পুলিশে চাকরি করতেন। তখন সত্তর দশক। নকশাল আন্দোলন। হঠাৎ একদিন বললেন, “চাকরিটা ছেড়ে দিলাম, জানেন।” আঁতকে উঠলাম, “সে কী, কেন?”
বললেন, “ধরে ধরে বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেদের মেরে ফেলা আর মেনে নিতে পারছি না।” মানসিক ভাবে খুব বিধ্বস্ত ছিলেন, বুঝে আমি প্রায়ই ঠাট্টা করে ওঁকে বলতাম, “বেশ করেছেন ছেড়েছেন, আপনাকে একেবারেই পুলিশ হিসেবে মানতে পারা যায় না।”
সত্যি, ওঁর সঙ্গে যত আলাপ হয়েছে তত মনে হয়েছে ‘কাঠিন্য’ শব্দটা ওঁর থেকে অনেক অনেক দূরের।
এত গুণ ছিল মানুষটার! অভিনয় তো ছিলই। রাগসঙ্গীত জানতেন। আবৃত্তি করতেন। অর্গান বাজাতে পারতেন। সেতারও। মঞ্চে অভিনয় করতেন। নিজের দল ছিল। ‘অর্গান’ নামে একটা ছবি করেছিলেন। বছর তিরিশ-চল্লিশ আগে আরও এক বার অন্য একটা ছবিও বানাবেন ভেবেছিলেন। যদ্দুর মনে আছে, গল্পটা কোলিয়ারির ওপর। তার যে কী হল, জানি না।
এক সময় থাকতেন সালকিয়ায়। ওঁর কাছাকাছি থাকতেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, অনল চট্টোপাধ্যায়রা। ফলে আশেপাশে একটা গানের পরিবেশ ছিল। সেই সময়কার শ্যামলবাবুর গল্প শুনেছি, শুধু সেতার শিখবেন বলে যন্ত্রটাকে কাঁধে নিয়ে বাড়ি থেকে বহু দূরে বোটানিকাল গার্ডেন পেরিয়ে কোথায় একটা যেতেন, নিয়ম করে। এই মানুষ কী করে পুলিশের চাকরি করতে পারেন!
আমি যখন লেক গার্ডেন্সে শ্বশুরবাড়িতে থাকতাম, কাছেই একটা বাজারে প্রায়ই যেতাম। ওখানে মাঝে মধ্যেই ওঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। উনি তখন বোধ হয় ওদিকেই চলে এসেছেন। রাস্তায় দাঁড়িয়েই দাঁড়িয়েই অনেকক্ষণ আড্ডা হত আমাদের। সে একেবারেই ঘরোয়া কথা। মেয়েকে (চৈতী) নিয়ে এক সময় খুব চিন্তায় ছিলেন। সে সব কথাও বলতেন।
এমনিতে খুব হাসিখুশি। কিন্তু ঘাড়টা বোধহয় একটু বেশিই শক্ত ছিল। নোয়াতে ব্যথা লাগত। তাই যা হয়, যতটা ক্ষমতা ছিল, তার তুলনায় কাজ কমই পেয়েছেন। তাই মাঝে মধ্যেই খুব হতাশায় ভুগতেন। এই স্বভাবটা আমারও ছিল, উনি বোধহয় বুঝতে পারতেন। তাই আমাকে বলে হয়তো একটু হাল্কা হতেন।
তবে যা পেয়েছেন, তাতেই কিন্তু ‘জাত’ বুঝিয়েছেন। খলনায়ক হিসেবে পরিচিতি থাকলেও এত ধরনের চরিত্র না হলে কিছুতেই করতে পারতেন না। প্রথম ‘ব্যোমকেশ’ তো ওঁরই করা। এর পর একে একে দেখুন, ঋত্বিক ঘটকের সুবর্ণরেখার সাংবাদিক থেকে ‘চিড়িয়াখানা’র ভুজঙ্গডাক্তার। এর পাশাপাশি ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’, ‘রাতের রজনীগন্ধা’, ‘বিলম্বিত লয়’, ‘পার’...।
অদ্ভুত একটা চাউনি ছিল ওঁর। ভ্রু’টা অল্প একটু বাঁকিয়ে ঠান্ডা চোখের দৃষ্টি। যেটা মানিকদা অসাধারণ কাজে লাগিয়েছেন ‘চারুলতায়’য়। পান চিবোতে চিবোতে ‘ম-ন্দা-কি-নী’, ‘ম-ন্দা-কি-নী’ বলে স্ত্রীকে ডাক, কিছুতেই যেন ভোলার নয়। কিংবা সেই যে “তুমি মন্দা, আমি মন্দ”।
একেবারে সংলাপহীন জায়গাতেও অনবদ্য লাগে ওঁকে। ‘চারুলতা’-র একটা দৃশ্যের কথা মনে করতে পারি, ‘লিবারেল পার্টি’ যখন জিতেছে, ঘরের ভেতর মোচ্ছব চলছে, আর উমাপদ শ্যেন দৃষ্টি মেলে দরজায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে তা-ই দেখে চলেছে। শীতল, কঠিন ওঁর সেই দাঁড়িয়ে থাকা। যদিও মানিকদার আঁকা ছবি আর নির্দেশকে হুবহু অনুসরণ করতেন, তবু পাকা অভিনেতা না হলে অমনটা করে দেখানো কিন্তু খুব শক্ত কাজ।
বহু দিন ওঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। জানতাম অসুস্থ। কিন্তু দেখা করতে যাওয়া হয়নি। একবার একটা সিনেমা হলে অনুষ্ঠান হল। শ্যামলবাবুর স্ত্রী আর চৈতী এসেছিল। তখন ওঁর খবর পেয়েছিলাম।
আর শেষ খবরটা পেলাম পি ফিফটি ওয়ান স্টুডিয়োয় শ্যুটিং করতে গিয়ে। বসে বসে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলাম। হঠাৎ নজরে এল দুঃসংবাদটা। চৈতীর নম্বরটা হাতের কাছে ছিল না। আমার মেকআপম্যান জোগাড় করে দিল। ফোন করে জানলাম, ও দিনও নাকি শ্যুটিং যাওয়ার সময় চৈতী যখন দেখা করতে গিয়েছিল, তখনও বলেছেন, “আমি ভাল আছি, চিন্তা কোরো না, তুমি তোমার কাজে যাও।”
তার কিছু বাদেই তো সব শেষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy