Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ছোট্ট দার্জিলিং

‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির ছোট্ট নেপালি ছেলেটিকে খুঁজে পাওয়া গেল। তিনি এখন প্রবীণ মানুষ।১৯৬২ সালে সত্যজিৎ রায় ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিটি তৈরি করেন। ছবিতে, একটি সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের সদস্যরা কলকাতা থেকে দার্জিলিং-এ বেড়াতে আসেন। তাঁদের কয়েক জন পরিচিত লোকও আসেন। পরিবারটির কেন্দ্রে যাঁর অধিষ্ঠান, তিনি প্রবল প্রতাপশালী গৃহকর্তা, রায়বাহাদুর ইন্দ্রনাথ চৌধুরী। তিনি আর একটি চরিত্রকে বলেন, ‘ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের অবদানকে খর্ব করার সাহস যারা করে, তুমি কি তাদের এক জন?

প্রবুদ্ধ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৫ ০১:৩৮
Share: Save:

১৯৬২ সালে সত্যজিৎ রায় ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিটি তৈরি করেন। ছবিতে, একটি সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের সদস্যরা কলকাতা থেকে দার্জিলিং-এ বেড়াতে আসেন। তাঁদের কয়েক জন পরিচিত লোকও আসেন। পরিবারটির কেন্দ্রে যাঁর অধিষ্ঠান, তিনি প্রবল প্রতাপশালী গৃহকর্তা, রায়বাহাদুর ইন্দ্রনাথ চৌধুরী। তিনি আর একটি চরিত্রকে বলেন, ‘ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের অবদানকে খর্ব করার সাহস যারা করে, তুমি কি তাদের এক জন? এই বিরাট দার্জিলিং শহরটাকে কে বানিয়েছে জানো? এই যে তুমি হাওয়া বদলাতে এসেছো— আরও কত লোক আসছেন... ছিল তো লেপচাদের একটা ছোট্ট গ্রাম। এটা কে বানিয়েছে জানো? One man’s work- one Britisher— ডক্টর ক্যাম্পবেল।’

শেরিং শেরপা: এখন যেমন।

প্রায় এই সংলাপের উলটো দিকে অবস্থান করে ছবির আর এক চরিত্র— একটি ছোট্ট ছেলে, সে দার্জিলিঙের অধিবাসী। ছবিতে আছে সে মাত্র কয়েক মুহূর্ত, কিন্তু সত্যজিতের ট্রিটমেন্ট এবং ছেলেটির গলায় একটি আশ্চর্য মিষ্টি নেপালি গানের দৌলতে, সে ছবিটির একটি প্রধান চরিত্রই হয়ে ওঠে প্রায়। যে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ দেখেছে, সে-ই এই ছেলেটির কথা ভোলেনি। ছেলেটির গাওয়া গান, বিভিন্ন মাত্রায় সেই গানের সম্প্রসারণ এবং আবহ সুর হিসেবে এই সুরের নির্যাসটুকুর প্রয়োগ এই ছবিতে অনেক না-বলা-কথা বলে দেয়। এই গানটি যেন প্রকৃতপক্ষে দার্জিলিং— গোটা পাহাড়ের যাপনচিত্র— তার গল্প। ‘ছিল তো একটা লেপচাদের গ্রাম!’ তা হলে দার্জিলিং কাদের? উড়ে এসে জুড়ে বসা ইংরেজ ঐতিহ্যের? ওই ছেলেটির মুখ একটা ইমেজ হয়ে ভেসে থাকে দর্শকের মনে— এক ধরনের অনুপস্থিতির উপস্থিতি হয়ে। গল্পের শেষে, মনীষার জন্য বহন করা চকোলেটটি ব্যানার্জি দিয়ে দেন ছেলেটিকে। অস্ফুটে একটা ঘোষণা উচ্চারিত হয়— ‘নে, তোরই জিত’। ছবির ক্রেডিটে ছেলেটির নাম— গুঁইয়ে।

একদিন হঠাৎ, দার্জিলিঙের রাস্তায় খুঁজে পেলাম এই গুঁইয়েকে, এক স্থানীয় বন্ধুর সহায়তায়। তাঁর প্রকৃত নাম শেরিং শেরপা। এখন তিনি একজন প্রবীণ মানুষ। তবুও তাঁর মুখটি দেখে, তাঁর হাসিটি দেখে, বালক গুঁইয়েকে চেনা যায়। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়িতে। ট্যুরিস্ট-সংকুল দার্জিলিঙের প্রায় অগোচরে একটা পুরনো পাড়া। ছোট-রেলের বাঁক পেরিয়ে একটা সরু রাস্তা নেমে গিয়েছে ঢাল বেয়ে। কোনও বাড়ি রাস্তার ধারে কাঠের ঠেকনা দেওয়া, কোনওটা তাড়াহুড়ো করা ইট-সিমেন্টের। যেতে যেতে এই শেরিং শেরপার সঙ্গে অনেকেরই কিছু না কিছু কথা হয়। তিনি পাড়ার সবার কাছে পরিচিত ‘আপা’ নামে। সবার কাছেই তাঁর মান্য উপস্থিতি বেশ টের পাওয়া যায়। একটু অন্ধকার মতো কংক্রিটের সিঁড়ি বেয়ে কয়েক ধাপ নামলেই তাঁর ঘর— স্ত্রী-কন্যা-পুত্র-পুত্রবধূ ও তাদের সন্তানেরা— এক জমজমাট পরিবেশ। সবার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিয়ে শেরিং শেরপা মগ্ন হয়ে গেলেন পুরনো দিনের কথায়।

দার্জিলিং মলের নীচেই বাজার। ষাটের দশকের শুরু। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে বেঢপ ইজের আর ছেঁড়া জামা পরা একটি ছেলে। হাতে লাট্টু ও লেত্তি। তখন দার্জিলিংটাই অন্য রকম ছিল। ফাঁকা ফাঁকা। অনেক গাছপালা। বাড়িঘর তেমন নেই, তাই দৃষ্টি চলে অনেকখানি। সত্যজিৎ একজন সহকারীর সঙ্গে ঘোরাঘুরি করছিলেন। হঠাৎই চোখে পড়ল ছেলেটিকে। ছেলেটির ব্যস্ত হাতের লাট্টুটাকে। ছেলেটির সঙ্গে সত্যজিৎ কথাবার্তা বললেন, যে-ভাবে তিনি শিশুদের সঙ্গে কথা বলেন, এক জন প্রাপ্তবয়স্কের মতো। বললেন, ‘আমরা একটা সিনেমার শুটিং করছি চৌরাস্তায়। আসবে এক বার বিকেলে? তোমাকে খুবই দরকার।’ কী মনে হল, ছেলেটি মাথা নেড়ে সায় দিল। বিকেলবেলায় একটু দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে চৌরাস্তায় (ম্যালে) গেল ছেলেটি। দীর্ঘকায় মানুষটির সঙ্গে ফের দেখা। ছেলেটিকে বিস্কুট ও মিঠাই দেওয়া হল। ‘হিরোইন’ তাকে একটু আদর করলেন। সত্যজিৎ জিজ্ঞেস করলেন— ‘গান গাইতে পারো?’ ছেলেটির সপ্রতিভ জবাব— ‘হ্যাঁ পারি, তবে নেপালি গান।’ ‘সেই গানই তো ভাল। চলো তো, এক বার গাইবে!’ ছেলেটিকে নিয়ে যাওয়া হল একটি ঘরে। সেখানে নানা বাক্স ও যন্ত্রপাতি, সত্যজিৎ গুঁইয়েকে গাইতে বললেন, তার পর সেই গানটিকে গেয়ে গেলাম আমরা। যা ওই এক বারই রেকর্ড করা হয়েছিল।

‘তিম্র সিউদো সিউদো মা সিন্দুর লে মানতাওলা/ মন খোলি হাঁস লাও লা—/ কৌয়ালিলে গীত গাওন্দে সনদেশ শুনাও দে/ মন খোলি হাঁস লাও...লা।’ এ বার গুঁইয়েকে চমকে দিয়ে শোনানো হল রেকর্ড করা তারই গানটি।

ছেলেটি সঙ্গ নিল সত্যজিতের ইউনিটের। পাহাড়ের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। রোজ ইউনিটের গাড়ি আসত সকাল সাতটায় তাকে নিয়ে যেতে। ইচ্ছে থাকলেও পরবর্তী জীবনে আর অভিনয়ের সুযোগ আসেনি কোনও ফিল্মে। তাই কমবেশি ষাট বছরের জীবনে তেমন ঘটনা বলতে ওই ছেলেবেলার অংশটুকু। সত্যজিৎ নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তাকে কলকাতায় নিজের কাছে, কিন্তু গুঁইয়ের বাবার আপত্তিতে তা ধোপে টিকল না। সত্যজিৎ নিয়ে আসেন তার ছেঁড়া জামা, আর সেই মাপে পাঠিয়ে দেন নতুন জামা প্যান্ট ও স্যুট।

হোটেলের কাজের ব্যস্ততা, ট্যুরিস্টদের দেখাশোনা করার মাঝে এই প্রবীণ মানুষটি কয়েক দিন অন্তর তাঁর স্বজনদের সঙ্গে বসেন তাঁর স্মৃতিটি নিয়ে— ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিটা নিয়ম করে সবাই দেখেন। তার পর এ-কথা সে-কথা। ব্যানার্জি-মনীষার পিছু নেওয়া, পাহাড়ি পথে মালবাহী খচ্চরের গলায় ঘণ্টাধ্বনি— কোথায় কী ভাবে নেওয়া হল সেই দৃশ্য, শেষকালে ‘বুঢ্ঢা আদমি’ ও ‘বেচারা’ ছবি বিশ্বাসের কাউকে খুঁজে না পাওয়া, অবশেষে বালকটির ‘ক্যাডবেরি’ প্রাপ্তি ও তার মোড়ক খুলে ফেলা ও নেপালি সংগীতটি। ছবিতে লোকেশন হিসেবে রাস্তার প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি অঞ্চল তাঁর মুখস্থ, মায় স্ক্রিপ্টের খানিকটা অংশও। টিভিতে বালকটি ব্যানার্জির পেছনে পেছনে হেঁটে দু’পয়সা চায়। তাঁর পরিবারের সবাই হেসে ওঠে। হাসেন না ওই মানুষটি। তাঁর দু’চোখে ছায়া নেমে আসে, বিষণ্ণতার, নির্জনতার।

prabuddha_b@hotmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE