Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

চানাচুরতন্ত্র

ঝুরিভাজা, ডালমুট, কাঠিভাজা, সবাই যে যার ধর্মে থিতু। সেটাই প্রকৃত গণতন্ত্র। কে কী খাবে কপচানো নয়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঝুরিভাজা, ডালমুট, কাঠিভাজা, সবাই যে যার ধর্মে থিতু। সেটাই প্রকৃত গণতন্ত্র। কে কী খাবে কপচানো নয়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

চানাচুরের সঙ্গে আমি ভারতীয় গণতন্ত্রের বেশ মিল পাই। এক মুঠো চানাচুর হাতের মুঠোয় নিয়ে যদি ভাল করে নিরীক্ষণ করা যায়, তা হলে গণতন্ত্র চিজটি কী, তা খানিকটা মালুম হয়। হয়তো ঝুরিভাজার বগলের তলা দিয়ে ডালমুট উঁকি মারছে, বাদামের গা ঘেঁষে কিসমিস ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে, আধখানা কাজুর কোলে নিশ্চিন্তে বসে আছে পাপড়ি, গাঠিয়ার সঙ্গে পাঞ্জা কষতে লেগেছে কাঠিভাজা। মুখে ফেললেও বিচিত্র স্বাদ। টক, ঝাল, মিষ্টি গন্ধেও মিশ্র এক ককটেল। যেন হিন্দু, মুসলমান, শিখ, জৈন, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সব মিলেজুলে ভাই ভাই। আর ভাগ কি শুধু ধর্মে? কেউ তামিল, কেউ তেলুগু, কেউ মালয়ালি বা মরাঠি, পাঞ্জাবি বা বিহারি, বাঙালি বা অসমিয়া। ভাগ করতে বসলে নানা ক্যাটাগরিতে ভাগাভাগি শেষ হবে না। এত বিভাজন নিয়েও রবি ঠাকুরের ভাষায় ভারতের বিচিত্র জনগণ ‘এক দেহে হল লীন’।

‘লীন’ কথাটা লক্ষ করে দেখলে মালুম হয় যে, লীন মানে ‘বিলীন’ নয়। অর্থাৎ, চানাচুরের কাজু ডালমুট হয়ে যাচ্ছে না, চিনেবাদাম বাদামত্ব বিসর্জন দিয়ে কিসমিসে রূপান্তরিত হয়ে যায়নি বা কাঠিভাজা হয়ে যায়নি পাপড়ি। যে যার ধর্মে থিতু হয়ে আছে। কোনও আহাম্মক যদি মিক্সিতে ফেলে চানাচুরকে পেষাই করে, তা হলেই চানাচুরের সর্বনাশ এবং ধর্মনাশ। তাই গণতন্ত্রে একঢালা বন্দোবস্ত চলে না। কে কী খাবে, কী পরবে, কার উপাসনা করবে, তা তাকেই ঠিক করতে দেওয়া ভাল।

যে সারা ক্ষণ বসে থাকে, তাকে যদি কেউ এসে বলে, ‘ওহে, তোমাকে আগামী এক ঘণ্টা একদম চুপচাপ বসে থাকতে হবে,’ তা হলেই তার সমস্যা শুরু। ওই এক ঘণ্টা তার প্রবল উসখুস। তার বাথরুম পাবে, ছাদে যেতে ইচ্ছে করবে, হাঁটুতে ব্যথা হবে। অর্থাৎ, আপনমনে চুপচাপ বসে থাকা এক জিনিস। সেটা নিজের ইচ্ছাধীন। অন্য কেউ যেই কিছু চাপান দিল, সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে অনিচ্ছেরা চাগাড় দিয়ে ওঠে। সোজা কথা, হঠাৎ কেউ জবরদস্তি কোনও একটা অনুশাসন চাপিয়ে দিলে মানুষের নানা বিপন্নতা দেখা দেয়।

কথা ছিল, বেআইনি কসাইখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে। তা শুধু কসাইখানা কেন মশাই, বেআইনি, অবৈধ সব কিছুই তো বন্ধ করা উচিত। আর বেআইনি কসাইখানা বন্ধ করতে গিয়ে পুলিশ-প্রশাসন সম্ভবত কর্তাকে খুশি করতেই বৈধ-অবৈধ নির্বিশেষে সব কসাইখানাই বন্ধ করে দিয়েছে। ত্রাহি রব ওঠারই কথা। উঠেছেও। আর ব্যাপারটা ছড়িয়ে গিয়েছে আরও কয়েকটা রাজ্যেও।

আরও পড়ুন: কে সভ্য, কে বর্বর বলে গেছেন রামনাথ বিশ্বাস

আদিতে, অর্থাৎ প্রস্তরযুগেরও আগে মানুষ আমিষাশী ছিল, না নিরামিষাশী? বলা শক্ত। বিশেষজ্ঞেরা হয়তো জানেন। তবে অনুমান হয়, মানুষের দাঁত-নখের তেমন জোর না থাকায় এবং বাঘ-সিংহের মতো দ্রুত দৌড়নোর ক্ষমতার অভাবে শিকার করার সাধ্য তার ছিল না। আর বানরেরা তো আমিষাশী নয়ও। হয়তো ঘটনাক্রমে মানুষ সর্বভুক হয়েছে। আমিষ ধরেছে। নিরামিষও ছাড়েনি।

মানুষের হাল, গতিপ্রকৃতি কোন দিকে, তা এখনও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু একটু হলেও নিরামিষের প্রতি প্রশ্রয় যে বেড়েছে, তা অনুমান করা যায়। কারণ, আজকাল ডাক্তাররা রোগভোগের বিচিত্র ঠিকানা দেখে মানুষকে মাঝে মাঝে নিরামিষাশী হতে বলছেন। স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানীদের মুখেও শোনা যাচ্ছে, নিরামিষ অনেকটা নিরাপদ আহার।

তবে, এ ব্যাপারে কোনও জবরদস্তি তো চলে না। ভাল কথাও চোখ পাকিয়ে বললে মানুষ উলটো অর্থ ধরে। আর ধর্মের দোহাই তো আরও অচল। সুতরাং যে যার ধর্মে থিতু থাকুক, গণতন্ত্রে এটাই কাম্য।

এ দেশটা একটু বিচিত্র। যাঁরা পশুক্লেশ নিবারণের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁরা দিব্যি মাছ-মাংস খান। যাঁরা কুকুর, বেড়াল ইত্যাদি পোষ্যের জন্য জান-কবুল, তাঁরা যখন মাছ-মাংস খান, তখন ভুলে যান যে, অন্য কোনও পশুকে বধ করেই তাঁর মাংসের জোগান আসছে। এ দেশে প্রবল গাঁধীবাদী নেতারও প্রিয় ছিল পাঁঠার মাংসের ঝোল। তা এ সব তো হতেই পারে। আর সেই জন্যই গণতন্ত্রকে হজম করা বেশ শক্ত ব্যাপার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Shirshendu Mukhopadhyay Snacks
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE