ভ্রমণপিপাসুদের একাংশের কাছে অরণ্য সব সময়েই নতুন আঙ্গিকে ধরা দেয়। পাহাড়, সমুদ্রের পাশাপাশি জঙ্গলের সঙ্গে বাঙালি পর্যটকের রোম্যান্স প্রাচীন। অনেকেই প্রতি বছর জঙ্গলে ঘুরতে যান। আবার জঙ্গল যেন তাঁর সৌন্দর্যের আকর্ষণেই নতুন পর্যটক বৃত্ত তৈরি করে নেয়। দেশে বা বিদেশে সংরক্ষিত অভয়ারণ্যে পা রাখার জন্য বেশ কিছু নিয়মাবলি রয়েছে। কিন্তু তা অনেক ক্ষেত্রেই ‘নির্দেশিকা’ হিসেবেই রয়ে যায়। পর্যটকদের সঙ্গে নতুন করে নিয়ম-নীতিগুলির পরিচয় করিয়ে দিলেন অরণ্যপ্রেমী অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী।
গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য ভাবে পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভান্ডারের ক্ষতি হয়ে চলেছে। তাই অভয়ারণ্যগুলিকে সংরক্ষণের জন্য দেশের সরকারের তরফেও কড়া আইন জারি রয়েছে। অল্প বয়স থেকেই ভ্রমণের নেশা সব্যসাচীর। অভিনয়ের পাশাপাশি এখনও নিয়ম করে দেশ-বিদেশের জঙ্গলে ঘুরতে যান। কিন্তু দায়িত্বজ্ঞানহীন পর্যটক তাঁর চক্ষুশূল। সব্যসাচী মনে করেন, জঙ্গলকে রক্ষা করতে হলে শুধু কিছু নিয়ম জারি করেই লক্ষ্যপূরণ হবে না। বরং তার জন্য চাই শিক্ষার বিকাশ। এ ক্ষেত্রে শহর এবং গ্রামের পাশাপাশি সব্যসাচী জোর দিতে চাইছেন জঙ্গল সংলগ্ন জনগোষ্ঠীর দিকে। তিনি বলছিলেন, ‘‘অল্প বয়সে অনেককেই দেখেছি স্কুলে যাচ্ছে। কিন্তু একটা সময়ের পরে উপার্জনের তাগিদে তারা পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। বন্যপ্রাণ এবং অরণ্য সংরক্ষণের বার্তা অল্প বয়সে মনে না গেঁথে দিলে ক্ষতি হতেই থাকবে।’’

মধ্যপ্রদেশের পেঞ্চ জাতীয় উদ্যানে সব্যসাচী। ছবি: সংগৃহীত।
কেনিয়া-তানজ়নিয়ার মতো আফ্রিকার একাধিক এলাকার জঙ্গলে ঘোরার অভিজ্ঞতা রয়েছে সব্যসাচীর। ভারতের সঙ্গে সেখানকার অরণ্য সংলগ্ন বসবাসকারী শিশুদের শিক্ষার পার্থক্য তাঁর চোখে ধরা পড়েছে। উদাহরণ হিসেবে বললেন, ‘‘জঙ্গলে প্রবেশের আগে মাসাই শিশুদের জন্য কিছু খাতা আর পেনসিল কিনেছিলাম। একজন কে ডেকে ‘লায়ন’ বানান জিজ্ঞাসা করলাম। সঙ্গে সঙ্গে বলে দিল।’’ বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গ সব্যসাচীকে হতাশ করেছে। ভাগ করে নিলেন বাড়ির কাছে সুন্দরবনের অভিজ্ঞতা। সব্যসাচীর কথায়, ‘‘শিশুদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তারা কেন স্কুলে যায়। সবাই চুপ। স্কুল যেতে ভাল লাগে কেন? উত্তর এল, ‘খাবার পাই তাই।’ শুনে সত্যিই খারাপ লেগেছিল।’’ লায়ন এবং বাঘের বানানকে কেন্দ্র করেই যে একটি প্রজন্ম জঙ্গল থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, তা সব্যসাচীকে প্রতিনিয়ত ভাবাচ্ছে।
নতুন প্রজন্ম এখন চটজলদি সাফল্য ছুঁতে চায়। সব্যসাচীর মতে, ছোট থেকেই অভিভাবকেরা সন্তানের মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং লক্ষ্যমাত্রার বীজ বপন করে দিচ্ছেন। তিনি বললেন, ‘‘অর্থ অবশ্যই প্রয়োজনীয়। কিন্তু তার থেকেও আগে প্রয়োজন শান্তি। আর শিক্ষা ছাড়া সেটা সম্ভব নয়।’’ সব্যসাচীর আশঙ্কা নতুন প্রজন্ম ‘মানুষ’ না হয়ে উঠলে, তার আচরণও প্রতিফলিত হবে জঙ্গলের প্রতি। তিনি বললেন, ‘‘জঙ্গলে প্রবেশ করে নিজস্বী তোলা, চিৎকার করা বা আবর্জনা ফেলে আসা— বন্ধ হবে না!’’
১৯৭২ সালে ভারতে বণ্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন প্রনয়ণ হয়। কিন্তু আইন ভঙ্গকারীদের ক্ষেত্রে আরও কঠোর শাস্তির দাবি জানালেন সব্যসাচী। তাঁর কথায়, ‘‘চোরাশিকার এবং সংলগ্ন অপরাধের জন্য আফ্রিকার একাধিক দেশে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এখানেও এমন আইন তৈরি করতে হবে, যা মনের মধ্যে ভয় তৈরি করবে।’’
সব্যসাচীর মতে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে বনকর্মীদের বেতন বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে, তাঁরা আরও বেশি জঙ্গলের সুরক্ষার প্রতি নজর দেবেন। অর্থের লোভে কোনও অসৎ কাজ বা অপরাধ সংগঠিত হতে দেবেন না। সব্যসাচীর কথায়, ‘‘সময়ের সঙ্গে জঙ্গলে আরও বেশি নজরদারি বাড়ানো উচিত।’’ পর্যটকদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে জঙ্গলে প্রবেশের প্রয়োজনীয় অনুমতি দেওয়া উচিত বলে মনে করেন সব্যসাচী। তাঁর কথায়, ‘‘এর ফলে জঙ্গলে ‘অযোগ্য’ পর্যটকের সংখ্যা কমবে এবং জঙ্গলও সুরক্ষিত থাকবে।’’
আরও পড়ুন:
জঙ্গলে ভ্রমণের জন্য সব্যসাচীর টিপ্স
১) সবার আগে ধৈর্য প্রয়োজন। চুপ থাকতে জানতে হবে। জঙ্গলে কথা বললেও উচ্চ স্বরে নয়। কারণ, মাথায় রাখতে হবে, জঙ্গল হল পশু-পাখিদের বাড়ি। মানুষ সেখানে অনধিকার প্রবেশ করে। তাই জঙ্গলে প্রবেশ করার আগে সব্যসাচীর কথায়, ‘‘গল্প-আড্ডাকে এনট্রি গেটের বাইরে রেখে আসা উচিত’’।
২) জঙ্গলে ঘুরতে গেলে উজ্জ্বল বর্ণের পোশাক পরা উচিত নয়। পাশাপাশি, উগ্র কোনও সুগন্ধি ব্যবহার করা উচিত নয়। তার ফলে পশু-পাখিদের দৃষ্টি আকর্ষিত হতে পারে। অনেক সময়েই তা সাইটিংয়ে সুবিধা করে দেয়।
৩) জঙ্গলের প্রবেশ পথে এবং ভিতরেও পর্যটকদের জন্য একাধিক নির্দেশিকা থাকে। সম্ভাব্য সাইটিং বিষয়ক তথ্যও বোর্ডে দেওয়া থাকে। সব্যসাচীর মতে, তা আগে সময় করে পড়ে নেওয়া উচিত। তার ফলে কৌতূহল নিরসন হয়। তার পরেও প্রশ্ন থাকলে সঙ্গের গাইডের থেকে জেনে নেওয়া যেতে পারে।
৪) সংরক্ষিত অভয়ারণ্যে প্লাস্টিক নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ। কারণ, তা থেকে পশু-পাখির মৃত্যু হতে পারে। সব্যসাচীর কথায়, ‘‘এখনও ভুল করে প্লাস্টিক খেয়ে প্রচুর পশুর মৃত্যু হয়। আমার তো মনে হয় জঙ্গলে প্রবেশের আগে পর্যটকদের সঙ্গে থাকা প্লাস্টিকের ছবি তোলা উচিত এবং বেরোনোর সময়ে তা না মিললে, মোটা টাকা জরিমানা করা উচিত।’’ একই সঙ্গে যোগ করলেন, ‘‘আবার অন্যদের ফেলে আসা প্লাস্টিক কেউ তুলে নিয়ে এলে, তাদের ক্ষেত্রে সাফারিতে ছাড়ও দেওয়া যেতে পারে।’’

ওড়িশার ভিতরকণিকা জাতীয় উদ্যানে পরিবারের সঙ্গে সব্যসাচী। ছবি: সংগৃহীত।
৫) বেশির ভাগ অভয়ারণ্যে জল এবং শুকনো খাবার নিয়ে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। অনেক সময়ে ট্যুর অপারেটরদের তরফেও খাবারের ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানেই ফেলা উচিত। সব্যসাচী বললেন, ‘‘সাফারির গাড়িতে ডাস্টবিন থাকে। যত্রতত্র আবর্জনা ছড়ালেও জরিমানা হতে পারে।’’
৬) সংরক্ষিত অরণ্যে ধূমপান এবং মদ্যপান নিষিদ্ধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেকে সুযোগ পেয়ে নিয়ম ভাঙেন। মনে রাখতে হবে, ধরা পড়লে জরিমানা হতে পারে। জঙ্গলে কোনও রকম আগুন জ্বালানোও নিষিদ্ধ।
৭) ঘুরতে গিয়ে অনেকেই ছবি তুলতে পছন্দ করেন। কিন্তু জঙ্গলে ছবি তোলার ক্ষেত্রে ফ্ল্যাশ ব্যবহার করা উচিত নয়। সব্যসাচীর কথায়, ‘‘অনেক সময়ে প্রয়োজনীয় ছবির জন্য অনেকেই অজান্তে নিয়ম লঙ্ঘন করেন। গাড়ি থেকে নেমে ছবি তোলা তো একদম নয়!’’
৮) জঙ্গল এবং বনসম্পদ দ্রষ্টব্য। সেখান থেকে কিছু নিয়ে আসা উচিত নয়। স্মৃতি যেন ছবি বা ভিডিয়ো আকারেই রয়ে যায়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। সব্যসাচীর কথায়, ‘‘গাছের পাতা বা ফুল ছেঁড়া বা মাটিতে কিছু পড়ে আছে বলে কুড়িয়ে নিলাম— এই ধরনের প্রবণতা খুবই খারাপ।’’
৯) জঙ্গলে গাইডই শেষ কথা বলেন। পশু-পাখিদের সাইটিং ভাগ্যের বিষয়। তার জন্য একাধিক বার সাফারি করতে হতে পারে। কিন্তু হতাশ হয়ে সঙ্গের গাইডের সঙ্গে অনেকে খারাপ আচরণ করেন। সব্যসাচীর কথায়, ‘‘আফ্রিকায় এক বাঙালি ভদ্রলোককে সিংহ দেখতে না পেয়ে গাইডের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে দেখে প্রতিবাদ করেছিলাম। আসলে অনেকে বুঝতেই চান না যে পয়সা খরচ করলেই বণ্যপ্রাণের দর্শন পাওয়া যায় না। তার জন্য চাই অরণ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং অবশ্যই সৌভাগ্য।’’