পুরনো চেহারায় হাওড়া ব্রিজ।—আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
সুতরাং এ সমস্যার সমাধানে খাস বিলেতের সাহেবরাও মাথা ঘামাতে শুরু করলেন। ১৮৫৪ সালেই কর্নেল গুডউইন সাহেব বিলেতের ‘কোর্ট অফ ডাইরেক্টরস্’-এর কাছে প্রস্তাব দিলেন হুগলী-ভাগীরথীর উপর একটা ‘সাসপেনশন’ ধরনের সেতু নির্মাণ করা যেতে পারে। তদুপরি সেতু নির্মাণ বাবদ এই বিরাট অঙ্কের টাকা আসবে কোথা থেকে তারও একটা ইঙ্গিত দিলেন। পরামর্শ দেওয়া হল, সেতু নির্মাণ বাবদ সব টাকাটাই মূলধন হিসেবে তোলা হবে সাধারণের কাছে শেয়ার বিক্রি করে। তারপর টোল বসিয়ে টাকা আদায় করে শেয়ার-হোল্ডারদের ‘ডিভিডেন্ড’ দেওয়া হবে। কিন্তু কর্নেল গুডউইন-এর প্রস্তাব ‘কোর্ট অব ডাইরেক্টরস্’ সম্পূর্ণ নাকচ করে দিলেন। কারণ ব্রিজ যদি করতেই হয়, তবে তা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে না করে সম্পূর্ণ ব্যয় করতে হবে রাজকোষ থেকে অর্থ সাহায্য নিয়ে।
এ দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির পরামর্শদাতা ইঞ্জিনিয়ার রেন্ডেল সাহেবও কর্নেল গুডউইন-এর প্রস্তাবকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দিলেন। তাঁর অভিমতে, ওই ধরনের সেতু নির্মিত হতে পারে সরু খাল বা ছোটখাটো নদ নদীতে; কিন্তু হুগলী-ভাগীরথীর মতো এমন এক স্রোতস্বিনী নদীর উপর লোহার পাত চেন আর বল্টু দিয়ে তৈরি সেতু কি তেমন মজবুত হবে? সেজন্যে এত বড় চওড়া এক নদীর উপর তৈরি করতে হবে, ঢালাই লোহায় তৈরি ‘টিউবলার’ সেতু—যার আদর্শ হল বিলেতের মিনাই জলপ্রণালীর উপর নির্মিত ‘ব্রিটানিয়া ব্রিজ’। এ ছাড়া রেন্ডেল সাহেব রেলের লাইন ও গাড়িঘোড়া যাতায়াতের রাস্তা বসাতে গেলে প্রস্তাবিত সেতুর আয়তন কী দাঁড়াবে, তা তাঁর পরিকল্পনায় উল্লেখ করে এটির নির্মাণ বাবদ মোট ব্যয়ের পরিমাণ যে ৪,৫০,০০০ পাউন্ড হতে পারে তারও এক হিসেবে দিলেন।
আরও পড়ুন: দুটি ফেরি ব্রিজ বিক্রি হয়ে গেল ৮০ হাজার টাকায়
তবে, রেল কোম্পানির এই পরামর্শদাতা ইঞ্জিনিয়ার প্রস্তাবিত সেতুর ধরন ছাড়াও স্থান নির্বাচন নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে প্রস্তাব দিলেন যে, সেতুটি নির্মিত হোক হাওড়ার শালকিয়া ও কলকাতার আহিরীটোলা ঘাটের মধ্যে। কেন না তাঁর যুক্তিতে, হাওড়া স্টেশনের কাছে সেতুটি তৈরি হলে বড় বড় জাহাজ প্রস্তাবিত এই সেতুর তলা দিয়ে যেতে পারবে না। অথচ আহিরীটোলা ঘাটের ওদিকে তেমন বড় জাহাজ যখন যায় না এবং ছোটখাটো জাহাজ যদিও যায় তা হলে সেতুর ধনুকের মতো খিলেনের ফাঁক দিয়ে অনায়াসেই সেগুলি চলাফেরা করতে পারবে। এ ছাড়া রেল্ডেল সাহেবের কথায়, কলকাতার সঙ্গে যখন রেল কোম্পানির যোগাযোগ দরকার, তখন হাওড়া থেকে শালকিয়া পর্যন্ত একটা রেললাইন জুড়ে দিয়ে সহজেই প্রস্তাবিত সেতুর উপর দিয়ে কলকাতা পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারিত করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন: কলকাতা-হাওড়ার সেতুবন্ধ কাহিনী
মি. রেন্ডেল-এর পরিকল্পনার বিরুদ্ধে মত পোষণ করে বিলেতের মেজর বেকার এক বিবৃতি দিলেন। তাঁর মতে এই পরিকল্পনা বাতিল করেই দেওয়া হোক; কেন না কলকাতায় রেল বসাতে গেলে যে বিস্তৃত জায়গার দরকার হবে তা বর্তমানে পাওয়া অসম্ভব। তা ছাড়া রেন্ডেল যেভাবে কম পরিসরের মধ্যে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা দিয়েছেন, তাতে রেলগাড়ি, অন্যান্য যানবাহন এবং মানুষজন যাতায়াতে ভীষণ অসুবিধে দেখা দেবে।
(উপরের নিবন্ধটি তারাপদ সাঁতরা-র ‘কীর্তিবাস কলকাতা’ থেকে নেওয়া। আজ তার তৃতীয় অংশ। সৌজন্যে আনন্দ পাবলিশার্স)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy