Advertisement
১২ জানুয়ারি ২০২৫
Travel

কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের নামে ডাইনোসরের কঙ্কাল!

কলকাতায় নাকি ডাইনোসর আছে! আছেই তো, কিন্তু কোথায় সেটি বোধহয় জানা নেই অনেকরই। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, কেন, ভারতীয় জাদুঘরে। আসলে তা নয়, জাদুঘরে ডাইনোসর নেই, সেটি আছে বরাহনগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে।

ছবি সৌজন্যে: আইএসআই।

ছবি সৌজন্যে: আইএসআই।

সৃজন দে সরকার
শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৭ ১৫:১৫
Share: Save:

কলকাতায় নাকি ডাইনোসর আছে!

আছেই তো, কিন্তু কোথায় সেটি বোধহয় জানা নেই অনেকরই। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, কেন, ভারতীয় জাদুঘরে। আসলে তা নয়, জাদুঘরে ডাইনোসর নেই, সেটি আছে বরাহনগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে। এবং আশ্চর্যের বিষয়, সেটি রবীন্দ্রনাথের নামেই নামাঙ্কিত! অবাক লাগছে তো! একটু গোড়া থেকেই বলি। ১৮৯৩ সালের ২৯ জুন নীরোদবাসিনী দেবী এবং প্রবোধচন্দ্র মহলানবিশের প্রথম সন্তান প্রশান্তচন্দ্রের জন্ম হয়। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গুরুচরণ মহলানবিশ প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে প্রশান্তচন্দ্রের শিক্ষারম্ভ হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১২-য় পদার্থবিদ্যায় সাম্মানিক বিএসসি পাশ করেন। পরে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজ থেকে তিনি ‘ট্রাইপস’ পাশ করেন এবং প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে এই সম্মান অর্জন করেছিলেন। দেশে ফিরে ১৯১৫-য় তিনি প্রেসিডেন্সিতেই পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত হন। রাশিবিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহ ছিল বলে এখানেই কয়েক জনকে নিয়ে তিনি একটি স্ট্যাটিস্টিক্যাল ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করেন, সেটি ১৯২০-র কথা। সার্বিক ভাবে দেশের আবহাওয়া, বন্যা অথবা নৃতত্ব বিষয়ে রাশিবিজ্ঞানের প্রয়োগ নিয়ে এখানে উল্লেখযোগ্য কাজ শুরু হয়। কিন্তু তাঁর মনের একান্ত ইচ্ছে ছিল রাশিবিজ্ঞানের প্রয়োগ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।

১৯৩৩-সালে তৈরি হয়েছিল ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট

১৯৩৩-এ ওঁর সেই স্বপ্নপূরণ সম্ভব হয়, তৈরি হয় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট। ১৯৪০-এ প্রশান্তচন্দ্র বরাহনগরে একটি পুরনো বাগান বাড়ি কিনেছিলেন। সবুজ গাছপালা পুকুর সম্বলিত এই বাড়িটি সংস্কার করে এখানেই তিনি থাকতে শুরু করেন। শিক্ষক জীবনের সঙ্গেই ওঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠতে থাকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। ক্রমে সেই পরিচয় গাঢ় হয়। নিজের জীবন ও মননে রবীন্দ্র আদর্শকে গ্রহণ করেন প্রশান্তচন্দ্র। ওঁর তৈরি ইনস্টিটিউটটি পরে এখানেই স্থানান্তরিত হয়। প্রশান্তচন্দ্র রাশিবিজ্ঞানে অনেকগুলি সূত্র এবং পদ্ধতির আবিষ্কার করেন। নমুনা সমীক্ষায় একটি উল্লেখযোগ্য গবেষণাপত্রের জন্য ১৯৪৫ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। প্রশান্তচন্দ্রের আন্তরিক উদ্যোগে এই প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে রাশিবিজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটতে থাকে। ওঁর ভাবনায় ছিল এই বৃহৎ দেশের নানাবিধ বিষয়। একসময়, গণ্ডোয়ানা-ল্যান্ড যখন ছিল সেই সময় এ দেশেও চড়ে বেড়াত বৃহদাকার ডাইনোসরের দল। পরে ভূতাত্ত্বিক প্লেট সরে যাওয়ার সময় সেই ডাইনোর দল চলে যায় অন্যত্র। কিন্তু এখানে রয়ে যায় তাদেরই একটির কঙ্কাল। বিজ্ঞানের এই বিষয়গুলি নিয়েও ভাবিত ছিলেন প্রশান্তচন্দ্র। এ বিষয়ে এক দিন নতুন কোনও আশার আলো দেখা যাবে এই বিশ্বাস ছিল তার মনে।

১৯৫৭-য় গবেষক-অধ্যাপক পামেলা লামপ্লাউ রবিনসনকে আমন্ত্রণ করেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে উনি এসে হাজির হন এখানে। বরাহনগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে তিনি একটি ভূতাত্ত্বিক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্দেশ্য ছিল, এ দেশের ভূতাত্ত্বিক বিষয়গুলি নিয়ে নতুন ক্ষেত্রের গবেষণা করা। রবিনসনের নেতৃত্বে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রের কোল ঘেঁষে গোদাবরী উপত্যকায় অনুসন্ধান শুরু হয়। এই অনুসন্ধানের ফলে কিছু ফসিল মাছ পেয়ে যান তাঁরা। পরে ১৯৬১-তে অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাঁরা একটি ডাইনোসরের হাড়গোড় আবিষ্কার করেন গোদাবরী উপত্যকায়। ভারতে প্রথম এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের পর কয়েক টন হাড় কলকাতায় এনে জড়ো করা হয়। অতঃপর, আবিষ্কারস্থলের ছবি মিলিয়ে পুনর্নির্মাণ করা হয় এই ডাইনোসরটিকে। পাওয়া যায় অতিকায় প্রাণীটির পূর্ণাঙ্গ চেহারা। এর নাম দেওয়া হয় ‘বরাপাসউরাস টেগোরেই’। বরাপাসউরাস শব্দের অর্থ বড় পা যুক্ত গিরগিটি এবং টেগোরেই শব্দটি যুক্ত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানিয়ে। ঘটনাক্রমে সেই বছর ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ। সে কারণেই এই উদ্যোগ। এ ভাবেই এই উপমহাদেশের এক এবং অদ্বিতীয় ডাইনোসরের সঙ্গে জুড়ে গেছে কবিগুরুর নাম!

রানি ও প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশকে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের উপহার

যদিও সেই প্রাণীটির মাথা পাওয়া যায়নি সে সময়। পরে এই সংস্থার অনুরোধে বিদেশ থেকে একটি মাথা উপহার হিসেবে আসে এই প্রাণীটির ধড়ে! বরাহনগরের এই ক্যাম্পাসে কয়েক বার এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রশান্ত এবং রানি মহলানবিশের এই বাড়িটির নাম আম্রপালি, সেটিও রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। এই বাড়িটিতেই একটি সংগ্রহশালা এবং লেখ্যাগার গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। অতঃপর, প্রশান্তচন্দ্রের জন্মশতবর্ষে, ১৯৯৩-এর ২৯ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাও নবরূপে সজ্জিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অ্যান্ড আর্কাইভ-টির উদ্বোধন করেন। প্রশান্তচন্দ্র এবং রানি মহালানবিশের বিবাহের সময় গুরুদেব আশীর্বাদী লিখে দিয়েছিলেন, ‘প্রশান্ত, রাণী। তোমাদের এই মিলন-বসন্তে/দিলেন কবি বসন্ত-গান আনি।/সুন্দর প্রেম সাজুক আনন্দে/ পরুক গলায় সুরের মালাখানি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৫ ফাল্গুন ১৩২৯।’ এখানকার সংগ্রহশালায় এলে দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথের এই লেখা। আর জুরাসিক পার্কের সেই ডাইনোসরটি দেখা যাবে এখানকার ভূতাত্ত্বিক বিভাগের সংগ্রহশালায়, সঙ্গে রয়েছে সে দিনের অনুসন্ধান থেকে আবিষ্কৃত সেই সব মাছ বা অন্যান্য ফসিলের সম্ভারও।

অন্য বিষয়গুলি:

Dinosaur Rabindranath Tagore Indian Statistical Institute
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy