বর্ষা মানে কি শুধু ঘরে বসে বৃষ্টি উপভোগ করা? সমাজমাধ্যমে পোস্ট হওয়া বিভিন্ন রাজ্যের বৃষ্টিস্নাত রূপ, প্রকৃতির শ্যামল ক্যানভাস দেখলে সে ভাবনা বদলাতে বাধ্য। এমন রূপ চাক্ষুষ না করলে, জীবনটাই যে ব্যর্থ মনে হতে পারে। বৃষ্টিতে ধৌত পাহাড়, ঝর্নার উচ্ছ্বল রূপ, শ্যামলিমা উপভোগ তো আর অন্য ঋতুতে হয় না। হাতে তিন-চারটি সময় থাকলে বরং বেড়িয়ে পড়ুন বর্ষা প্রকৃতির সন্ধানে। ঘুরে নিন ওড়িশা। এ রাজ্যের কথা বললে, নয়তো গোপালপুরের কথাই লোকে বলেন। কিন্তু বর্ষাস্নাত প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর রূপ দেখা যায় এই রাজ্যের অন্য প্রান্তেও। তেমনই তিন ঠিকানা হতে পারে মহেন্দ্রগিরি, কেওনঝড় এবং জিরাং।
মহেন্দ্রগিরি
এ জায়গার আধ্যাত্ম্যিক মাহাত্ম্যও যেমন রয়েছে তেমনই আছে প্রকৃতির উজাড় করা রূপ। ছবি: সংগৃহীত।
নামেই প্রকাশ, এ স্থান পাহাড়ি। পূর্বঘাটের পাহাড়ের কোলে তার অবস্থান। গা ঘেঁষে বয়ে গিয়েছে মহেন্দ্রতনয়া নদী। এ জায়গার আধ্যাত্ম্যিক মাহাত্ম্যও যেমন রয়েছে তেমনই আছে প্রকৃতির উজাড় করা রূপ। সেই সৌন্দর্য কয়েক গুণ বেড়ে যায় মেঘলা দিনে, বৃষ্টির ধারাপাতে। জমাটবাঁধা ধোঁয়াটে মেঘ পাহাড় বেয়ে নেমে আসে তখন। ওড়িশার দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ মহেন্দ্রগিরি তখন হয়ে ওঠে যেন শিল্পীর তুলির টানে আঁকা কোনও ছবি। এ স্থানের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার ৯২৫ মিটার।
দেখে নেওয়া যায় ঝর্না, নদী আর বেশ কিছু পুরনো মন্দির। এই জায়গার সঙ্গে জড়িয়ে নানা পৌরাণিক কাহিনি। কারও কারও বিশ্বাস, রামায়ণের মহেন্দ্রপর্বতই মহেন্দ্রগিরি। এই স্থান পঞ্চপাণ্ডবের পদধূলিতে ধন্য। তাঁদের নামে মন্দিরও আছে। কথিত আছে, পাহাড়ে তপস্যা করেছিলেন পৌরাণিক চরিত্র পরশুরাম।
বর্ষায় মহেন্দ্রগিরির অনতিদূরে অবস্থিত মনকারদিয়ান জলপ্রপাত হয়ে ওঠে আরও সুন্দর। প্রবল জলরাশি আছড়ে পড়ে পাহাড় থেকে নীচে। এ পথেই দেখা মেলে মহেন্দ্রতনয়ারও। বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদী হয়ে ওঠে খরস্রোতা। মহেন্দ্রগিরিতে রয়েছে পুরনো শিবমন্দির। পাহাড়ি পথে সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছনো যায় ভীম মন্দিরে। আরও চড়াইয়ে গেলে পৌঁছনো যায় পরশুরামের মূর্তির কাছে। মেঘের আচ্ছাদন ঘন না থাকলে পাহাড়ের উপর থেকে চারপাশের দৃশ্য লাগে ভারি সুন্দর। গরম ছাড়া যে কোনও মরসুমেই এখানে আসা যায়। তবে বর্ষার রূপ একেবারে ভিন্ন।
কী ভাবে যাবেন?
ওড়িশার গজপতি জেলায় অবস্থান মহেন্দ্রগিরির। ৫১ কিলোমিটার দূরে রয়েছে পাড়ালাখেমুন্ডি নামে একটি জনপদ। ব্রহ্মপুর থেকে মহেন্দ্রগিরির দূরত্ব ১২৫ কিলোমিটার। ভুবনেশ্বর থেকে ব্রহ্মপুর বা পাড়ালাখেমুন্ডি হয়ে মহেন্দ্রগিরি আসা যায়।
আর কী দেখবেন?
মহন্দ্রগিরির ১০০-১৫০ কিলোমিটারের মধ্যে একাধিক দ্রষ্টব্য রয়েছে। সেই তালিকায় আছে গন্ডাহাতি জলপ্রপাত, গজপতি প্যালেস, পদ্মসম্ভব মহাবিহার মনাস্ট্রি, হাড়াভাঙ্গি ড্যাম-সহ আরও কয়েকটি জলপ্রপাত।
জিরাং
পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় মনাস্ট্রি বলে পরিচিত জিরাং। ছবি: সংগৃহীত।
পাহাড়ের মাঝে বৌদ্ধ মন্দির, ভিতরে শান্ত-সমাহিত বুদ্ধমূর্তি। এমন দৃশ্য শুধু দার্জিলিং, সিকিম, লাদাখ, হিমাচলেই নয়, দেখা যায় ওড়িশাতেও। পূর্বঘাট পাহাড়ের গায়েই চন্দ্রগিরি। সেখানেই বৌদ্ধদের উপাসনা স্থল পদ্মসম্ভব মহাবিহার মনাস্ট্রি। লোকজন একে জিরাং মনাস্ট্রি নামেও জানেন। শোনা যায়, চিন তিব্বতের দখল নেওয়ার পর ভারতের বিভিন্ন স্থানে তিব্বতিরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারই মধ্যে একটি জিরাং। এখন এই স্থানে তিব্বতিদের বাস। ওড়িশার ‘মিনি তিব্বত’ নামে পরিচিত জায়গাটি। পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় মনাস্ট্রি বলে পরিচিত জিরাং। টিলার মতো ঘন সবুজ পাহাড়ের গায়েই মনাস্ট্রি। পাশেই সুসজ্জিত হ্রদ। প্রবেশদ্বারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হবে ক্যানভাসে আঁকা ছবি। কাছেই রয়েছে ঘণ্টাঘর। সেখানে রয়েছে বৌদ্ধস্তূপ। জিরাং আসার পথে ঘুরে নিতে পারেন উষ্ণ প্রস্রবন তপ্তপানি।
কী ভাবে যাবেন?
ওড়িশার গজপতি জেলায় রয়েছে জিরাং মনাস্ট্রি। ব্রহ্মপুর থেকে জিরাংয়ের দূরত্ব ১১১ কিলোমিটার। হাওড়া থেকে ট্রেনে ব্রহ্মপুর এসে গাড়িতে বাকি পথ যেতে পারেন।
আর কী দেখবেন?
জিরাং থেকে মহেন্দ্রগিরি বা দারিংবাড়ি কোনওটাই খুব বেশি দূরে নয়। জিরাং ঘোরার পর হাতে দু’দিন থাকলে এর মধ্যে যে কোনও একটি জায়গা ঘুরে নিতে পারেন। বর্ষায় দারিংবাড়ি জলপ্রপাতগুলিতে প্রচুর জল থাকে। অন্য সময় সেই রূপ দেখা যায় না।
কেওনঝড়
কেওনঝড়ের খণ্ডধর জলপ্রপাত। ছবি:সংগৃহীত।
আরও পড়ুন:
ছোটবেলায় পড়া ভূগোল বইতেই কেওনঝড়ের সঙ্গে পরিচিতি অনেকের। লৌহ আকরিকের খনির জন্য এই স্থানের নাম। সবুজ পাহাড়, ছোট-বড় জলপ্রপাত, চড়াই-উতরাই পথেক এই জায়গায় বর্ষায় ভ্রমণের আনন্দটাই আলাদা। মেঘলা দিনে সেই পথে সঙ্গী হতে পারে রিমঝিম বৃষ্টিও। এখানকার অন্যতম আকর্ষণ একাধিক জলপ্রপাত। তার মধ্যে খণ্ডধর একটি। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গিয়েছে সিঁড়ি। এই পথে উঠতে উঠতেই সাক্ষাত হবে জলপ্রপাতের সঙ্গে। লম্বা সিঁড়ি ভাঙার ধকল ভুলিয়ে দেবে খণ্ডধরের রূপ। খণ্ডধর থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে হান্ডিভাঙা জলপ্রপাত। জলপ্রপাতটি বিশাল বড় না হলেও বর্ষায় ধোয়া প্রকৃতির মাঝে এটি দেখতে বেশ মনোরম। আছে বড়াঘাগরা ও সানঘাঘরাও। বর্ষায় বড়াঘাগরা জলপ্রপাতের কাছে যেতে হলে হেঁটেই পার হতে হবে ছোট্ট একটি নদী। চার পাশ ঘন সবুজ, পাখির ডাক, তার মধ্যেই নিজের মতো ছন্দে পাহাড় থেকে নামছে বড়াঘাগরা। ঘুরে নেওয়া যায় সানঘাঘরাও। ‘ওড়িশার নায়াগ্রা’ বলে পরিচিত গুন্ডিচাঘাঘি। কেওনঝড়ের আর এক দ্রষ্টব্য ঘাঁটাগাও তারিণী মন্দির থেকে ২০ মিনিটের দূরত্বে রয়েছে গুন্ডিচাঘাঘি। মুসালা নদীর ওপর এই জলপ্রপাত। দেখতে ভুলবেন না ভীমকুণ্ড। এক পাথর থেকে অন্য পাথরে ধাক্কা খেয়ে বিস্তৃত জায়গার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে জলস্রোত।
কী ভাবে যাবেন?
বারবিল স্টেশন থেকে কেওনঝড়ের দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। আবার খুরদা রোড স্টেশনে নেমে সেখান থেকে কেওনঝড়ের ট্রেনও পাওয়া যায়। সড়কপথেও কলকাতা থেকে কেওনঝড় যাওয়া যায়। দূরত্ব ৩৪৫ কিলোমিটারের কাছাকাছি।