পুজো মানেই ভ্রমণের তালিকায় কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, আন্দামান বা নিদেনপক্ষে হাতের কাছে দিঘা, পুরী, মন্দারমণি, পুরুলিয়া তো থাকবেই। ঢাকের বাদ্যি, মণ্ডপ ঘোরা, আড্ডা, ভূরিভোজ— এ সব যেমন পুজোর অঙ্গ, তেমনই দুর্গোৎসবের সঙ্গে বেড়ানোর সম্পর্কও বহু দিনের।
কেউ কেউ এক বছর আগে থেকে বেড়ানোর জায়গা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন। জামাকাপড় কেনার পাশাপাশি বেড়ানোর বাজেটও ঠিক হয়ে যায়। পুজোর তিন-চার মাস আগে থেকে বুকিংয়ের জন্য ভ্রমণ সংস্থা, পর্যটকদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। এই সময় ট্রেন, বাস, বিমানের টিকিটের প্রবল চাহিদাই ইঙ্গিত দেয়— পুজোয় ভ্রমণ নিয়ে উন্মাদনা থাকবেই, তা সে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মতো গুরুতর বিষয় যতই থাকুক না কেন।
পুজো সফর নিয়ে কেন এত হইচই?
সাধারণত অক্টোবরে দুর্গাপুজো হয়। সমুদ্র হোক বা পাহাড়— এই সময়ে যে কোনও জায়গায় ঘোরা যায়। হিমালয়ের সৌন্দর্য উপভোগের এ এক মোক্ষম সময়। কারণ, শরতের রোদ ঝলমলে আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা বা পর্বতের বিভিন্ন শৃঙ্গ দেখতে পাওয়ার সুযোগ বেশি থাকে। না থাকে গরম বা বৃষ্টির বাড়াবাড়ি, না থাকে শীতের তীব্রতা। তার উপর একসঙ্গে লম্বা ছুটিও তো বছরে চট করে মেলে না।
এই বছর পুজো খানিক আগেই হচ্ছে। এক দিকে, প্রবল বর্ষা এবং হড়পা বানে বিধ্বস্ত উত্তরাখণ্ড এবং হিমাচল, অন্য দিকে, নেপালে বিক্ষোভের আগুন দিকে দিকে। কাশ্মীরেও জঙ্গি হানায় ছন্দপতন ঘটেছে।
পুজোয় এ বার উত্তর না দক্ষিণ
তা হলে এ বছর লোকে যাচ্ছেনই বা কোথায়? প্রতি বছর পুজোয় কাশ্মীর যাওয়ার ভিড় থাকে প্রচণ্ড, এই বছরও কি তাই! না কি, জঙ্গি হানার পরে কাশ্মীর বা বৃষ্টি-বিপর্যস্ত হিমাচলে যেতে ভয় পাচ্ছেন পর্যটকেরা?
কলকাতার বহু পুরনো এবং নামী পর্যটন সংস্থার কর্ণধার সৌমিত্র কুন্ডু বলছেন, ‘‘গত দু’তিন বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি দুর্গাপুজোয় লোকে কাশ্মীর যেতে চাইতেন। এই বছর হঠাৎই তাতে ভাটা পড়েছে। হয়তো সন্ত্রাসের দিনগুলি মনে গভীর ছাপ ফেলেছে।’’
পুজোয় কাশ্মীর ভ্রমণ নিয়ে মাতামাতি নতুন নয়। তা ছাড়া, গরমের ছুটিতে সবুজ উপত্যকা কিংবা শীতে জমাটবাঁধা ডাল লেক দেখতে যাওয়ার জন্যও পর্যটকদের আগ্রহ কম ছিল না। তবে ছন্দপতন ঘটে এই বছরের এপ্রিল মাসে। ‘মিনি সুইৎজ়ারল্যান্ড’ বলে খ্যাত কাশ্মীরের বৈসরণ উপত্যকায় জঙ্গিদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান ২৬ জন। যার মধ্যে সিংহভাগই পর্যটক।
আরও পড়ুন:
সন্ত্রাসের স্মৃতি হালকা হলেও, পর্যটকেরা হয়তো আশ্বস্ত হতে পারছেন না মনে করছেন কলকাতার আর এক পর্যটন সংস্থার মালিক রণজিৎ অধিকারী। তিনিও মানলেন, এই বছরের ছবিটা আলাদা। কাশ্মীর নিয়ে আচমকাই আগ্রহ কমে গিয়েছে।
ভূস্বর্গের ভয়ঙ্কর ঘটনা যদিও পুরোপুরি পর্যটনকে নষ্ট করতে পারেনি। শ্রীরামপুরে একটি পর্যটন সংস্থা চালান কুন্তল চট্টোপাধ্যায়। জানালেন, কাশ্মীরের ৩০ শতাংশ পর্যটক কমেছে গত বছরের চেয়ে। তবে যাচ্ছেন না তা কিন্তু নয়।
ভূ-স্বর্গের সৌন্দর্য। ছবি: সংগৃহীত।
‘অপারেশন সিঁদুর’ আস্থা ফিরিয়েছে কারও কারও মনে। কাটরা থেকে শ্রীনগর ‘বন্দে ভারত’ চালু হয়েছে। পাহাড়ি পথে ট্রেন যাত্রার বাড়তি আকর্ষণেও কেউ কেউ কাশ্মীর যাচ্ছেন ঠিকই, তবে সংখ্যায় কম।
নেপালে গণ অভ্যুত্থানের আঁচ কিছুটা হলেও পড়েছে পর্যটনে। সমাজমাধ্যমের উপরে সরকারি নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে শুরু হওয়া যুবসমাজের বিক্ষোভে রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছে নেপাল। দফায় দফায় বিক্ষোভ-অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে সেখানে। কার্যত বাধ্য হয়ে ইস্তফা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সেই ছবি সমাজমাধ্যমে, টেলিভিশনের পর্দায় দেখে বাংলার অনেকেই নেপাল থেকে মুখ ফিরিয়েছেন। কলকাতার একটি ভ্রমণ সংস্থার কর্ণধার রণজিৎ অধিকারী বলছিলেন, ‘‘নেপাল নিয়ে বড় অংশের উৎসাহ ছিল। অনেকে বুকিং করেছিলেন। তবে অশান্তির আঁচ পেতেই তা বাতিল করা হয়।’’ যদিও সমগ্র ছবি এক নয়। নেপাল ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরবে এমন বার্তাও কোনও কোনও ভ্রমণ সংস্থার তরফে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও আবার বুকিং বাতিল হলে টাকা জলে যাওয়ার ভয়ে অনেকে সে দেশে যাচ্ছেন বলেও কলকাতার পর্যটন সংস্থা সূত্রে জানা যাচ্ছে।
নেপালের সৌন্দর্যের টানে প্রতি বছর এ রাজ্য থেকে বেড়়াতে যান অনেকেই। ছবি: সংগৃহীত।
পাহাড় না সমুদ্র, না কি অরণ্য?
তবে কাশ্মীর-নেপাল বাদ দিলে, লোকজনের উৎসাহ আর কোন দিকে? এ ক্ষেত্রে এক এক পর্যটন সংস্থার পর্যবেক্ষণ এক এক রকম। যেমন সৌমিত্রবাবু জানাচ্ছেন, আন্দামান, লেহ্-লাদাখ নিয়ে লোকজন বেশ উৎসাহী। তালিকায় দক্ষিণ ভারতের নানা জায়গা রয়েছে। কেরল, তামিলমাড়ু থাকছেই, রাজস্থান, গুজরাতেও পর্যটকেরা যাচ্ছেন।
দীর্ঘ দিন ধরে পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রক্তিম রায়। তিনি বলছেন, লোকজন এ বার অরুণাচল প্রদেশ বেছে নিচ্ছেন। শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম নিয়েও উৎসাহ যথেষ্ট। তবে তাইল্যান্ড নিয়ে তেমন বাড়াবাড়ি নেই। দেশের মধ্যে কেরলের বুকিং ভাল। দার্জিলিং, গ্যাংটক থাকেই, আছে। রাজস্থান, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশও থাকছে তালিকায়।
হড়পা বান, বৃষ্টি, ধসের বিভীষিকা কাটিয়ে ছন্দে ফিরছে হিমাচল প্রদেশ। পর্যটকেরাও এখানকার সৌন্দর্য উপভোগের অপেক্ষায়। ছবি : সংগৃহীত।
হিমাচলও মেঘভাঙা বৃষ্টি, হড়পা বান আর ধসে বিধ্বস্ত। হিমাচলের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের তথ্য বলছে, গত ২০ জুন থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই রাজ্যে বৃষ্টি, ধস, হড়পা বান এবং দুর্ঘটনার জেরে মৃত্যু হয়েছে ৪২৭ জনের। প্রত্যেক বছরেই পুজোয় হিমাচল প্রদেশের নানা প্রান্তে বেড়াতে যান পর্যটকেরা। এই বছরও রয়েছে।
পুজোয় কিন্নর-কল্পা যাওয়ার পরিকল্পনা বেসরকারি সংস্থায় কর্মরতা রিম্পা দাসের। তিনি বললেন, ‘‘কিছু দিন আগে টিভিতে, সমাজমাধ্যমে বৃষ্টি, রাস্তা ভাঙার খবর পেয়ে মুষড়ে পড়েছিলাম। কোনও ইতিবাচক আশ্বাসও পাচ্ছিলাম না পর্যটন সংস্থার তরফে। এত দিনের পরিকল্পনা, বাতিল হলে কী করব ভেবেই মুষড়ে পড়েছিলাম। তবে গত সপ্তাহে জানলাম, যাওয়া যাবে। এখন আবার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’’
শেষ মুহূর্তে হিমাচল প্রদেশের সব ট্যুরই করাচ্ছে কলকাতার বেশির ভাগ পর্যটন সংস্থা। কথা হচ্ছিল, হিমাচলপ্রদেশের এক পর্যটন সংস্থার কর্ণধার সুব্রত দাসের সঙ্গে। জানালেন, বৃষ্টি থামতেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কুলু-মানালি জাতীয় সড়কে মেরামতির কাজ শুরু হয়েছে। ভাঙা অংশগুলি যতটা সম্ভব সারিয়ে গাড়ি চলাচলের উপযোগী করা হচ্ছে। এখন রাতের দিতে গাড়ি চলাচল বন্ধ রেখে কাজ চলছে। বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়েছে বিয়াস নদী সংলগ্ন জাতীয় সড়ক। তবে মানালি যাওয়ার পুরনো রাস্তা ঠিকই আছে। সারাহান-কিন্নরের পথে এক জায়গায় রাস্তার কাজ চলছে। যে ভাবে কাজ চলছে, পুজোয় হিমাচলপ্রদেশের কোনও অংশেই পর্যটনে অসুবিধা সে ভাবে হওয়ার কথা নয়।
ছোট সফরেও বেড়েছে উৎসাহ
সকলেই যে পুজোয় দিন ১০-১২ ছুটির ব্যবস্থা করতে পারেন, তা নয়। কেউ কেউ ৪-৫ দিনের সফরও করতে চান। পর্যটক ব্যবসায়ী রণজিৎ বলছেন, ‘‘কলকাতার আশপাশে ছোট ছোট সফরেও পর্যটকদের আগ্রহ রয়েছে। দার্জিলিং, পুরী, ডুয়ার্স, গ্যাংটক— এগুলি আছেই। অনেক পর্যটক নিজেরা বেড়াতে যান, কিন্তু হোটেল, গাড়ি, টিকিট বুকিং করে সফর সাজিয়ে দিতে হয়। এই বছর পুজোয় পর্যটকদের মধ্যে ডুয়ার্স, দার্জিলিং, কালিম্পংয়ের পাশাপাশি অফবিট বা স্বল্পচেনা গ্রামগুলিতে যাওয়ার উৎসাহ যথেষ্ট। তিনচুলে, দারাগাঁও, অহলদাঁড়া, সিটং— এইসব জায়গায় গিয়ে থাকতে চাইছে পর্যটকেরা।’’ পাশাপাশি, পুরী, রাঁচী, বিশাখাপত্তনম— এই জায়গাগুলি নিয়ে জিজ্ঞাসা, বুকিংয়ের আবেদন থাকছেই।
পশ্চিমবঙ্গের পর্যটকদের অনেকেই এবার কেরলমুখী। ছবিটি ব্যাক ওয়াটারের। ছবি: সংগৃহীত।
কলকাতা-সহ জেলার পর্যটন সংস্থাগুলি একবাক্যে পুজো সফরের ‘ট্রেন্ড’-এ একটি জায়গার নাম করছেন এই বছর, তা হল কেরল। প্রত্যেকেই জানাচ্ছেন কেরল ট্রিপের বুকিং সম্পূর্ণ। এ ছাড়াও তামিলনাড়ুতে রামেশ্বরম, কন্যাকুমারী নিয়ে বাড়তি উৎসাহ আছে। কন্যাকুমারীতে সমুদ্রের উপরে ‘কাচের সেতু’ দেখতে যেতে চাইছেন অনেকেই, বলছেন শমিতা বল। বহু বছর ধরে কলকাতায় পর্যটন সংস্থা চালান তিনি। রামেশ্বরম যাওয়ার জন্য সমুদ্রের উপরে নতুন রেললাইন হয়েছে। সে নিয়েও আগ্রহ রয়েছে।
বৃষ্টি-ধসে সিকিম যাওয়ার রাস্তাও বার বার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তবে তা বলে পর্যটক উৎসাহ কমেছে কি? কলকাতার যে সব পর্যটন সংস্থা সিকিম, দার্জিলিং ট্যুর করায়, তারা জানাচ্ছে— এই সব জায়গায় বুকিং করে দেওয়ার যথেষ্ট চাপ থাকছে। সিকিমের জনপ্রিয় একটি পর্যটন সংস্থার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পর্যটকদের চাপ এবং পূর্ব সিকিমে সিল্করুটের দিকে। এই বছর উত্তর সিকিমের গুরুদোংমারের রাস্তা বন্ধ। চলতি বছরে গ্রীষ্ম থেকে বর্ষার মরসুমে— ধসে রাস্তা বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উত্তর সিকিম রাস্তা বন্ধ ছিল। লাচেন, লাচুং, গুরুদোংমার এবং ইয়ুমথাং যেতে পর্যটকদের অনুমতি দরকার হয়। দীর্ঘ দিন উত্তর সিকিমের পথ বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি লাচুং হয়ে ইয়ুমথাং, জিরো পয়েন্ট যাওয়ার ছাড়পত্র মিলছে। পর্যটক সংস্থার তরফে জানা গিয়েছে, পুজোয় উত্তর সিকিম খোলা থাকলে যথেষ্ট উন্মাদনা থাকে। কিন্তু এই বছর যখন লাচুং যাওয়ার ছাড়পত্রের কথা বলা হয়েছে, তত দিনে ট্রেনের টিকিট বুকিং শেষ। পর্যটকেরা ৩-৪ মাস আগেই বুকিং সারেন। ফলে, উত্তর সিকিমে ভিড় কিছুটা কম হতে পারে। তবে গ্যাংটক, পেলিং, রাবাংলায় বুকিং হয়েছে যথেষ্ট। পর্যটকদের একাংশ সিকিমের নিরালা গ্রাম, স্বল্পচেনা পর্যটন কেন্দ্রগুলিতেও যাচ্ছেন।
কন্যাকুমারীতে তৈরি হয়েছে গ্লাস ব্রিজ। ছবি: সংগৃহীত।
তবে পুজোর সময়ে পুরী নিয়ে উন্মাদনা থাকবে না তা হয় না। শমিতা জানাচ্ছেন, তাঁদের হোটেল রয়েছে পুরীতে। কয়েক মাস আগেই তা পুরোপুরি বুক্ড হয়ে গিয়েছে। একই সুর শোনা গেল অন্য পর্যটন ব্যবসায়ীদের গলাতেও। তাঁদের কথায়, পুরী যাওয়া যায় বাসেও। ট্রেনের টিকিট না পেলে, বাস-গাড়িতেই চলে যান লোকে। এই বছরও ব্যতিক্রম হচ্ছে না।