বাংলা সাহিত্যের পাতায় বরাবরই জায়গা করে নিয়েছে দেওঘর। বর্তমান ঝাড়খণ্ডের এই শহর এক সময় হাওয়াবদলে যাওয়া বাঙালির অন্যতম ঠিকানা ছিল। তবে দেওঘর নয়, ঘুরে আসা যায় দেওগড়েও। ঝর্না, পাহাড়, অরণ্য, জলাধার দিয়ে সজ্জিত সেই স্থান। শীতকালই আদর্শ মরসুম সেখানে বেড়ানোর।
দেওগড় ওড়িশায়। দেবগড় জেলার ছোট্ট শহর দেওগড়। লোকে বলেন, দেবতার ঘর বা আশ্রয়স্থল হিসাবেই এই জায়গার নাম। দিন চার-পাঁচেকের ছুটি থাকলে খুব ভাল করেই ঘুরে নিতে পারেন জায়গাটি।
প্রধানপাট জলপ্রপাত
দেওগড় শহরের কাছেই রয়েছে ছোট্ট একটি ঝর্না। শীতকালে স্থানীয় বাসিন্দারা এখানে পিকনিকে আসেন। পাহাড় ও বনাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে এর জলপ্রবাহ বেশ দেখায়। ঝর্নার কাছেই রয়েছে দেওগড় টাউন পার্ক এবং রাজা দিব্যসুন্দর দেবের নির্মিত ‘বসন্ত নিবাস’ নামে বাংলো।
জগন্নাথ মন্দির
দেওগড়ে অরণ্যঘেরা প্রান্তরে রয়েছে জগন্নাথ মন্দির। ছবি:সংগৃহীত।
ওড়িশার নিজস্ব স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি জগন্নাথ মন্দিরটি এই অঞ্চলের অন্যতম আকর্ষণ। ১৭০৫ সালে রাজা প্রতাপ রুদ্র দেব মন্দিরটি তৈরি করিয়েছিলেন। মন্দির চত্বর বেশ প্রশস্ত। সবুজের মাঝে সাদা মন্দিরটি চোখের আরাম আনে।
কটাসর ঘাট ও বনদুর্গা মন্দির
কটাসর ঘাট শিব মন্দির দেওগড় থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দেওগড় থেকে অঙ্গুল যাওয়ার পথে কাঙ্কারখোল সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এই স্থানটি অবস্থিত। অরণ্যবেষ্টিত এই স্থানে দেবী বনদুর্গা ও শিবের মন্দির রয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গণের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে প্রাকৃতিক জলস্রোত।
কৈলাস প্যালেস
দেওগড় থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে পুরনো এক প্রাসাদ। শোনা যায়,১৯১৯ সালে রাজা দিব্যশঙ্কর দেব এটি তৈরি করিয়েছিলেন। ওড়িশা সরকার এটিকে একটি ইকোট্যুরিজম সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে। পাহাড় ঘিরে রেখেছে এই স্থান। বর্তমানে এর প্রাসাদের কিছু অংশ ভগ্নপ্রায়, তবুও এর স্থাপত্যশৈলী এবং চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
গোহিরা বাঁধ
পাহাড়ঘেরা গোহিরা বাঁধ এই স্থানের অন্যতম আকর্ষণ। ছবি: সংগৃহীত।
১৯৮১ সালে নির্মিত এই সেচ প্রকল্পটি তৈরি হয়েছিল। অনুচ্চ পাহাড় ঘিরে রেখেছে জলাধার। দেওগড় শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গোহিরা বাঁধের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন ভাল করে দেয়। কাছে একটি শিব মন্দির রয়েছে। পর্যটক এবং দর্শনার্থীরা এখানে পুজো দিতে এবং শীতে চড়ুইভাতি করতে আসেন। গোহিরা পিকনিক স্পট হিসাবে বেশ জনপ্রিয়।
ঝাড়েশ্বর মন্দির
দেওগড় থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মন্দিরটি ১৮৫৪ সালে রাজা ব্রজসুন্দর দেবের শাসনকালে নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরের মূল আরাধ্য শিব। লিঙ্গটি বা এখানে প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি। মন্দিরে কলিঙ্গ শৈলীর স্থাপত্যের ধারা চোখে পড়ে।
কুলাদেরা জলপ্রপাত
কুলাদেরা জলপ্রপাতটির বর্ষাকালীন রূপ সবচেয়ে সুন্দর। ছবি:সংগৃহীত
অরণ্যঘেরা স্থানে কুলাদেরা জলপ্রপাতটি দেখতে বেশ সুন্দর। দেওগড় শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের এই জায়গাটিতে পৌঁছতে জন্য ৪-৫ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পার করতে হয়। কুলাদেরা জলপ্রপাতটি ঘন জঙ্গলে ঢাকা।
দেওগড়ে ঘুরে দেখার স্থান এতেই শেষ হয় না। ঝর্না, নদী, জলপ্রবাহ মিলিয়ে অসংখ্য ছোট-বড় স্থান রয়েছে এখানে। পর্যটককেন্দ্র হিসাবে বিশেষ পরিচিত না হওয়ায়, এখানে তেমন ভিড় হয় না। শীতকালে দিনের বেলার আবহাওয়া থাকে মনোরম, তবে রাত বাড়লে ঠান্ডাও তার উপস্থিতি জানান দেয়।
দু’রাত তিন দিনে কী ভাবে সাজাবেন ভ্রমণসূচি?
সকালে পৌঁছতে পারলে খাওয়া-দাওয়া সেরে বেড়িয়ে পড়ুন প্রধানপাট জলপ্রপাত দেখতে। ঘুরে নিন বসন্ত নিবাস। মধ্যাহ্নভোজ সেরে বিকেলের দিকে চলুন গোহিরা বাঁধে। সূর্যাস্তের সময় দারুণ লাগবে। পড়ন্ত বিকেলটা এখানেই উপভোগ করুন। বাঁধের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করুন এবং কাছেই অবস্থিত শিব মন্দির দর্শন করুন। সন্ধ্যায় ঘুরে নিতে পারে দেওগড়ের স্থানীয় হাট-বাজার।
দ্বিতীয় দিনে প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়ুন জগন্নাথ মন্দির দর্শনে। কৈলাস প্যালেস,কটাসর ঘাট, বনদুর্গা মন্দির ঘুরে নিন। গাছগাছালির মধ্যে বসে জিরিয়ে নিন কিছুটা সময়। শহরে ফিরে এসে ঝাড়েশ্বর মন্দির দর্শন করুন। তিন দিন ঘোরার জন্য গাড়ি বুক করে নেওয়াই সবচেয়ে ভাল।
তৃতীয় দিনে ঘুরে নিন কুরুদকুট এবং দেওঝরন জলপ্রপাত।
কোথায় থাকবেন?
সম্বলপুর, দেওগড় দুই জায়গাতেই একাধিক হোটেল রয়েছে। অক্টোবর থেকে মার্চ মাস দেওগড় ভ্রমণের জন্য আদর্শ। বর্ষাকালে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জলপ্রপাতগুলি জলে পূর্ণ থাকলেও, কিছু কিছু স্থানে যাতায়াত কিছুটা কঠিন হতে পারে। শীতের আবহাওয়া মনোরম হলেও জলপ্রপাতে জল কম থাকে।
কী ভাবে যাবেন?
দেওগড়ের নিকটতম রেল স্টেশন হল সম্বলপুর এবং বিমানবন্দর হল ঝারসুগুদা (বীর সুরেন্দ্র সাই বিমানবন্দর)। সেখান থেকে সড়কপথে দেওগড় পৌঁছোনো যায়। সম্বলপুর বা ঝাড়সুগুদা থেকে দেওগড় আসার গাড়ি ভাড়া করে নিন। সম্বলপুর থেকে দূরত্ব ৯২ কিলোমিটারের মতো। যেতে ঘণ্টা তিনেক সময় লাগতে পারে।রাত ১০টা ১০ মিনিটে হাওড়া থেকে ছাড়ে সমলেশ্বরী এক্সপ্রেস। সম্বলপুর পৌঁছয় পরদিন সকাল ৮টা ৫৫মিনিটে। এই ট্রেনটি ঝাড়সুগুদা পৌঁছোয় সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে। সেখান থেকেও গাড়ি ধরে দেওগড় যেতে পারেন। দূরত্ব প্রায় ৯৬-৯৭ কিলোমিটার। এ ছাড়া সম্বলপুরের আরও ট্রেন রয়েছে। গাড়িতে সম্বলপুর থেকে দেওগড় গেলে পথে দেখে নিতে পারেন হীরাকুঁদ বাঁধ, মেরিন ড্রাইভ, সমলেশ্বরী মন্দির।