Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Travel

জলে কুমির ডাঙায় জাগুয়ার

কখনও বিষাক্ত পোকার কামড়, কখনও ধেয়ে আসছে পিরানহা... দেব-এর আমাজ়ন ভ্রমণ এতটাই রোমহর্ষক! সাক্ষী কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়-এর ক্যামেরাএকটা মজার ব্যাপার কী জানেন? দক্ষিণ আমেরিকার আমাজ়নিয়ার সঙ্গে বাঙালির খাবারদাবারের কিন্তু বেশ মিল।

আমাজ়নের অভিজ্ঞতা জানালেন দেব।

আমাজ়নের অভিজ্ঞতা জানালেন দেব।

শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৯ ১৫:৩৪
Share: Save:

লাইফটাইম এক্সপিরিয়েন্স! আমাজ়নে আমার অভিজ্ঞতা এক কথায় তা-ই। ইস্পাতকঠিন জীবন, যেখানে পরোয়ানা ছাড়া মুহূর্তে থাবা বসায় মৃত্যু, সেখানেই আবার প্রাণের অদ্ভুত বৈচিত্র... উপলব্ধি করেছি পলে পলে!

বিমানে দুবাই হয়ে সাও পাওলো, সেখান থেকে মানাউস। এখান থেকেই আমাজ়নের নৌকাযাত্রা শুরু হয়। এই রাস্তাটুকু নৌকো করে ছাড়া যাওয়ার উপায়ও নেই। এখানে রয়েছে আমাজ়নের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা। সেই নদীগুলোয় আমরা শুট করেছিলাম। নদী সংলগ্ন জঙ্গলও আমাজ়নিয়ার মধ্যে পড়ে। এখান থেকে পশ্চিম দিকে গেলে ভেনেজ়ুয়েলা। এই ব্রাজ়িল আর ভেনেজ়ুয়েলার বর্ডারে বসবাস ইয়ানোমামি উপজাতির। যার উল্লেখ রয়েছে ‘আমাজ়ন অভিযান’-এ। এই জায়গাটাই ছিল আমাদের মূল শুটিং স্পট।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর ঘন এই রেনফরেস্টের অধিকাংশটাই জলে ডুবে আছে। বর্ষাকালে জলের উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুটে গিয়ে দাঁড়ায়। স্বভাবতই শুটিংটা আমাদের জলের মধ্যে দাঁড়িয়েই করতে হত। ফলে জলজ প্রাণীদের কামড়ও খেয়েছি। সঙ্গে ট্যারান্টুলা, বুলেট অ্যান্টস-সহ অসংখ্য নাম না জানা পোকামাকড়... ক্রমশ সবই সয়ে গিয়েছিল। পায়ে এসে বসলে ঝেড়ে ফেলে দিতাম!

নদী সংলগ্ন এই জঙ্গলও আমাজ়নিয়ার মধ্যে পড়ে।

আরও পড়ুন: ফিনিক্সের আর এক নাম কিউবা: পরমব্রত​

এখানে বলে রাখি, সব ট্যারান্টুলা কিন্তু সমান বিষাক্ত নয়। সবাই কামড়ায়ও না। এ তো গেল পোকামাকড়।

জলে ছিল ব্ল্যাক কিয়েম্যান (বড় কুমিরের মতো প্রাণী), অ্যালিগেটর, অ্যানাকোন্ডা, বোয়া সাপ, মাটা মাটা (এক ধরনের কাঁকড়া), পিঙ্ক ডলফিন... আর ডাঙায়? জাগুয়ার, পুমা, আর্মাডিলো! ভ্যাম্পায়ার ব্যাট দেখেছিলাম, যেগুলো সত্যিই রক্ত শুষে নেয়! তবে মানুষের নয়। ঘুমন্ত প্রাণীর। ঘরেও ঢুকে যেত কখনও কখনও। সবচেয়ে বেশি সাংঘাতিক জাগুয়ার এবং ব্ল্যাক প্যান্থার। এমনকি শুটিংয়ের সময়ে তাদের আক্রমণের ভয়ও ছিল ষোলো আনা। তবে এর মধ্যেও যে নিজের একশো শতাংশ দিয়ে শুট করতে পেরেছি, তার কারণ শুটের আগে নিজেকে ওই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছিলাম। কমলদা (কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়) তো অ্যানাকোন্ডা গায়ে জড়িয়ে ছবিও তুলেছিলেন! তবে ওখানে শুটিং করতে যাওয়ার আগে আমাদের বেশ কয়েক রকম প্রতিষেধক নিতে হয়েছিল।

আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তাই বলে বিপত্তি কিছু কম হয়নি! আমাজ়নের একটা অংশে শুটিং করতে গিয়ে এক দিন তো গাছের একটা সুচালো অংশ আমার পা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল। আমাদের সঙ্গে অবশ্য সব সময়ে ডাক্তার থাকতেন, কমলদাও ছিলেন। পেশা হিসেবে না নিলেও উনি তো এক জন চিকিৎসক। এক দিন আবার এক টিম মেম্বারের গায়ে গাছ ভেঙে পড়ল! যেটা ওখানে স্বাভাবিক ঘটনা, মাঝেমধ্যেই ঘটে। কমলদা তো রেকি করতে গিয়ে পাহাড় থেকে পড়েও গিয়েছিলেন। প্লাস্টারও করতে হয়েছিল।বুলেট অ্যান্ট কামড়াত ভীষণ। মাঙ্কি স্পাইডার গায়ে উঠে পড়ত। রাতের ঘুমটা মোটেই নিশ্চিন্ত ছিল না। আরি আউ-তে যখন শুটিং করছিলাম, তখন লগ কেবিনে থাকতাম। থাকাটা মোটেই সুখকর ছিল না। সেগুলো ছিল জলের উপরে ভাসমান। ফলে অনেক সময়ে জল ঢুকে পড়ত। নানা রকম প্রাণী, পোকামাকড়ও চলে আসত! তা ছাড়া ঘরগুলো অনেক দিন বন্ধ থাকায়, সে সব ঘরে খুবই ভ্যাপসা গন্ধ। আসলে এ রকম জঙ্গলে শুটিং করতে গেলে এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা তো থাকবেই।

ওই অঞ্চলে নানা উপজাতির বাস। কিছু উপজাতি, যারা সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছে, তাদের সঙ্গে কমিউনিকেট করা যেত। কিন্তু যারা আসেনি, সে সব গ্রামেও গিয়েছি এবং তাদের জীবনধারাও দেখেছি।

নাটাল জলপ্রপাত।

আরও পড়ুন: পাহাড় সমুদ্রের ঐকতান অন্ধ্রপ্রদেশের ভিমুনিপত্তনম​

আসলে ওই অঞ্চলগুলো সোনার খনি এবং আরও নানা মূল্যবান খনিজে সমৃদ্ধ হওয়ায় চোরা ব্যবসায়ীরা জঙ্গল ধ্বংস করে বহু উপজাতিকে উৎখাত করেছে। ফলে তারা নিশ্চিহ্ন। রয়ে গিয়েছে ইয়ানোমামি উপজাতি। তারা একটা প্রিমিটিভ কমিউন সোসাইটির মতো থাকে। তবে ওদের জীবনধারা অনেক কিছু শেখায়ও।

একটা মজার ব্যাপার কী জানেন? দক্ষিণ আমেরিকার আমাজ়নিয়ার সঙ্গে বাঙালির খাবারদাবারের কিন্তু বেশ মিল। ওখানকার প্রধান খাবারও মাছ আর ভাত। তবে মোটা চালের ভাত। মাছ পাওয়া যায় অনেক রকম। পিরাইভা, মাত্রিশা... পিরানহা তো ঝাঁকে ঝাঁকে আসে! তার কামড়ও খেয়েছি প্রচুর। তবে গল্পে বা সিনেমায় যে রকম দেখা যায়, সে রকম কিছু নয়। কমলদার পায়ে কামড়ের দাগ এখনও রয়েছে। যাই হোক, মাছ সিদ্ধ করে খাওয়া হত। উপরে ম্যানিওকা (আহারযোগ্য শিকড়) দেওয়া থাকত। আমাদের মুখে সেটা বিশেষ ভাল লাগত না বলে নুন, মরিচ এ সব ছড়িয়ে নিতাম। এক রকম হোয়াইট ড্রিঙ্ক পাওয়া যায়, কাশাসা। খেতে বেশ ভাল। আর একটা চা পাওয়া যেত, আয়াস্কারা টি। সেটাও দারুণ! কিন্তু খুব নেশা হয় বলে আমরা খেতাম না।

সব মিলিয়ে আ‌মাজ়নিয়া এই ভূখণ্ডেই অন্য এক পৃথিবী! তাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য এই সেলুলয়েডই আমাকে করে দিয়েছে। আর প্রতিকূলতাকে জয় করে শুটিংয়ের আনন্দ ছাপিয়ে গিয়েছে সব বাধাকে।

অনুলিখন: পারমিতা সাহা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE