Advertisement
১১ মে ২০২৪
Travel

গল্পের বাঘ করবেটে টানে

কিন্তু বাঘের দেখা আদৌ মেলে কি? করবেট রং আর রোমাঞ্চ বদলায় ক্ষণে ক্ষণে। কীসের টানে ফিরে ফিরে যাওয়া? লিখছেন সুচন্দ্রা ঘটকসে জঙ্গলে গেলে প্রাপ্তবয়সের মনও খুঁজে বেড়ায় গা ছমছম করা সেই গল্পদের। বাঘ দেখার জ়োন ছেড়ে সাফারি যায় ঢিকালা অঞ্চল, সীতাবাণী অঞ্চলে।

নদী পেরিয়ে অজানার সন্ধানে।

নদী পেরিয়ে অজানার সন্ধানে।

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৯ ১৫:২৮
Share: Save:

ভিড়ভাট্টার শহরে বাঘ-সাজে বহুরূপীকে দেখে পিছন পিছন ছুটেছিল ছোট্ট ভাই। বাঘের বাড়ি দেখবেই সে। দায়িত্ব পড়ল বাবা-মায়ের উপরে। সেই সূত্রেই প্রথম কুমায়ুনের বিখ্যাত জঙ্গল-চত্বরে পা।

করবেট সাহেবের সেই যত্নের অঞ্চল দর্শন অবশ্য তার পরেও হয়েছে বারবার। এক এক বয়সে তা এক এক রূপ ধারণ করেছে। অরণ্য রং বদলায়, কে না জানে? তবে উত্তরাখণ্ডের করবেট ন্যাশনাল পার্ক রূপও বদলায়। একই ভূখণ্ডে এ জঙ্গল হাজার অনুভূতির মিশেল। কখনও একাকী, কখনও মায়াবী, কখনও সোহাগী, কখনও সর্বগ্রাসী।

শৈশবের খেলার মাঠ

নৈনিতাল জেলার বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটারের পথ। পাঁচিলে ঘেরা কারখানা লাগোয়া অফিসার্স বাংলো। সেই বাংলো থেকে বেরিয়ে, ছয় মানুষ সমান গেটের সামনে দাঁড়ানোদের খান দশেক সেলাম পেরিয়ে খেলার মাঠের উদ্দেশে মাঝেমধ্যেই ছুটত ছুটির সকালের গাড়িটা। যেখানে পৌঁছে দম নিতেন চালক, সেটি যে আসলে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি ন্যাশনাল পার্ক, তা বোঝার সময় হয়নি শৈশবে। ছোটি হলদ্‌ওয়ানির ধারকাছে গাড়িটা পৌঁছলে তাই শুধু ডাক দিত সবুজ প্রান্তর জুড়ে খেলার মেজাজ। জানা ছিল না, এ দেশের নামী বাঘেদের ডেরা সেখানেই। কুমায়ুন পর্বতের পাদদেশের সেই অঞ্চলে শাল, পাইন, বাঁশ গাছের মধ্য দিয়ে পিঠে বন্দুক নিয়ে আধা আইরিশ সাহেবের অ্যাডভেঞ্চার, নিজের ইতিহাসপ্রেমী দাদুর দৌলতে কণ্ঠস্থপ্রায়। তবু কখনও ঘন সবুজ, কখনও শ্যাওলা, কখনও বা কচি কলাপাতা আর হলুদে ঘেরা বনাঞ্চল বন্ধুত্বপূর্ণ এক ছুটিরই পরিচয় তখনও। বাঘ তো দূর অস্ত্‌, খান কয়েক প্রজাতির বাঁদর ছাড়া আর বিশেষ কোনও পশুরই দেখা মেলেনি সে সময়ে! ফলে ছুটির দিনের করবেটে সঙ্গে যেত ব্যাট-বল! খেলার ছলে শুধু খোঁজ চলত বাঘের পায়ের ছাপের। থমথমে করবেট-জঙ্গলে সাফারি কাকে বলে, তা দেখবে কৈশোর।

আরও পড়ুন: ময়নামতীর পথের ধারে​

কৈশোরের ন্যাশনাল পার্ক

পর্যটক তখন অষ্টম শ্রেণি। হাতে ‘ম্যান-ইটারস অব কুমায়ুন’। দাবিধুরার সেই বিখ্যাত বাঘের কথা মুখস্থ। হুডখোলা জিপ পেরোল বনাঞ্চলের জলাশয়। সঙ্গীরা সব চুপচাপ। বাঘ বাবাজি নাকি বেরোবেন যখন তখন। গরমের ছুটির ভোরে তাই ফরেস্টের ভিতরের কটেজ থেকে দিনের ঘুম খানিক বাকি রেখেই বেরিয়ে পড়া হয়েছে। জলাধারের পাশে গিয়ে বাঘের অপেক্ষায় দাঁড়াল গাড়ি। সূর্য ওঠার আগেই চুপিসাড়ে আশপাশে এসে হাজির আরও অনেক জিপ। হাতে ক্যামেরা, বড় লেন্স, মাথায় হান্টার্স ক্যাপে ভরে গেল শান্ত বনাঞ্চল।

খেলে বেড়ানোর মুক্তাঞ্চল এ ভাবেই গাম্ভীর্য লাভ করল কৈশোরে পৌঁছে। এ দেশের হাতে গোনা কয়েকটি টাইগার রিজ়ার্ভের মধ্যে এটি একটি, যেখানে ভিতরে থেকেই সাফারিতে বেরোনো যায়।

বড় লেন্স আর উৎসাহী জিপের ভিড়ে বাঘ দেখা দেয়নি। তবে ন্যাশনাল পার্ক, জিম করবেটের যত্নে ঘেরা গা ছমছমে জঙ্গল দেখিয়ে দিতে পেরেছে তার গুরুত্ব। বইয়ে ছবি দেখা শিকারি পাখির দর্শন মিলেছে। মাছ খাওয়া কুমির দেখা দিয়েছে বিশাল সরোবর পেরোনোর পরেই। কয়েক রকমের হরিণ, হাতি নানা সময়ে উঁকি দিয়ে বুঝিয়েছে ‘টাইগার রিজ়ার্ভ’ টাইগার দর্শনের জন্য নয়। বাঘের বাসার মহিমা অন্য রকম।

গাছেদের ফাঁক গলে পথ গিয়েছে বেঁকে।

তারুণ্যের করবেট

বাঘ দেখা হয়নি। পরিচিত এক দম্পতির মধুচন্দ্রিমায় করবেট-অভিজ্ঞতা শিখিয়ে দিয়েছে, সুখে থাকতে বাঘের দর্শন না পেলেও চলে। কটেজের বারান্দা থেকে বাঘের ডাক শুনে নববধূকে সেখানে ফেলেই বন্ধুর ঘরে লুকিয়ে পড়েছিলেন দিন সাতেক আগে বিয়ে করা বর! ম্যান-ইটারদের গল্পের পাশাপাশি শোনা হয়ে গিয়েছে, সে সব সুখ-অসুখের স্মৃতি। করবেটের বাঘ যে এ রকম কত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাক্ষী, কে জানে! বাঘ দেখার ভাগ্য সকলের না থাক, বাঘ যে নিজের উপস্থিতি মাঝেমাঝেই জানান দেয় ইতিউতি। আর না জানান দিলেও করবেটের পাঁচ কিলোমিটার আগে থেকেই অনায়াসে পর্যটকের সঙ্গী হয়ে যায় বাঘেদের নানা গপ্পো।

জিম করবেট গল্পের একটি সঙ্কলনের শুরুতে রাসকিন বন্ড লিখেছিলেন, কলমের ক্ষমতা বন্দুকের নলের চেয়ে বেশি। করবেটের কলমের জোর এতই যে, ১৯৩৬ সালে গড়া ন্যাশনাল পার্ক ঘিরে ছড়িয়ে পড়া বাঘ-শিকারের নানা কাহিনি আজও টেনে নেয়।

সে জঙ্গলে গেলে প্রাপ্তবয়সের মনও খুঁজে বেড়ায় গা ছমছম করা সেই গল্পদের। বাঘ দেখার জ়োন ছেড়ে সাফারি যায় ঢিকালা অঞ্চল, সীতাবাণী অঞ্চলে। সেখানে বাঘের দেখা না পেলেও কুমায়ুন রেঞ্জের ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো সে সৌন্দর্য, স্তব্ধ পথে জঙ্গলের পোকার ডাক, ভিজে বাতাস— সব মিলে জাপটে, জড়িয়ে ধরতে পারে তারুণ্যের করবেট।

যাঁরা বাঘ দেখেন না, তাঁদের কি ভালবাসতে নেই জঙ্গল? করবেটের বাঁকে বাঁকে প্রতিটা গল্প বুঝিয়ে দেবে, কুমায়ুনের সেই অঞ্চল বাঘেদের আস্তানা হলেও শুধুই তেনাদের জায়গা নয়। সে সব গল্পের পরতে পরতে যে সব গাছ-পাখি-জলাশয়-বসতি আছে, সবটা মিলেই বাড়ে এ জঙ্গলের গাম্ভীর্য।

তেনার দেখা পেতে ভাগ্য চাই।

আরও পড়ুন: চাঁদের আলোয় কচ্ছের রণ দেখে এসে লিখলেন অভিনেত্রী সন্দীপ্তা​

কিলোমিটার দুয়েক দূরে গিরজা দেবীর মন্দির। কোশি নদীর ধারে টিলার উপরের মন্দিরের এই দেবী সকল বিপদ থেকে রক্ষা করেন বলেই বিশ্বাস স্থানীয়দের। বাঁচান তিনি বাঘের হানা থেকেও। এ সব নিয়েই বেঁচে থাকে আরও অনেকের গল্প, স্বপ্ন, বিশ্বাস, দিন-রাত!

কোন পথে

কলকাতা থেকে জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কে যাওয়া যায় ট্রেনে কিংবা উড়ানে। সোজা দিল্লি বিমানবন্দরে নেমে গাড়ি ভাড়া করা যায়। পৌঁছতে ঘণ্টা ছয়েক লাগে। দিল্লি গিয়ে একটি ট্রেনে চেপে রামনগরও চলে যাওয়া যায়। তবে জঙ্গলের ভিতরে যেতে পরিচয়পত্র আবশ্যক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE