Advertisement
E-Paper

ময়নামতীর পথের ধারে

শুধুই পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল নয়। বাংলাদেশে গিয়ে ইতিহাসের এক টুকরো তুলে আনলেন শিশির রায়‘লালমাই ময়নামতী গ্রুপ অব মনুমেন্টস’ দেখব। শালবন মহাবিহার, মিউজ়িয়াম দেখব।

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৯ ১৪:৪৯
ময়নামতীর ইটখোলা মুড়া।

ময়নামতীর ইটখোলা মুড়া।

তখন থেকে কী গুনগুন করছিস বল তো?

সে কী! এ তো বিখ্যাত গান! ‘হারমোনিয়াম’ ছবির। মান্না দে-বনশ্রী সেনগুপ্ত। ‘ময়নামতীর পথের ধারে দেখা হয়েছিল...’

আহা, কী সুর!

ময়নামতী যাচ্ছি বলে এ গানটা মনে পড়ল বুঝি?

হ্যাঁ তাই। কী যে ভাল লাগছে! একে তো বাংলাদেশে বেড়াতে আসা, তার উপর ময়নামতী।

যাচ্ছি বটে, তবে মনটা কিন্তু-কিন্তু করছে। বাংলাদেশে এসে সবাই কক্সবাজারের সমুদ্র দেখতে যায়, সিলেটের চা-বাগান, রাঙামাটি-বান্দরবনের পাহাড়, কুয়াকাটায় সূর্যাস্ত। আর আমরা কি না বাসে চেপে কুমিল্লার ময়নামতী... তোর এই ইতিহাস নিয়ে ইয়েটা বাড়াবাড়ি।

আরও পড়ুন: জলে কুমির ডাঙায় জাগুয়ার​

ঢাকা থেকে এত কাছে, মাত্র দু’ঘণ্টার পথ। না গেলে হয়? আর ইতিহাস বলছিস, তুই তো সে বার নালন্দা দেখে লাফাচ্ছিলি!

আহ, সে তো নালন্দা। গ্র্যান্ড একটা ব্যাপার!

ময়নামতীও কম কিছু নয়। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, নালন্দার পরে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শিক্ষাকেন্দ্র ছিল এই লালমাই-ময়নামতী অঞ্চল।

আচ্ছা! কাল্টিভেট করতে হচ্ছে। লালমাই ব্যাপারটা কী?

কুমিল্লার পাহাড়ের একটা রেঞ্জ। আড়ে-বহরে-উচ্চতায় বেশি নয় মোটেই। পাহাড় এলাকা। ঢিবি, টিলায় ভরা। তবে এই পাহাড়ের বয়স জানিস? ২৫ লক্ষ বছর তো হবেই! উত্তরের দিকটা ময়নামতী, দক্ষিণাংশ লালমাই নাম। লাল মাটি, সেখান থেকে ‘লালমাই’ হতে পারে।

এখানে আমরা কী কী দেখব?

‘লালমাই ময়নামতী গ্রুপ অব মনুমেন্টস’ দেখব। শালবন মহাবিহার, মিউজ়িয়াম দেখব। আনন্দ বিহার, কোটিলা মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, রূপবান মুড়া, রানি ময়নামতীর প্রাসাদ, চণ্ডী মুড়া... উফ, কত্ত কিছু! ভেবেই লাফিয়ে উঠছি!

প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার।

দেখিস, বাসের ছাদে মাথা ঠুকে যাবে। এত কিছু এক দিনে দেখা যাবে?

জানি না সব দেখা যাবে কি না। কারণটা সময়াভাব নয়। বহু প্রত্নস্থলই এখন ময়নামতী ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মধ্যে। তাই নিরাপত্তার কড়াকড়ির একটা ব্যাপার তো আছেই।

বুঝলাম। আচ্ছা, এই ‘মুড়া’ কেসটা কী? রানি ময়নামতীই বা কে?

মুড়া মানে টিলা, ছোট পাহাড়। ইটাখোলা মুড়া নাম থেকে পরিষ্কার, ওখানে ইট পোড়ানোর কাজ হত । তোকে তো ছবি দেখিয়েছি, দেখবি কী বাহারি ইট ময়নামতীর বিহারে! গোল গোল স্তম্ভ, ওগুলোও ইউনিক! অন্তত তিনটে রাজবংশ এই অঞ্চলের শাসক ছিল। দেব বংশ, চন্দ্র বংশ, খড়্গ বংশ। আমরা বলছি সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে তার পরের কয়েকশো বছরের কথা। চন্দ্রবংশেরই এক রাজা মানিকচন্দ্রের রানি ছিলেন ময়নামতী। যদ্দূর জানা যায়, চন্দ্রবংশের শেষ রাজা গোবিন্দচন্দ্রের মা ছিলেন তিনি। তবে ময়নামতীর বাংলো বা প্রাসাদ বলতে আবার উদয়পুর প্যালেস কি কোচবিহার রাজবাড়ির মতো ভেবে বসিস না!

আরও পড়ুন: চাঁদের আলোয় কচ্ছের রণ দেখে এসে লিখলেন অভিনেত্রী সন্দীপ্তা​

দাঁড়া দাঁড়া। রানি-কাহিনির পাশে ওই বিহার, ভিক্ষু, শিক্ষাকেন্দ্র— এগুলো কোত্থেকে এল?

তোকে নিয়ে আর পারি না। রাজারাই তো পৃষ্ঠপোষক, নানান সময়ে বানিয়ে দিয়েছেন। আর এ যে সময়ের কথা বলছি, তখন বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল এই এলাকা। তাই বিহার, মানে মঠ গড়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের থাকার, পড়াশোনার, শাস্ত্রচর্চার ব্যবস্থা। যেমন শালবন মহাবিহার তৈরি করেছিলেন দেববংশের রাজা ভবদেব। গিয়ে দেখবি, ভিক্ষুদের থাকার কুঠুরি আছে ওখানে, ১১৫টা। ছোট্ট ছোট্ট ঘরেকুলুঙ্গিও আছে, সেখানে নিশ্চয়ই বুদ্ধমূর্তি রাখা থাকত, প্রদীপ জ্বলত সামনে। বুদ্ধের মন্দির ছিল, স্তূপ, চৈত্য ছিল, ভিক্ষুদের ডাইনিং হল এবং হলঘরও। এই সব কিছুই কিন্তু কয়েকশো বছর ধরে গড়ে উঠেছে একটু একটু করে। অন্তত ছ’টা নির্মাণ যুগের ইঙ্গিত স্পষ্ট। চণ্ডীমুড়া আবার অন্য সবার থেকে আলাদা, সেখানে চণ্ডী আর শিবের মন্দির আছে!

এই সমস্ত কিছুই খুঁড়ে বার

করা হয়েছে?

প্রত্নস্থলের ক্ষেত্রে যেমনটা হয় আর কী। আবার অনেক জায়গা, অনেক অমূল্য জিনিস নষ্টও হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এখানে সেনা শিবির বসেছিল, সেনারাই অনেক জায়গায় প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ খুঁজে বার করে। কিন্তু যা হয়, কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই সুযোগসন্ধানী, গুপ্তধনলোভী অনেকের হাতে পড়ে বহু ধ্বংসস্তূপের দফারফা হয়। শুনেছি সব প্রত্নস্থলে এখনও ভাল ভাবে খননকার্য হয়নি। তার মানে ইতিহাসকেআরও অনেক কিছু দেওয়ার আছে ময়নামতীর।

কী কী পাওয়া গিয়েছে রে?

প্রচুর সোনা আর রুপোর মুদ্রা। সমুদ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময়কার স্বর্ণমুদ্রাও পাওয়া গিয়েছে। সিলমোহর পাওয়া গিয়েছে অজস্র, আর টেরাকোটা স্থাপত্য, তাম্রলিপি। সেই সব লিপি পড়ার পর বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস নতুন করে লিখতে হয়েছে! আর পাওয়া গিয়েছে পাথরের মূর্তি। আমার ফোনের ওয়ালপেপারটা দেখেছিস তো? বিরাট এক বজ্রসত্ত্বের মূর্তির ছবি, ব্রোঞ্জের তৈরি। এই ময়নামতীর সংগ্রহশালাতেই রাখাআছে।

আজ তো বুধবার, খোলা থাকবে তো রে সব?

থাকবে। ওয়েবসাইট দেখে নিয়েছি। মিউজিয়াম গরমকালে ১০-৬টা, শীতে ৯-৫টা খোলা। দুপুরে আধ ঘণ্টার ব্রেক। আমরা ভারতীয়রা এখানে সার্ক কান্ট্রিভুক্ত বিদেশি

বলে গণ্য, আমাদের জন্য টিকিট একশো টাকা।

এক বার কুমিল্লা শহরে যাবি তো রে? আমার একটু কাজ আছে।

আরও পড়ুন: সাউন্ড অব মিউজ়িকের শহরে​

শহরে আবার কী কাজ? ঢাকা ফিরতে হবে তো।

রসমালাই খাব। কুমিল্লার রসমালাই বিখ্যাত। দোকানের নামও জেনে নিয়েছি।

হাহাহা। সেও হবে। এখন চল, ওই যে ক্যান্টনমেন্ট বাজার আসছে মনে হচ্ছে। এখানেই নামতে হবে।

ছবি: মো. রায়হানুল হাই

(কী কিনি, কী খাই: ময়নামতী জাদুঘরে কিনতে পারেন পিকচার পোস্টকার্ড, বই, স্মারক। বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট (বার্ড)-এর শো-রুম থেকে কেনা যেতে পারে বাংলাদেশের খদ্দর কাপড়, নকশি কাঁথা। বার্ড-এর ক্যাফেটেরিয়ায় খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে। কুমিল্লা শহরে ‘মাতৃ ভাণ্ডার’-এর মিষ্টি, বিশেষত রসমালাই খেতে ভুলবেন না।)

Travel Tourism Bangladesh Mainamati
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy