Advertisement
E-Paper

‘ঈশ্বরের আপন দেশ’ কেরল আপনাকে স্বাগত জানায়

কেরল ভ্রমণের আদর্শ সময় অক্টোবর থেকে মার্চের মাঝামাঝি। এখন থেকেই পরিকল্পনা করতে শুরু করুন। আজ প্রথম পর্ব।

শ্রেয়সী লাহিড়ী

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৯ ১৩:৫০
আথিরাপল্লির জলপ্রপাত।

আথিরাপল্লির জলপ্রপাত।

মালয়ালম ভাষায় ‘কেরল’ শব্দের অর্থ ‘নারকেলের দেশ’। ভারতের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে মালাবার উপকূল জুড়ে গড়ে ওঠা এই রাজ্যটি ভারতের পর্যটন মানচিত্রে অন্যতম প্রধান নাম। মায়াবী সৈকতের গায়ে আছড়ে পড়া আরব সাগরের ঢেউ, ভেষজে সমৃদ্ধ সহ্যাদ্রি পর্বত, ঢেউ খেলানো সবুজ চা-বাগান, উচ্ছ্বল ঝর্না, ব্যাকওয়াটারের ধারে গ্রামজীবনের ছবি, রাজকীয় হাউজবোট, সংরক্ষিত অরণ্যে পাখি ও বন্যপ্রাণীর বিচরণ, কফি ও মশলা বাগান, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ও স্পা— এ যেন সত্যিই ‘ভগবানের আপন দেশ’। দ্রাবিড়ীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাসে সমৃদ্ধ কেরল আজ দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে বিশেষ ভাবে আকর্ষণীয়। কেরলের রাস্তাঘাট খুবই উন্নত ও পরিচ্ছন্ন। মানুষজনের ভদ্র ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার সবসময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রেখেছে। কেরল ভ্রমণ কোচি থেকে শুরু করে তিরুঅনন্তপুরমে শেষ করা যায়। অথবা উল্টো ভাবেও সফরসূচি তৈরি করা যেতে পারে।

এর্নাকুলাম-কোচি

ভেম্বানাদ হ্রদের তীরে পাশাপাশি দুই যমজ শহর। একটি বন্দরনগরী কোচি (পূর্বনাম নাম কোচিন) আর অন্যটি রাজ্যের প্রধান বাণিজ্যনগরী এর্নাকুলাম। সবুজে ঘেরা এর্নাকুলাম ‘আরবসাগরের রানি’র শিরোপাটিও অর্জন করেছে। ইতিহাস ও প্রকৃতিকে একসঙ্গে উপভোগ করতে কমপক্ষে দুটো দিন এখানে থাকতেই হবে।

প্রথম দিনটা শহর ও তার আশপাশ দর্শনে বেরিয়ে পড়ুন। বড় বড় ইমারত, দোকানবাজার, অফিস-কাছারিতে জমজমাট শহরটা সদাই কর্মব্যস্ত। জাহাজ তৈরির কারখানাকে পাশ কাটিয়ে প্রথমেই চলুন ফোকলোর মিউজিয়াম। কেরলের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মিশেলে তৈরি নানান হস্তশিল্পের সম্ভারে সাজানো এই সংগ্রহশালাটি দেখলে তাক লেগে যাবে। কাঠের আসবাব, ঘর সাজানোর টুকিটাকি, ট্র্যাডিশনাল পোশাক ও অলঙ্কার, বাদ্যযন্ত্র— সব মিলিয়ে গোটা রাজ্যটাই যেন এক ছাদের তলায় এসে হাজির হয়েছে।

দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে বিশেষ ভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে কেরল।

আরও পড়ুন: কেরলের অচেনা অভয়ারণ্য মরমিয়া শেনদুরনি​

কারুকার্যময় হস্তশিল্পের প্রদর্শনী দেখে চোখ ধাঁধিয়ে গেলে মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে চলে আসুন ওয়েলিংটন দ্বীপে। দুই পারের সংযোগস্থাপনে আছে এক লম্বা ব্রিজ। এর উপর দিয়ে চলতে চলতে শহরের আকাশছোঁয়া অট্টালিকাগুলোর পাশাপাশি জাহাজ নির্মাণের কারখানাটিও দৃশ্যমান।

ওয়েলিংটন দ্বীপে পৌঁছে মাত্তানচেরি প্যালেসে ঢুকে পড়ুন। অনেকে অবশ্য একে ডাচ প্যালেস নামেও চেনেন। নজরকাড়া কাঠের কারুকাজ, রামায়ণ-মহাভারত ও পৌরাণিক উপাখ্যানে চিত্রিত দেওয়াল ও ম্যুরাল চিত্র দেখে মুগ্ধতাকে সঙ্গী করেই পরবর্তী গন্তব্য জিউস টাউনে পৌঁছে যান।

ভারতের পশ্চিম উপকূলে ইউরোপীয় বণিকদের যাতায়াত শুরু হয়েছিল প্রায় ৫০০ বছর আগে। পর্তুগিজ, ইংরেজ, ওলন্দাজের পাশাপাশি ইহুদিদের স্মৃতি বহন করছে ‘জিউস টাউন’ অঞ্চল। অতীতে এখানে ইহুদিদের বাস ছিল। ইহুদি পাড়ায় হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়ুন কোনও কিউরিও শপ বা হস্তশিল্পের বিপণিতে। দাম যদিও বেজায় চড়া। না কিনলেও,দেখতে ভালই লাগবে। এ ছাড়া, বড় বড় মশলার দোকানও আছে জমজমাট এই এলাকাতে। ইহুদিরা আজ আর না থাকলেও হিব্রু ভাষায় সাইনবোর্ডগুলি অতীতের সাক্ষ্য বহন করে।

সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ।

কাছেই আর এক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে পর্তুগিজ বণিক ভাস্কো-দ্য-গামার বাসস্থানটি। তাঁর আগমনের সময়কালটি ছিল ১৫০২ সাল। পাশেই ভারতের প্রাচীনতম সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ। ১৫২৪ সালে এই চার্চেই ভাস্কো-দ্য-গামাকে সমাধিস্থ করা হলেও ১৪ বছর পর তাঁর কফিনটি তুলে নিয়ে যাওয়া হয় পর্তুগালে। চার্চ থেকে বেরিয়ে ক্র্যাফ্ট সেন্টার,মশলার দোকান, স্পা ও হার্বাল চিকিৎসা কেন্দ্রের পাশ দিয়ে পায়ে হেঁটে চলুন ফোর্ট কোচির দিকে। অতীতে পর্তুগিজদের তৈরি দুর্গটির আজ বিধ্বস্ত অবস্থা। কাছেই ব্যাকওয়াটার। লাইন দিয়ে ভেসে থাকা চাইনিজ ফিশিং নেটগুলি এর শোভা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। জাহাজের আনাগোনা, জেলেদের ব্যস্ততা দেখতে দেখতে দিনের শেষে ফিশিং নেটের ফাঁক দিয়ে রোম্যান্টিক সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

সন্ধ্যাটুকু উপভোগ্য হয়ে উঠুক কথাকলি নৃত্যানুষ্ঠানে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার মধ্যে চলে আসুন কোচিন কালচারাল সেন্টারে। এ ছাড়া এর্নাকুলামে সি ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনেও প্রতি সন্ধ্যায় নাচের শো হয়। কেরলের মন্দিরগুলোতে পুজো উপলক্ষ্যে হাতির শোভাযাত্রা ও পঞ্চবাদ্যম্‌ (তিমিলা, মাড্ডালাম, ইলাথালাম, ইডাক্কা, কম্বু— এই পাঁচ বাদ্যযন্ত্রের অর্কেষ্ট্রা) অনুষ্ঠিত হয়। ভাগ্যে থাকলে এক অসাধারণ দ্রাবিড়ীয় কনসার্টের সাক্ষী হয়ে থাকবেন।

ভাজাচাল জলপ্রপাত।

আরও পড়ুন: ভাবা’র বুকে এক টুকরো কাশ্মীর

দ্বিতীয় দিনের গন্তব্য ‘রাবণ’ ছবি খ্যাত ত্রিসুর জেলায় কেরলের অন্যতম দ্রষ্টব্য আথিরাপল্লি জলপ্রপাত। নিবিড় বনানীর বুক চিরে পথ চলা। গ্রাম্য শোভা দেখতে দেখতে ৬৪ কিলোমিটার মনোরম যাত্রাপথ শেষ হবে সুন্দরী আথিরাপল্লির সামনে। পশ্চিমঘাট পর্বতের চালাকুড়ি নদী ৮২ ফুট উপর থেকে দুর্নিবার গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা নীচে নেমে উপভোগ করুন এর ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ। বর্ষায় ভরা যৌবনে সে আরও অপরূপা হয়ে ওঠে।

আথিরাপল্লির মুগ্ধতাকে সঙ্গে নিয়ে মূল সড়ক থেকে ৫ কিলোমিটার এগিয়ে পৌঁছে যান ভাজাচাল জলপ্রপাতের কাছে। সবুজঘন অরণ্যের পাশ দিয়ে তীব্র গতিতে বয়ে চলেছে ভাজাচাল। দুপুরের খাওয়াটা কাছেই স্থানীয় কুটিরে সেরে নিন। ঘরোয়া পরিবেশে খাঁটি কেরলীয় থালির স্বাদগ্রহণ হয়ে উঠবে এক অভিনব অভিজ্ঞতা।

সফরসূচিতে একটা দিন বাড়িয়ে নিতে পারলে তৃতীয় দিন কোচি থেকে দেখে নিন স্বল্প পরিচিত দুই সৈকত, চেরাই ও কুজুপিল্লি। একটা গোটা দিন বরাদ্দ করতে পারলে ভাল হয়। তবে হাতে মাত্র দু’দিন সময় থাকলে প্রথম দিনই সকাল সকাল ফোর্ট কোচি ঘুরে দুপুরের দিকে চলে যান এই নির্জন সৈকতে। ফোর্ট কোচি থেকে ভাইপিন দ্বীপে চলে মজাদার বার্জ পারাপার। সঙ্গে গাড়ি থাকলেও কোনও অসুবিধা নেই। টিকিট কেটে গাড়ি সমেত উঠে পড়ুন বার্জে। মানুষজন, সাইকেল, বাইক, গাড়ি— সবাইকেই পার করে দিচ্ছে বার্জ। সঙ্গে গাড়ি না থাকলে ভাইপিন দ্বীপে নেমে অটো ধরে চলে আসুন ২৫ কিলোমিটার দূরে মনোরম চেরাই সৈকতে। নিস্তব্ধ এই সোনালি বেলাভূমিতে বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে ডলফিনের দেখা মেলে। ৫ কিলোমিটার দূরে পিল্লিপুরম ফোর্ট আর লাইট হাউস দেখে নিতে পারেন। এ ছাড়া সমুদ্রস্নানের আনন্দ তো আছেই। চেরাইয়ে রাত্রিবাস করে চাঁদের আলোয় নিস্তব্ধ সৈকতের গায়ে আছড়ে পড়া ঢেউ দেখার রোম্যান্টিক অভিজ্ঞতা সত্যি ভোলার নয়। রাত্রিবাস না করলেও সারাটা দিন নিরিবিলিতে উপভোগ করুন সমুদ্রের মনোরম শোভা।

চেরাই থেকে দেড় কিলোমিটার আগে আর এক অচেনা শান্ত বেলাভূমি কুজুপিল্লি। মূল সড়ক থেকে ব্যাকওয়াটারের বুক চিরে সরু পথ চলে গিয়েছে বিচের দিকে। চেরাই থেকে নির্জন সৈকত ধরে পায়ে হেঁটেও চলে আসতে পারেন কুজুপিল্লি। সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে নারকেল গাছ আর ঝাউবন। শুকনো নারকেল পাতার ছাউনির নীচে দাঁড়িয়ে এক মনোমুগ্ধকর সূর্যাস্তের সাক্ষী থাকুন।

মনোমুগ্ধকর সূর্যাস্তের সাক্ষী থাকুন কুজুপিল্লিতে।

ত্রিপুনিথুরায় ১৮৬৫ সালে স্থাপিত কোচি রাজাদের হিল প্যালেসটি বর্তমানে মিউজিয়াম। রাজপরিবারের ব্যবহৃত পোশাক-পরিচ্ছদ, অলঙ্কার, পেন্টিং, মুদ্রা, অস্ত্র, পুঁথিপত্র, বিদেশ থেকে প্রাপ্ত উপহারসামগ্রী প্রভৃতি প্রদর্শিত করা আছে। কেরলীয় শৈলিতে তৈরি প্যালেসটির সূক্ষ্ম কারুকার্যময় কাঠের পিলারগুলি দেখলে বিস্মিত হতে হয়। কোচি থেকে দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। মুন্নার যাওয়ার পথেও দেখে নেওয়া যায় হিল প্যালেস মিউজিয়ামটি।

কেনাকাটা

ভাজাচালে ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির বনশ্রী থেকে কিনতে পারেন খাঁটি মধু, কফি, পাম তেল, মশলা প্রভৃতি। এ ছাড়া কোচিতে কিউরিও, হস্তশিল্পের সম্ভার তো আছেই।

যাত্রাপথ

কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেন যাচ্ছে এর্নাকুলাম। হাওড়া থেকে ২২৮৭৭ হাওড়া-এর্নাকুলাম অন্ত্যোদয় এক্সপ্রেস (শনি) যাচ্ছে এর্নাকুলাম জংশন। শালিমার থেকে ২২৬৪২ শালিমার-ত্রিবান্দ্রম সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস (রবি, মঙ্গল) ও ১২৬৬০ গুরুদেব এক্সপ্রেস (বুধ) যথাক্রমে এর্নাকুলাম জংশন ও এর্নাকুলাম টাউন যাচ্ছে। এ ছাড়া কলকাতা থেকে ট্রেনে বা বিমানে চেন্নাই পৌঁছে, চেন্নাই সেন্ট্রাল বা চেন্নাই এগমোর স্টেশন থেকেও ট্রেনে যেতে পারেন এর্নাকুলাম। সরাসরি কলকাতা থেকে বিমানেও কোচি পৌঁছতে পারেন।

আরও পড়ুন: গল্পের বাঘ করবেটে টানে​

শহরের আশপাশ অটো বা গাড়িভাড়া করে দেখে নিন। গাড়িভাড়া করে চেরাই, কুজুপিল্লি বেড়ানো সুবিধাজনক। গাড়ি-সহ বার্জে উঠে ভাইপিন দ্বীপে যাওয়া এক দারুণ অভিজ্ঞতা। এ ছাড়া, লঞ্চে ভাইপিন দ্বীপে পৌঁছে বাসে আসুন চেরাই জংশন। সেখান থেকে অটোয় চলুন চেরাই। তবে ঝক্কি এড়াতে ভাইপিন দ্বীপে পৌঁছে সেখান থেকে অটোভাড়া করে অচেনা দুই সৈকত দেখে নিন। গাড়িভাড়া করে বেড়িয়ে নিন আথিরাপল্লি।

মারুতি, ইন্ডিকা প্রভৃতি ছোট গাড়ির ভাড়া ১৬০০-১৭০০ টাকা, ট্যাভেরা, জাইলো গাড়ির ভাড়া ১৬০০ টাকা, ইনোভা, কোয়ালিস গাড়ির ভাড়া ১৯০০-২০০০ টাকা।

গাড়ির জন্য যোগাযোগ করতে পারেন: আর বিশ্বনাথন ৯৪৪৬১৭৬৫৮৬, ৮৯২১৩৯৩৬৫৭। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু সংস্থা আছে যারা গাড়ির ব্যবস্থা করে দেয়।

রাত্রিবাস:

কোচি

কেরল ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের হোটেল বোলগেট্টি প্যালেস অ্যান্ড আইল্যান্ড রিসর্ট, ফোন: ০৪৮৪-২৭৫০৫০০। ভাড়া: প্রাতরাশ সমেত ৪২০০-১৩১০০ টাকা, ট্যাক্স আলাদা।

Website: www.ktdc.com

কেরল ট্যুরিজম যাত্রী নিবাস, যোগাযোগ: ০৪৮৪-২৩৩৯৯৮০, দ্বিশয্যা ঘর ভাড়া: ৩০০ টাকা

Website : www.keralatourism.org

এ ছাড়া শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বেসরকারি হোটেল ও লজ। ভাড়া ৬০০-৪০০০ টাকা।

চেরাই

চেরাই বিচ রিসর্ট (৯৮৪৭২৩১৪০০), ভাড়া ৪৫০০-১২০৫০ টাকা,

মারে ব্লু রিসর্ট (৭৩৫৬১২৭৭৭৯), ভাড়া ২৫০০-৩৮০০ টাকা।

ছবি: লেখক।

Travel Tourism Holiday Kerala
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy