Advertisement
E-Paper

আবার আসার নিমন্ত্রণ পাঠাল ঘালেটর

হোমস্টের বারান্দায় কাঠের চেয়ারে বসে অদ্ভুত লাগছিল। সামনে একের পর এক ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। তা বেয়ে উঠে আসছে মেঘ।

সৌরাংশু দেবনাথ

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৮ ১৮:৪৪
মোহময়ী কাঞ্চনজঙ্ঘা, ঘালেটর থেকে।

মোহময়ী কাঞ্চনজঙ্ঘা, ঘালেটর থেকে।

হাত বাড়ালেই মেঘ। শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। স্পর্শ করছে মনকে। যেন হাতছানি দিচ্ছে, হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে নিজের সঙ্গে। কোন স্বপ্নপুরীতে, কে জানে!

হোমস্টের বারান্দায় কাঠের চেয়ারে বসে অদ্ভুত লাগছিল। সামনে একের পর এক ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। তা বেয়ে উঠে আসছে মেঘ। ঢেকে ফেলছে দিগন্ত। ধোঁয়া ধোঁয়া সাদাটে লাগছে চারপাশ। কয়েক হাত দূরের গাছপালাকেও দেখাচ্ছে কেমন যেন অপার্থিব। আমাদের রোজকার রুটিনের থেকে এ একেবারেই অন্য দুনিয়া।

বর্ষায় পাহাড় এমনই। দিনভর মেঘের আনাগোনা। আর সে মেঘেরও কত না বৈচিত্র। কখনও ঘন কালো, বজ্র-বিদ্যুত্ সহ গর্জে ওঠার হুমকি। কখনও তা ধূসর। মন কেমন করা অনুভূতির। আবার কখনও তা সাদা। সব দূরত্ব ঘুচিয়ে অবলীলায় ঘরে ঢুকে পড়ার লাইসেন্স নেওয়া।

বয়ে চলেছে রিয়াং নদী।

আরও পড়ুন: ইনদওর-উজ্জয়িনী-মান্ডু-মহেশ্বর-ওঙ্কারেশ্বর-হনুবন্তিয়া​

আরও পড়ুন: কানহা-অমরকণ্টক-বান্ধবগড়-জবলপুর-পেঞ্চ​

এসেছি ঘালেটরে। উত্তরবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে যা অভিষেকের পরে হাঁটি হাঁটি পায়ের দশায়। জায়গাটা সিটংয়ের উপরের দিকে। আপার সিটং লেখাই যায়। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে সেবক হয়ে করোনেশন ব্রিজ ছাড়িয়ে কালিঝোরা ফেলে বিরিক মোড় থেকে বাঁ দিকে ওপরে ওঠার রাস্তা। খাড়াই পথে ক্রমশ তিস্তাকে অনেক নীচে ফেলে ওঠা। দুই পাশে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আপন ছন্দে এগিয়ে চলা। কখনও ঝরা পাতা উড়িয়ে, কখনও নিঃসঙ্গ পথিককে পিছনে ফেলে। ঘনঘোর বর্ষার আবহে এই রাস্তাই রোমাঞ্চ আনে। ভাল লাগে এ ভাবেই চলতে। গুন গুন গাইতে ইচ্ছে করে, ‘এ যেন অজানা এক পথ, কে জানে কোথায় হবে শেষ...’

আসতে আসতেই জানলাম, এই রাস্তা গিয়ে পড়েছে বগোরা হয়ে দিলারামে। সেখান থেকে দার্জিলিংও খুব দূরে নয়। আবার এই পথ ধরেই চিমনি হয়ে ডাউহিল বা কার্শিয়াংয়েও আসা যায়। আমাদের এত দূর যাওয়ার প্রশ্ন ছিল না। মানা মোড়ে গাড়ি বেঁকল ডান দিকে। গন্তব্য কয়েক কিমি দূরে বিক্রম রাইয়ের ‘বিশেষ হোমস্টে’। রাস্তার গায়েই বড় বড় অক্ষরে যা লেখা। পরিবারের ছোট ছেলে বিশেষ ক্লাস টেনের ছাত্র। তার নামেই হোমস্টে। রাই পরিবারের বড় ছেলে বিনেশ পড়ে ম্যানেজমেন্ট, ছুটিতে দেখভাল করে হোমস্টের অতিথিদের। রয়েছে নাচের শখও। এক বার ঘুরেও এসেছে নাচের রিয়্যালিটি শো থেকে। গল্প করতে করতেই তথ্যগুলো জেনে যাবেন আপনি।

বিশেষ হোমস্টে।

অগস্টের ঘনঘোর বর্ষায় পাহাড় আসা নিয়ে কম সাবধানবাণী শুনতে হয়নি। বৃষ্টিতে কিছুই দেখা যাবে না। ধস নামতে পারে। আরও কত কী! সঙ্গে আবার বছরখানেকও না হওয়া ছোট্ট সূর্যাভ। ওইটুকু ছেলে নিয়ে পাহাড়! চোখ কপালে উঠেছিল অনেকের। মনে মনে বলেছিলাম, ছয় মাসেই যার পাহাড়ে অভিষেক হয়েছে, এগারো মাসে তার সমস্যা হবে না।

কেউ কেউ বলেছিলেন কাঞ্চনজঙ্ঘা তো দূর, রোদের দেখাই মিলবে না। ভুল নয়। মধ্য অগস্টে বার কয়েক এসে নিজের অভিজ্ঞতাও তাই। তবু, বর্ষার পাহাড়ও অত্যন্ত মনোরম। দরকার অনুভবের। উত্তরবঙ্গ মানে তো শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘা নয়। মেঘ জড়িয়ে থাকা পাইন বন, ছোট্ট পাহাড়িয়া গ্রাম, কয়েক ঘর বসতি, সারল্য মাখা শিশু, সবুজাভ পাহাড় ও আরও কত কী। যা হয়তো স্রেফ অনুভূতিই চিনতে পারে!

অহলদারায় রবি ঠাকুরের মুখাবয়ব যেন ফুটে উঠেছে পাহাড়ের গায়ে।

গাড়ি থেকে নামতে নামতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। পাহাড় যেন স্বাগত জানাল। এসো, দেখো, জানো, মিশে যাও প্রকৃতিতে। ঘরে ঢুকেই চমক। ঘর নয়, পেল্লাই সাইজের যেন হলঘর। বড় বড় জানলা। দরজার দরকারই নেই, রৌনক তো জানলা দিয়েই ঘরে ঢুকছিল-বেরচ্ছিল। বিছানায় রাখা টুথব্রাশ আর পেস্ট। একপাশে চার জোড়া জুতোও। উত্তরবঙ্গ বা সিকিমে এমন হোমস্টে তো কোথাও দেখিনি। বিস্ময়ের সঙ্গে জন্ম নিল ভাল লাগাও। এত আন্তরিকতা সহজে দেখা যায় না!

পর পর খান চারেক ঘর। তিন থেকে চার জন থাকতে পারেন আরামসে। পাশে ডাইনিং রুম। সেটাও প্রশস্ত। একটু নীচে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে ওপাশেও খান কয়েক ঘর। রাই পরিবারের আস্তানা ছাড়াও পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা। একটা ডাইনিং রুমও সেখানে। ছাদের ওপর প্রকৃতি সেখানেও অবারিত। চেয়ার টেনে বসেই কাটিয়ে দেওয়া যায় সকাল থেকে রাত। রয়েছে আধুনিক পরিকাঠামো। তার সঙ্গে মিশেছে রুচিবোধ, আন্তরিকতা। দুর্লভ মেলবন্ধন।

সুন্দরী ঘালেটর।

যাঁরা বেড়াতে এসে নিছক ট্যুরিস্ট হয়ে থাকতে চান না, প্রকৃতিতে মিশে যেতে চান, পাহাড়িয়া জীবনের স্বাদ পেতে চান, একটু নির্জনতার সন্ধান চান, তাঁদের কাছে ঘালেটর আদর্শ। পাহাড়ের বুক চিরে চলে যাওয়া রাস্তায় আপন মনে পা ফেলে এগনোই যায় আনন্দে। আমরা খাওয়াদাওয়া সেরে সেটাই করলাম। কয়েক ঘর বসতি। আঙুলে গোনা কিছু দোকান। ডান দিকে ছোট একটা মাঠ। ফুটবল খেলছে ছেলেরা। সহজ-সরল অনাবিল জীবন। সমতলের জটিলতা থেকে অনেক দূরেরও।

ফিরতে না ফিরতেই নামল ঝেঁপে বৃষ্টি। সমতলের থেকে যার মেজাজ, চরিত্র একেবারে আলাদা। গুরুগুরু গর্জন, বজ্রপাত, টিনের চালে টুপটাপ জল পড়ার শব্দ। এ যেন অন্য এক জগৎ। বারান্দার আলো নিভিয়ে রইলাম বসে। দূরে পাহাড়ে জোনাকির মতো মিটমিট করছে এ দিক-ও দিক আলো। মেঘের দাপটে তা যদিও নিষ্প্রভ। আবেশ কাটাল গরম গরম পকোড়া আর চা। টের পেলাম, খিদে পেয়েছে। চায়ের কাপ হাতে পাহাড়ে বৃষ্টি উপভোগের মুহূর্তকে মনে হল স্বর্গীয়।

নামথাং লেক। এখানেই পাওয়া যায় স্যালামান্ডর।

পর দিন ভোরবেলায় উঠলাম, যদি মেঘের চাদর সরিয়ে উঁকি দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘা। নাহ, হতাশই হলাম। মেঘে ঢেকে রয়েছে পাহাড়। অগত্যা ফের কম্বল টেনে বিছানায়। ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল আশপাশ। উঠতেই হল খানিকক্ষণ পরে। ব্রেকফাস্টে কেউ নিল ওয়াই-ওয়াই। কেউ পুরি-সব্জি। চায়ের পর্ব মিটিয়ে গাড়িতে ওঠা। সেই মানা মোড় পেরিয়ে প্রথমেই পড়ল নামথাং লেক। রাস্তার পাশে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়়ে পাইন বন। তার লাগোয়া লেক। পাইন বনে ঘেরা। অসাধারণ আবহ। ডুবে মৃত্যুর ঘটনার পর ঘিরে ফেলা হয়েছে লেক। এখানেই বিরল প্রজাতির স্যালামান্ডরের দেখাও মেলে। তবে তার জন্য দরকার ধৈর্য, দরকার সময়ও।

আকাশ একটু পরিষ্কার হওয়াতে শুভেন্দু তাড়া লাগাল। শিলিগুড়ির ইতিহাস শিক্ষকের কথাতেই ঘালেটরে আসা। এখানের মণি-মুক্তো সব ঠিকঠাক দেখাতে না পারলে ওঁরই যেন বেশি অস্বস্তি। অগত্যা, এ বার গন্তব্য অহলদাড়া। পাহাড়ের মাথায় খানিকটা সমতল জায়গা। যেখান থেকে দেখা যায় ৩৬০ ডিগ্রি। খান তিনেক ঘরও রয়েছে সেখানে। পাশেই একটা দোকান। খাওয়াদাওয়া সেখানে। তবে সন্ধে নামলেই দোকানপাট বন্ধ করে স্থানীয়েরা ফিরে যান গ্রামে। নিঝুম অহলদাড়া হয়ে ওঠে প্রকৃতিরই অঙ্গ। ব্যাপার দেখে তিন্নি তো ঠিক করে নিল, নভেম্বরে এখানেই থাকতে হবে। কাকিমা খানিক বুঝিয়ে হাল ছেড়ে দিলেন। এ মেয়েকে বুঝিয়ে লাভ নেই। ঠিক যখন করেছে, আসবেই!

অহলদারা ভিউ পয়েন্ট থেকে তিস্তা।

তা এমন ভিউ এসে থাকার মতোই। চারপাশে পাহাড়। পাশেই চা বাগান। বহূ দূরে আঁকাবাঁকা তিস্তা। যা প্রায়শই হারিয়ে যাচ্ছে মেঘে। অমৃতাকে নিয়ে তিন্নি পা চালাল ডানপাশের ছোট টিলার দিকে। এখান থেকে যাকে দেখতে খানিকটা শুয়ে থাকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো দেখাচ্ছে। মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেল ওরাও। মিলি আর রৌনককে নিয়ে শুভেন্দুও পা চালাল। বৌ-ছেলেকে নিয়ে এই প্রথম আসা, মোবাইল ক্যামেরার তাই বিশ্রাম নেই। পকেটে সে জন্যই পাওয়ার ব্যাঙ্ক। ছোট্ট সূর্যাভকে নিয়ে শর্মিষ্ঠা বসে রইল বেঞ্চে। কোলে নিয়ে ঢালু পথে যাওয়া ঠিক হবে না বলেই।

কয়েকশো বছরের পুরনো মনাস্ট্রি দেখে পরের গন্তব্য রবীন্দ্র স্মৃতি-বিজড়িত মংপু। সংস্কার চলছে, তবু তার মধ্যেই রবীন্দ্র-ভাবনা পরিস্ফুট। মন ভরে গেল। খারাপও লাগল, আরও একটু যত্ন কি নেওয়া যেত না!

রিয়াং নদী পেরিয়ে ঘালেটর ফেরার সময় জানলাম, শীতকালে রাস্তার দু’পাশে উপচে পড়ে কমলালেবু। মধ্য অগস্টে লেবু নেই, সঙ্গী হল কল্পনা।

মংপু যাওয়ার পথে যোগীঘাট ব্রিজ।

পরের দিন চলে গেলাম ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বাগোরা, চিমনি হয়ে ডাউহিল। যা আবার হালফিল নাম করেছে ‘হন্টেড প্লেস’ হিসেবে। মেঘ জড়ানো পথে কাউকে একাকী দেখলেই তাই গাড়িতে সঙ্গী গুঞ্জন, এ কে রে বাবা! ভূত নয়, তবে রাস্তার পাশে দেখা মিলল হরিণের। গাড়ির হর্ন পেয়ে যা হারিয়ে গেল বনপথে। ডিয়ার পার্কও ঘুরে নিলাম ডাউহিলে। তার পর ফের সামনের পাহাড়ে অজস্র জোনাকি জ্বলতে দেখে। পরিষ্কার আকাশ বলেই স্পষ্ট অনেক দূর। মনে হল, আকাশের তারারা বুঝি নেমে এসেছে চোখের সামনে। আহা, এ ভাবে তাকিয়েই যদি কাটিয়ে দেওয়া যেত দিন কয়েক!

বসা আর হল না। হঠাত্ বিক্রম রাইয়ের ডাক। চলুন গাড়িতে মিনিট পাঁচেক। রাতের শিলিগুড়ি দেখে আসবেন। রাত সাড়ে ৮টার সময় পাহাড়ি পথে ছুটল তাঁর গাড়ি। থেমেও গেল আচমকা। গাড়িতে বসেই তাকালাম বাঁ দিকে। এবং স্তব্ধ হয়ে গেলাম। নীচে অনেকটা জায়গা আলোর ঝলমলানি। ক্যামেরার সাধ্য নেই তা বন্দি করার। মন-ক্যামেরায় তা ভরে নিলাম।

হোমস্টে থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়।

ফেরার দিন ভোরে উঠতেই বিস্ময়। এ কী! পশ্চিম দিগন্তে বরফের পাহাড়ে পড়েছে রক্তিম আভা। কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়। এত ভাল দেখা যায় এখান থেকে, বাকরুদ্ধ আমরা। তান্নি চেঁচিয়ে উঠল, কি আগেই বলেছিলাম না, কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাকে কখনও ফেরায় না!

আমি ভাবলাম, ঘুমন্ত বুদ্ধ অদেখা থাকলেও ক্ষতি হত না। ঘালেটর যে আরও এক বার আসার নিমন্ত্রণ অনেক আগেই পাঠিয়ে রেখেছে!

যাত্রাপথ: নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ঘণ্টা আড়াই লাগবে। সেবক হয়ে কালিঝোরার পর বাঁ দিক দিয়ে উঠে বগোরার দিকে এসে মানা মোড় থেকে ডান দিকে কয়েক কিমি।

ভাড়া: গেস্ট হাউস থেকেই গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেটাই সুবিধার। ভাড়া মোটামুটি আড়াই হাজার। মরসুম অনুসারে বাড়তেও পারে।

রাত্রিবাস: বিশেষ হোমস্টে।

যোগাযোগ: বিক্রম রাই ৯৯৩৩৫৪৫৪৩৯

থাকাখাওয়া খরচ: জনপ্রতি দৈনিক ১০০০ থেকে ১৫০০। মরসুম অনুসারে বাড়ে-কমে।

Travel Tourism North Bengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy