Advertisement
E-Paper

রামধনু আর মেঘের টানে এই শ্রাবণে যোগপ্রপপাত

ভয়ঙ্কর, অবাধ্য এই ষোড়শী সুন্দরীর নাম, শরাবতী। অঝোর শ্রাবণের ধারা আর সোহাগী রোদ্দুরের পেলব স্পর্শে শরাবতীর যৌবনে এসেছে পূর্ণতা।ভয়ঙ্কর, অবাধ্য এই ষোড়শী সুন্দরীর নাম, শরাবতী। অঝোর শ্রাবণের ধারা আর সোহাগী রোদ্দুরের পেলব স্পর্শে শরাবতীর যৌবনে এসেছে পূর্ণতা।

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৭ ১৭:৫০
বাতাসে বৃষ্টিভেজা সোঁদা গন্ধ। দূরে, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার ঢেউ।

বাতাসে বৃষ্টিভেজা সোঁদা গন্ধ। দূরে, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার ঢেউ।

দক্ষিণে এখন দারুণ শ্রাবণের আভাস। সারাটা দিন মেঘলা আকাশ। না, তখনও বৃষ্টি আসেনি। কী আসে যায়? আমার মন বৃষ্টিভেজা। রাত ১০টা। তেমন কোনও রাত নয়। ট্রেনে চেপে বসলাম। ঝাঁ চকচকে সিলিকন সিটি বেঙ্গালুরু ছাড়িয়ে মুহূর্তে অনেক দূরে। হঠাৎ না বলে কয়ে বৃষ্টি এলো। চৈত্রে এমন শ্রাবণ? সেই অঝোর ধারায় ভেজে আমার মন, জানলা। এ বৃষ্টির চলমান রাত-ছবিটা অসাধারণ। ভিজছে ট্রেন, হাইওয়ে, গাছপালা, স্টেশন, টার্মিনাস, বসতি আর চলমান প্রকৃতি। বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাত। অবশেষে চোখের পাতায় ঘুমের আবেশ। নিকশ কালো অন্ধকারে কাকভেজা ট্রেনটা দারুণ গতিতে এগিয়ে চলেছে। ঘুমের ঘোর ভাঙতেই দূরে আলোর আলপিন দেখলাম। অন্ধকার টানেল ফুঁড়ে অপরূপ আলোর ঠিকানা। সবুজের সমাহার, লালমাটির গ্রাম, পাষাণী লালচে পাহাড়। সাতসকালে দুরন্ত নীল আকাশটায় যেন কালচে দুশমনি মেঘের দুর্বৃত্তরা ফালাফালা করে দিয়েছে। সামনে আঁকাবাঁকা রেলপথ। তাকে ঘিরে ধরছে, পাহাড়। প্রতিটি বাঁকেই মুগ্ধতার ছোঁয়া। মেঘের দল পাহাড় ছুঁতে চাইছে। সিগন্যালের খামখেয়ালিপনায় মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়ছে। সেই সুযোগে পাহাড়পুরের অনবদ্য প্রাকৃতিক শোভা আরও বেশি করে কাছে পাওয়া। কৌণিক দূরত্বে ছোট্ট অজ গ্রামের ছবি। সরল গ্রাম্য চিত্রের কোলাজ ফুটে ওঠে। বৃষ্টির বাসভূম সিমোগা পাহাড়ে হঠাৎ ঝমঝমিয়ে নেমে এল শ্রাবণের ধারা। তারপর সিগন্যাল গ্রিন। চলতে শুরু করল পাহাড়ি বিছে, সিমোগা এক্সপ্রেস। আসবুজ পাটভাঙা প্রকৃতির মাঝে এক সুন্দর স্টেশনে ট্রেন এসে দাঁড়ালো। প্রান্তিক এই স্টেশনের নাম সিমোগা।

আরও পড়ুন, দার্জিলিং-কালিম্পং-লাভা-রিশপ-লোলেগাঁও

বাতাসে বৃষ্টিভেজা সোঁদা গন্ধ। দূরে, পশ্চিমঘাট পর্বতমালার ঢেউ। ব্রোঞ্চরঙা পাহাড়ে সবুজের আত্মীয়তা, লালমাটির ব্লাডলাইন সিমোগার চারপাশে। স্টেশনের ক্যাফেটেরিয়া থেকে গরম কফি খেয়ে বেশ চাঙ্গা। আমার মোবাইলে নাগেশজির ফোন। এই সুন্দর সিমোগায় উনিই আমার গাইড, ড্রাইভার। দুধসাদা স্করপিও-তে চেপে বসলাম। আঁকাবাঁকা পথ। পাহাড়ে বৃক্ষবৈচিত্র্য দেখার মতো। এ পাহাড় থেকে ও পাহাড় পাক খেতে খেতে চলেছি। সঙ্গে ঝিঁঝিঁর সিম্ফনি। পাহাড়ের গায়ে সুদীর্ঘ রণপা পরা নানান বৃক্ষের দল আকাশ ঢেকেছে। মাঝে মাঝেই নাম না জানা রঙিন ফুলের হাসিমুখের দেখা মেলে। আবার বৃষ্টি এল ধেয়ে। আবার উধাও। বন, পাহাড় আর বৃষ্টি, এই ত্রিবেণী সঙ্গমকে সঙ্গী করে চলেছি যোগপ্রপাতের দেশে। কর্নাটকের এক নতুন ঠিকানা। এই জঙ্গলের ঘনত্ব এতটাই বেশি যে মাঝে মাঝে যেন গা শিউরে ওঠে। কোনও বন্যজন্তু আচমকা সামনে এসে পথ না আগলে দাঁড়ায়। না, তেমন কোনও ঘটনার সাক্ষী হতে হয়নি। সারা দিনের যাত্রার ধকলে একটু ঝিমুনি ভাব লেগেছে। তন্দ্রা ভাঙতেই দেখি জঙ্গল উধাও। লালমাটির প্রকৃতির মাঝে এসে পড়লাম। সুন্দর পরিপাটি সাজানো গ্রাম। বৃষ্টিভেজা সবুজের মাঝে এক টুকরো গ্রাম। নাগেশজি আর আমি ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। দোসা আর মেদুবড়া, সঙ্গে সাম্বার, রসম। শেষপাতে কফি। যার স্বাদ অতুলনীয়। মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলতে খেলতে আবার পথ চলা। আবার পাহাড় দেখতে পেলাম।

পশ্চিমঘাট পাহাড়ের হাতছানি। এ বার এক অদ্ভুত গুড়গুড় শব্দ কানে এল। সামনে আদিগন্ত আকাশের হাতছানি। সেই শব্দের উৎসের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। নাগেশজি গাড়ি থামালেন একটা ব্রিজের সামনে। বললেন, ‘‘সাব, ইধার আইয়ে, দেখিয়ে নেচার কা নজারা।’’ যা দেখলাম তা ভয়ঙ্কর সুন্দর। পাহাড় ফুঁড়ে গ্যালন গ্যালন জল বিপুল উচ্ছ্বাসে ধেয়ে আসছে। বৃষ্টির দৌলতে বিপুল জলধারা নিয়ে অনাম্নী নদী আজ পাগলপারা। সেই স্রোতের দাপটে কংক্রিটের পোক্ত সেতু এই বুঝি খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে! উফ, কি তার উচ্ছ্বাস! নাগেশজি আমার ইশারায় আস্বস্ত করলেন, ভয়ের কোনও কারণ নেই।

জঙ্গলের পথে।

ভয়ঙ্কর, অবাধ্য এই ষোড়শী সুন্দরীর নাম, শরাবতী। অঝোর শ্রাবণের ধারা আর সোহাগী রোদ্দুরের পেলব স্পর্শে শরাবতীর যৌবনে এসেছে পূর্ণতা। নদীর সঙ্গে আলাপচারিতা সারব তার কি উপায় আছে? অভিমানি আকাশে মেঘপালকের কুঁচবরণ কন্যাদের ব্রিগেড। ষোড়শী শরাবতী আবার স্নান সারবে। বৃষ্টি তাকে স্নান করাবে। টিয়ারঙা আদিম অরণ্য, শরাবতি এবং আমি— সব্বাই ভিজে জবজবে। আলতো হিমেল হাওয়ায় কেমন একটা শীত শীত ভাব। কিন্তু, কিছু দূরে গিয়েই বেগবান নদীটা হঠাৎ যেন উধাও হয়ে গিয়েছে! কোথায় গেল নদী? তবে কি এ নদী অন্তঃসলিলা? ঠিক যেমন, নেপালের রেতি নদী। যে নদী আজও অন্তঃপুরে বয়ে চলেছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পাশের জঙ্গলা পথটা বেছে নিলাম। আঁকাবাঁকা জঙ্গল পথে নাগেশজির পিছু নিলাম। পায়ে চলা পথের শেষে সুন্দর পি ডব্লউ ডি বাংলোর সামনে দাঁড়ালাম। এটাই আমার রাত-ঠিকানা। লাগেজ রেখে এসে দেখি, নাগেশজি ঠায় দাঁড়িয়ে। বারান্দায় আসতেই চক্ষু চড়কগাছ। আরে! এই তো সেই নদী। আস্ত নদীটা ঝাঁপিয়ে পড়েছে প্রায় ২০০ ফুট গর্জে। প্রকৃতির গর্ভে এক নদীর ঝর্না হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। অনামিকা অরণ্যের মাঝে বহতা দুধসাদা ষোড়শী শরাবতির পদস্খলন। ১২০০ ফুট নীচের রুক্ষ পাথুরে জমিনটা চুপিসারে যেন সেই ষোড়শীর অপেক্ষাতেই ছিল। ঘর পালানো নদী তাই লজ্জায় মুখ ঢেকেছে, গভীর গর্জে। শরাবতির এই নির্ঝর যৌবনের আর এক নাম, যোগপ্রপাত।

আরও পড়ুন: দু’হাত বাড়িয়ে অপেক্ষায় মায়াবী সিকিম

একনদী, চারধারা। রাজা, রানি, রকেট, রোরিয়ার। রাজার সঙ্গে রানির সখ্য। স্বাভাবিক ভাবেই রাজা আর রানির অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। এক বিশাল পাথরে ধাক্কা খেয়ে আলাদা হলেও, কিছুটা নীচে গিয়ে তাদের দুই ধারা একত্র হয়েছে। ও দিকে ঠিক পাশেই রকেটের তীব্রতায় রোরিয়ারের অহঙ্কার। এ যেন অম্লান উষ্ণতার বহমান ছবি। ঝর্নার আর মেঘের গায়ে বৃষ্টি মাখছে অল্পচেনা সিমোগার এক টুকরো স্বর্গ যোগপ্রপাত। বাংলোর বারান্দায় বসে মেঘ, পাহাড় আর বৃষ্টির সঙ্গে চিরসবুজ সিমোগা রুপসুধা দেখতে দেখতে লাঞ্চ সারলাম। দিগ্বিদিগ জ্ঞানশূন্য বাতাসের মতিগতি বদল। উদাসী হাওয়া বয়ে আনে যোগপ্রপাতের জলগুঁড়ো। ভিজে যায় চোখের পাতা, মুখ। ও দিকে আকাশের পশ্চিমপানে তাকিয়ে দেখি কালচে নীল জামদানি রং। মেঘের ফাঁকে উঁকি দিয়ে সূর্য প্রকট হল। আগুন রঙের বাহার ছুঁয়ে যায় চারধারা যোগপ্রপাতের ঝরে পড়া ঝর্নার জলে। সিমোগা এখন কৃষ্ণনীল। কালচে মেঘের মাঝে, চন্দ্রিল আবছায়ায় মাখছে মায়াবী প্রকৃতি। শ্রাবণী শিরশিরে হাওয়ায় জ্যোৎস্না লুটোপুটি খায় শরাবতী আর যোগের শরীরে। এই নিশিবাসরে আমি একা, বাংলোর ছাতে। কেয়ারটেকার ডিনার নিয়ে এলেন। মাঝরাতের একপশলা বৃষ্টি ঘুম ভাঙিয়ে দিল।

প্রকৃতির গর্ভে এক নদীর ঝর্না হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া।

পর দিন ভোরে গরম কফি খেয়ে মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনখারাপ হয়ে গেল। সঙ্গে হালকা বৃষ্টি। সেই বারিধারাকে সঙ্গী করে চলে এলাম ভিউ পয়েন্টে। টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকে দেখি, বিশাল এলাকা জুড়ে এক মুক্তমঞ্চ গড়া। এখান থেকে প্রচুর মানুষ একসঙ্গে বসে রাজা, রানি, রকেট, রোরিয়ারের অপরূপ শোভা একসঙ্গে দেখতে পারেন। দূরে আকাশের সীমান্তে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা আর সিমোগা পাহাড়ের ঘেরাটোপ। অসহ্য সবুজ আর রুক্ষ পাথরের বুক চিরে নদীর চলন, তারপর শূন্যে ঝাঁপ। অবিরাম বাতাস বয়ে নিয়ে আসছে জলগুঁড়ো। গুরুগম্ভীর ব্যারিটোনে। এমন সময় মায়াবী হল যোগপ্রকৃতি। এ যে রামধনুর ছটা। স্বপ্নের রং।

ভিউ পয়েন্টের পাশ দিয়ে নেমে গিয়েছে সিঁড়ি। প্রতিটি সিঁড়ির ধাপে সে পথ ভেজা। রামধনু মাখা জলগুঁড়ো এসে স্পর্শ করছে। পাহাড় ধোওয়া শীতল জলের রাজা, রানি, রকেট, রোরিয়ার-এর চারধারা এক যোগপ্রপাত আজ বাঁধনহারা। আকাশে মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলা। সেই খেলা চলে অবিরাম। চারধারার জলধারার তীব্র ফলার মতো আক্রমণ আর গুরুগম্ভীর আওয়াজে বেশি ক্ষণ থাকা সম্ভব হল না। প্রায় ১২০০ ফুট নীচে সূর্যের আলো পৌঁছয় না। তাই যোগপ্রপাতের জলধারা হাড় হিম করা। সেই অন্তহীন, বহতা জলপ্রপাত ভরা শ্রাবণে পাগলপারা ধারায় ঝরে পড়ে। কর্নাটকের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কোলে এক অল্পচেনা, অসাধারণ বিউটি স্পট। আমার স্মৃতিপটে আজও সজীব হয়ে আছে।

প্রয়োজনীয় তথ্য

কী ভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে বিমানে বা ট্রেনে বেঙ্গালুরু। সিমোগ এক্সপ্রেসে সিমোগ স্টেশন। সেখান থেকে গাড়িতে যোগপ্রপাত।

কোথায় থাকবেন: কর্নাটক ট্যুরিজমের হোটেল মৌর্য গেরুসোপ্পা (০৮১৮২-৬২৪৪৭৩২) ভাড়া ১,৯৫০-২,৫০০ টাকা। বেসরকারি হোটেলের মধ্যে শরাবতি অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প (www.junglelodges.com), ভাড়া ২,৫০০-৩,৫০০ টাকা। নবরত্ন হোটেল (০৮১৮২-২৭৫২৫৫) ভাড়া ৫৫০-১,৯৫০ টাকা। হোটেল সূর্য কমফর্ট (২২১৮১৭) ভাড়া ৭৫০-১,৩৫০ টাকা। রয়েছে পিডব্লিউডি-র বাংলো।

ছবি: লেখক

Travel Destinations Holiday Destinations Tourist Places Tourism Tourist Attractions
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy