Advertisement
E-Paper

হাতে সময় নিয়ে দেখুন, মুগ্ধ করবে খাজুরাহো

আরও চমক লাগে জগদম্বা-সহ খাজুরাহোর প্রায় প্রতিটি মন্দিরগাত্রে কামশাস্ত্রের বিস্তারিত ভাস্কর্য রূপায়ণ দেখে।হ্যাঁ সেলুকাস। আজও এ কথা সে দিনের মতোই সমান সত্য। বড় বিচিত্র এ দেশ। এই দেশেতেই অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড তৈরি হয়েছে। আবার এই দেশেতেই পুরাকালে গড়ে উঠেছিল খাজুরাহো। ভারতদর্শন সম্পূর্ণ করতে গেলে হয়তো একটা গোটা জীবন লেগে যাবে আর সেই তালিকায় যদি খাজুরাহো না থাকে তা হলে আসমুদ্র হিমাচল চষে ফেললেও ভারতবর্ষকে পুরোটা চেনা হবে না।

দেবারতি গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৭ ১৯:৩৪
খাজুরাহোর মনোমুগ্ধকর ভাস্কর্য

খাজুরাহোর মনোমুগ্ধকর ভাস্কর্য

হ্যাঁ সেলুকাস। আজও এ কথা সে দিনের মতোই সমান সত্য। বড় বিচিত্র এ দেশ। এই দেশেতেই অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড তৈরি হয়েছে। আবার এই দেশেতেই পুরাকালে গড়ে উঠেছিল খাজুরাহো। ভারতদর্শন সম্পূর্ণ করতে গেলে হয়তো একটা গোটা জীবন লেগে যাবে আর সেই তালিকায় যদি খাজুরাহো না থাকে তা হলে আসমুদ্র হিমাচল চষে ফেললেও ভারতবর্ষকে পুরোটা চেনা হবে না। কারণ খাজুরাহো এই সুপ্রাচীন জম্বুদ্বীপের সেই ইতিহাসের চিহ্ন, যাকে আজকের অর্বাচীন ভারত নাকচ করতে উঠেপড়ে লেগেছে।

ট্রেনে খাজুরাহো যেতে গেলে হাওড়া থেকে জবলপুরগামী যে কোনও ট্রেনে মধ্যপ্রদেশের সাতনা স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে গাড়ি বুক করে যাওয়া যায়, ঘণ্টা তিনেকের রাস্তা। আর আকাশপথে গেলে কলকাতা থেকে সরাসরি কোনও উড়ান নেই, বেশির ভাগই ভায়া দিল্লি। দিল্লিতে হল্ট নিলে প্রায় ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা লেগে যাবে। ভোর ৭টায় প্রথম ফ্লাইট। এটা ধরতে পারলে দুপুর ২/৩টে নাগাদ খাজুরাহো মন্দির সংলগ্ন হোটেলে পৌঁছে যাবেন। মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের গেস্টহাউসেও থাকতে পারেন বা কোনও বেসরকারি হোটেলে। এয়ারপোর্টে লাঞ্চ সেরে হোটেলে ফিরে ঘণ্টা দু’-তিনের বিশ্রাম নিয়ে সন্ধেবেলাটা চমৎকার কাজে লাগানো যাবে।

মন্দির গাত্রের অলঙ্করণ

আর ট্রেনে এলে একটা অতিরিক্ত রাত ট্রেনে কাটাতে হবে। আমরা গিয়েছিলাম শিপ্রা এক্সপ্রেসে। সন্ধে পৌনে ৬টায় হাওড়া থেকে ছাড়ে আর কপাল ভাল থাকলে কোনও লেট না করে পরদিন বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ সাতনায় পৌঁছে দেবে। আগে থেকে হোটেলে বলে রাখলে গাড়ি পাঠিয়ে দেবে। ওই বেলা আড়াইটে নাগাদ হোটেলে পৌঁছে স্নান খাওয়া সারতে পারেন। মন্দির শহরে পৌঁছে প্রথম সন্ধ্যেয় একটু আশপাশ ঘুরে দেখতে পারেন। রুপোর অ্যান্টিক গয়নার দোকান রয়েছে অনেকগুলো। দামও দিল্লি-কলকাতার তুলনায় কম। রয়েছে বেশ কিছু কিউরিও শপ। সেখানে মধ্যপ্রদেশের নিজভূমের শিল্প-ভাস্কর্যের ভাণ্ডার। প্রথম সন্ধেয় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে রাখতে পারেন। তা হল মন্দির প্রাঙ্গনে ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ প্রদর্শনী। মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের উদ্যোগে নির্মিত এই ৫০ মিনিটের অডিও ভিস্যুয়াল প্রদর্শনীতে খাজুরাহো মন্দির তৈরির সমকাল প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে। সেখানে উঠে আসে কী ভাবে বুন্দেলখণ্ডের রাজপুত চান্দেলা রাজাদের আমলে ৮৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গড়ে উঠেছিল এই বিপুল ভাস্কর্য।

সূক্ষ কারুকাজ নজর কাড়ে

১৯৮৬ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমা দেওয়ার পর থেকেই বিদেশি ট্যুরিস্টের বাড়বাড়ন্ত। গরম কালের তিন-চার মাস বাদ দিলে প্রায় সারা বছরই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। আর বিদেশিরা এত আসেন যে আমাদের দলে এক ছোট চুলের সরু গ্রীবা বান্ধবীকে লোকাল গাইডরা একনজর দেখে মেমসাহেব ঠাউরে ছিলেন। তারপর যেই বাংলা টোনে হিন্দি বলা শুরু হয়েছে তখন টের পেলেন এ তো মেমসাহেব নয়, বাঙালি নিশ্চয়। সে যা হোক। গাইডদের সঙ্গে দরদস্তুর করে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, পর দিন ভোর থেকে মন্দির অভিযান শুরু করব। তুলনায় সস্তা বেসরকারি গাইড নিয়ে আমরা পূর্ব আর দক্ষিণের মন্দিরগুলো আগে দেখে নেব। তারপর মূল মন্দির প্রাঙ্গনে ঢুকব দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে। মূল মন্দির প্রাঙ্গন বলতে যেখানে ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ দেখানো হয় অর্থাৎ ওয়েস্টার্ন গ্রুপ অফ টেম্পল। এখানে সরকারি গাইড ছাড়া অনুমতি দেয় না।

পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকের মন্দিরগুলির মধ্যে হিন্দু দেবদেবী, অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু বা শিবের সঙ্গে সঙ্গে জৈন মন্দির ও ৬৪ যোগিনী মন্দিরও রয়েছে। ৬৪ যোগিনী মন্দির খাজুরাহোর সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির এবং অন্যান্য সব মন্দিরের চেয়ে এর দেওয়াল অলঙ্করণ আলাদা।

খাজুরাহো মন্দির

মধ্যযুগে হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি ভক্তিবাদী আন্দোলনও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল তাই সব ধর্মের সম্মান রক্ষার্থে চান্দেলা রাজারা জৈন তীর্থঙ্করদের মন্দিরও বানিয়েছিলেন। দক্ষিণ-পূর্বে জৈন মন্দিরগুলির মধ্যে পার্শ্বনাথ, আদিনাথ ও শান্তিনাথের মন্দির পাওয়া যায়। জৈন মন্দির প্রাঙ্গনে রয়েছে মধ্যপ্রদেশের আর এক বৈশিষ্ট্য, বাউলি। পাথরের চওড়া প্যাঁচালো সিঁড়ি দিয়ে বেশ খানিক নেমে জলাধার। পশ্চিমদিকের মন্দিরগুলিই অবশ্য সবচেয়ে বিখ্যাত। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দির বিশ্বনাথ বা মহাদেবের মন্দির। তার পাশেই রয়েছে জগদম্বার মন্দির। এ ছাড়াও লক্ষ্মী, বরাহ অবতার ও বিষ্ণুমন্দির রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এর মধ্যে বরাহ অবতারের গায়ে যে সূক্ষ্ম কারুকাজ তা দেখে সত্যিই মুগ্ধতা আর বিস্ময়ে মাথার মধ্যে ঘোর লাগে।

আরও চমক লাগে জগদম্বা-সহ খাজুরাহোর প্রায় প্রতিটি মন্দিরগাত্রে কামশাস্ত্রের বিস্তারিত ভাস্কর্য রূপায়ণ দেখে। গাইডদের বক্তব্য অনুযায়ী, মধ্যযুগ পর্যন্ত হিন্দু শাস্ত্রে মনে করা হত যে কোনও স্থাপত্যের দেওয়ালে বা প্রবেশদ্বারে মৈথুন মূর্তি থাকলে তা অত্যন্ত শুভ ও মঙ্গলদায়ী। কথাটা বিশ্বাস না হওয়ায় আমরা খানিক ইতিহাস ঘেঁটে দেখলাম বিরাট সংহিতায় এমন কথা লিখেছে বটে। তাই মধ্য, পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের বহু হিন্দু, জৈন বা বৌদ্ধমন্দির গাত্রেই মিথুন মূর্তির কারুকাজ দেখা যায়। তবে তা সাধারণত দেওয়ালের নীচের দিকে। তবে কোনারক আর খাজুরাহোতে তা একদম চোখের সামনে, যাকে বলে আই লেভেলে এবং প্রায় সব মন্দিরের সারা দেওয়াল জুড়ে। যেন এক পূর্ণ জীবনের উৎসব পালন। এবং আরও নির্দিষ্ট করে বললে সেই প্রাচীন ও মধ্যযুগের নারীর সৌন্দর্য ও স্বাধীন যৌনজীবন যাপনের ইতিকথা। কোথাও দেবাঙ্গনা শৃঙ্গার করছে, কোথাও কোনও নগরবধূ স্নানের পর তার দীর্ঘ ঘন চুল শুকোচ্ছে বা কোথাও কোনও রাজবালা অপেক্ষায় বসে আছে যুদ্ধ থেকে কখন তার প্রেমিক ফিরবে সেই আশায়। নারী–পুরুষের বাধাহীন যৌনমিলন ও তার মাধ্যমেই জাগতিক অবস্থা থেকে মোক্ষ লাভ।

প্রতিটি কারুকাজ অনবদ্য

খুঁটিয়ে প্রতিটা মন্দির দেখতে হলে খাজুরাহোতে দু’ দিন কাটালে বেশ হয়। আর তাড়া থাকলে এক দিনেও সেরে ফেলা যায়। সব মিলিয়ে তিন থেকে চার দিনে খাজুরাহো ঘুরে নেওয়া যায়। এখান থেকে পান্না বা বান্ধবগড় এর জঙ্গল ঘণ্টা চার-পাঁচের রাস্তা। আর খাজুরাহো থেকে সাতনা স্টেশন যাওয়ার পথেই পড়ে রানে জঙ্গল। মাত্র আধ ঘণ্টার রাস্তা। তবে এই জঙ্গল সাফারি আবার অন্য গল্প। সে আবার পরে কোনও দিন বলা যাবে।

ছবি:ইপ্সিতা সেনগুপ্ত

Tour Package Holiday Trip Khajuraho
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy