Advertisement
E-Paper

হাজার হাজার বছরেও ফিকে হয়নি শ্যামরাইয়ের প্রেম

ব্রজভূমের এ এক ভিন্নতর নগরকীর্তন। আজ দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব।ব্রজভূমের এ এক ভিন্নতর নগরকীর্তন। আজ দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব।

মন্দির থেকে নেমে এসে ছোট্ট নগরের অলিগলিতে ঘুরলে বোঝা যায়, কতটা রাধায় রাঙানো এ নগর।

মন্দির থেকে নেমে এসে ছোট্ট নগরের অলিগলিতে ঘুরলে বোঝা যায়, কতটা রাধায় রাঙানো এ নগর।

বিতান সিকদার

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৭ ০৬:৩০
Share
Save

বরসানার মেয়ে আর নন্দগ্রামের ছেলেটার প্রেম করতে আসার জায়গা এই নগর। তাই এখানে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের প্রকটলীলার দাবি বড় বেশিমাত্রায় প্রকট। ব্রজ প্রেমকে অনুভব করার জায়গা। রাস্তাঘাটে, অলিতে-গলিতে, মাঠে, শহরের বাইরে চাষের ক্ষেতে, দামোদর-শ্যামসুন্দর-বাঁকেবিহারি মন্দিরের বাইরে, নগরপথ ধরে হেঁটে যাওয়া বৈষ্ণবদের মুখে, পুরোহিতের সরস রসিকতায়, পাণ্ডেজির বাড়ির দাওয়ায়, গোস্বামীর বারান্দায়, মিষ্টান্নের দোকানে, রিকশাওয়ালার ভেঁপুতে, ফুলের বাজারে, যমুনার ধারে— সর্বত্র এ ছোট্ট নগর জুড়ে ‘রাধে রাধে’।

এ রাধায় মোড়া নগরজুড়ে বৈষ্ণব ‘রাধে রাধে’ বলে মাধুকরিতে বেরোয়। ও পাড়ার ঘোষাল এ পাড়ার গোস্বামীর দরজায় এসে কড়া নাড়ে। গোস্বামীর অন্দরমহল থেকে আওয়াজ আসে, “কে?” ঘোষাল পরিচয় দেয় দুই শব্দে, “রাধে রাধে!”

মহাকাব্য রাধার হদিশ দিয়ে যায়নি। ভাগবত তার দশম খণ্ডে পৌঁছে তবে ‘রা’ অব্দি উচ্চারণ করতে পেরেছিল। অবিশ্যি বিষ্ণুপুরাণ বা পদ্মপুরাণ বেশ ভাল ভাবেই রাধামনে বাঁধা পড়েছে। পরবর্তী ক্ষেত্রে বৈষ্ণব পদাবলি থেকে শুরু করে চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি সে প্রেম আরও পাকিয়ে তুলেছেন, সে বিষয়েও কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এ নগর অবাক করে সেইখানটাতে, যেখানে দেখি শুধু ভক্তিরসেই এ প্রেম পূর্ণতা খোঁজেনি। অন্তরীক্ষের সফেন পালঙ্ক ছেড়ে সেই কেলে ছোঁড়া আর গোরি ছোঁড়ি বাসর সাজিয়েছে এ মাটির নগরীতে। আর ব্রজবাসীরাও এই প্রেমকে ভক্তির মোড়কে মুড়ে বেদীতে তুলে রাখেনি, রীতিমতো কষে সমালোচনা করেছে।

“আরে মশাই, নন্দগ্রামের সেই কালো ছোঁড়া। আর বরসানার গোরি ছোঁড়ি। একেবারে কেলেঙ্কারি কাণ্ড! মেয়ের আবার ছোকরার চেয়ে বয়েস বেশি। ছ্যা ছ্যা! লজ্জাশরমের বালাই নেই। এখনও প্রতি রাতে নিধুবনে ভাব ভালবাসা করতে আসে,” হাসছেন গৌরাঙ্গ কুটিরের বাবাজি।

শাহজী মন্দিরের কাছেই নিধুবন। অনেক রকম গাছ, তাতে ফুল আর পাখিতে ভরে থাকা বাগান। প্রেম করবার আদর্শ জায়গাই বটে! কথিত আছে, এই বাগানেই হরিদাসজী গান গেয়ে বাঁকেবিহারির মূর্তি প্রকট করিয়েছিলেন। বাগানের মাঝে শৃঙ্গার মন্দির। “সেটা কী,” জানতে চাওয়ায় এক পাণ্ডা বললেন, “প্রতি রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে দুজন আসেন এখানে। তাই মন্দির বন্ধ করার সময় লাড্ডু, পান, জল— সব সাজিয়ে রাখতে হয়। খাট সাজান হয় ফুল দিয়ে। বোঝেনই তো!” মিটিমিটি হাসছে এক রাধাভক্ত। জিগ্যেস করলাম, “তারপর?” বললেন, “তারপর কী হয়, সে জানতে গেলে সকাল সাড়ে পাঁচটায় দ্বার উন্মোচনের সময় একবারটি আসতে হবে। দেখবেন নাড়ু খাওয়া, পান চিবান, খাটে ফুলমালা একেবারে লণ্ডভণ্ড।”

“সে ছোঁড়ার না এসে উপায় নেই। রাই রাগ করবে না! ওই সারারাত্তির ধরে এখানে প্রেম করেই তো ছোঁড়া ক্লান্ত। তবে না আটটায় ঘুম থেকে ওঠা হয়,” হাসছেন বাবাজি।

শুনে এসেছিলাম বৃন্দাবন প্রকটলীলার স্থান। কৃষ্ণ এখানে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভক্তকে দর্শন দিয়েছেন। সে গল্প বৈষ্ণবভিক্ষুদের মুখে মুখে ফেরেও। কিন্তু এ বাগানে এসে আবারও শুনলাম সেই বরসানার গোরির কথা। আর শুনে প্রকটলীলাতে রাইয়ের মাহাত্মও কিছু কম বোধ হল না।

বৈষ্ণব শ্যামানন্দ প্রভু একদিন এ বাগান ঝাড় দিতে গিয়ে এক নূপুর খুঁজে পান। খানিক পর এক ফর্সা যুবতী এসে জিগ্যেস করে, “ও ঠাকুর, কোনও নূপুর খুঁজে পেয়েছ গো?” শ্যামানন্দের কাছে নূপুর রয়েছে শুনে সে মেয়ে বলে, “ও আমার। আমায় দিয়ে দাও।”

কিন্তু এমনি কেন দেব? আগে আর একটা নূপুর দেখাও। আমি মিলিয়ে দেখি। তবে না দেওয়ার প্রশ্ন আসে।

মেয়েও নাছোড়বান্দা, “না। ও আমারই। বিশ্বাস কর।”

বেশ তো, তোমার হলে তোমাকেই দেব। আগে আর একটি চরণ দেখি। আর তা ছাড়া, এ জঙ্গলে করছিলে কী?

“আমি আমার সখীদের সঙ্গে বেড়াতে এসেছিলাম,” মেয়ের মুখে লাজুক হাসি।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে দামোদর মন্দিরের পূজারি হেসে লুটোচ্ছেন। বললেন, “কেন শ্যামানন্দ প্রভু আর একটা নূপুর দেখতে চেয়েছিলেন জানেন? কারণ, রাধারানি কখনও কাউকে তাঁর চরণ দর্শন করতে দিতেন না। খেয়াল করে দেখবেন রাধার ছবিতে পা ঢাকা থাকে সবসময়। শ্যামানন্দ ধরে ফেলেছিলেন। ভাবছেন ‘যদি তোমায় পাই, তবে আমায় পায় কে’। রাইকে দর্শন দিতে হয়েছিল। আর দিয়েছিলেন এক চমৎকার উপহার। শ্যামসুন্দর মন্দিরের ছোট্ট সেই গিরিধারীর মূর্তি। ওটি রাধারানির হৃদিমাঝারে তৈরি গো!”

যার স্তুতি করতে গিয়ে জয়দেবকে লিখতে হয়, “আমার বুকের ওপর তোমার পা দুখানি রাখো”, বৃন্দাবন তাঁর মহিমাকে অপরিমেয় বলে আখ্যা দিয়েছে। আর সে মহিমা শুধু এ নগরে আবদ্ধ নয়, সম্পূর্ণ ব্রজধাম জুড়ে ছড়িয়ে। সেটা বুঝতে পারলাম নগরের উপান্তে গোবর্ধন পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে।

বৃন্দাবন থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে গিরিরাজ গোবর্ধন, সেই যে সেই পাহাড় যা কানহাইয়া কড়ে আঙুলে তুলে নিয়েছিলেন। বাস রাস্তার পাশে। সে ‘বসে যাওয়া’ পাহাড় পরিক্রমা করে লাখ লাখ যাত্রী। ক্ষয়াটে চেহারার হিন্দুস্তানি দেহাতি থেকে শুরু করে বিত্তশালী মানুষ, গিরিরাজ সবাইকে আপন করে নিয়েছেন। সেই গোবর্ধন পরিক্রমাপথে রাধাকুণ্ড। তার পাশে কৃষ্ণদাস কবিরাজের সমাধিস্থল। ছোট সে মঠের বৈষ্ণব বলেন, “ওই ওপাশে শ্যামকুণ্ড। আর এ পাশে রাইয়ের চুড়িতে তৈরি কঙ্কন কুণ্ড। এই কঙ্কন কুণ্ডের চারিপাশ জুড়েই রাধাকুণ্ড।”

মঠের ছায়ায় বসে ঘাম মুছছিলাম। সাধক হেসে বলেন, “এইস্থানে বৃষরুপী অরিষ্টাসুরকে বধ করেন কৃষ্ণ। সে দিন ব্রজবাসীগণের ভারি আনন্দের দিন। কিন্তু রাই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শ্যামের রাস প্রার্থনা। কী হল? না স্বামিনী বললেন, ‘আমায় ছোঁবে না একদম’। সে কি? কেন? না, ‘তুমি গোবধ করেছ!’ বোঝো কাণ্ড! আরে সে গাভী নয়, অসুর ছিল। শ্যামের অবস্থা শোচনীয়, ‘যার জন্য চুরি করলাম...’ গোছের মুখ নিয়ে বসে আছেন।”

এইখানটা কথকঠাকুর বলছেন, “বৃত্রাসুরের ব্রাহ্মণ শরীর হওয়ায় তাহাকে বধের নিমিত্ত ইন্দ্রকে ব্রহ্মহত্যার পাপ স্পর্শ করিয়াছিল। তদ্রুপ ইহারও তো বৃষের রূপ ছিল।”

জনার্দন পড়েছেন ফ্যাসাদে। তবে কী করি তুমিই বল না হয়। সখী তা শুনে হেসে বলেছিলেন, “তীর্থস্নান কর।” ভাল কথা। তখন গিরিধারী চরণ দিয়ে আঘাত করে পাতাল থেকে ভগবতী গঙ্গা ও নিখিল তীর্থকে যে স্থানে আনয়ন করেন, তাই শ্যামকুণ্ড। এ বার শ্যামের বক্তব্য, “এস তবে, এ বার তুমিও স্নান করে নাও।” ফের “না।” আবার কী হল? না, “তোমার ছোঁয়ায় ও কুণ্ডও অপবিত্র হয়ে গেছে। আমি ওখানে স্নান করব না।”

গোস্বামী বলছেন, “তখন রাধারানি নিজের কঙ্কণ দিয়ে শ্যামকুণ্ডের পশ্চিমে যে কুণ্ড খনন করেন তাই কঙ্কণ কুণ্ড। পরে নিখিল তীর্থ রাইয়ের আহ্বানে তাতে এসে মিলিত হয়ে রাধাকুণ্ডের উৎপত্তি।

আর শুধু মিলিত হওয়া নয়, সে তীর্থসমুদয় করজোড়ে রাই মাহাত্ম বর্ণনা করেছেন এই বলে, “হে দেবী! সর্বশাস্ত্র অর্থবেত্তা ব্রহ্মা তথা মহাদেব এবং শ্রীলক্ষ্মীদেবীও আপনার মহিমা অবগত নহে, সর্বপুরুষার্থ শিরোমণি আপনার স্বেদবিন্দু অপনোদনকারী শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র অবগত আছেন। অহো! শ্রীকৃষ্ণ আপনার শ্রীচরণ কমলে মনোহর যাবকদ্বারা সুসজ্জিত করিয়া প্রতিদিন নূপুর পরিধান করাইয়া থাকেন এবং আপনার কৃপা কটাক্ষ প্রাপ্তিতে পরমানন্দিত হইয়া আপনাকে ধন্যতম মনে করিয়া থাকেন।”

রাই ঘেমে গেলে শ্যামকে উত্তরীয় দিয়ে ‘স্বেদ অপনোদন’ করতে হয়েছে, পায়ে নূপুর পরিয়ে দিতে হয়েছে আর রেগে গেলে সারা গায়ে ময়ূরের পালক লাগিয়ে নাচতে হয়েছে।

অবাক লাগে! কিন্তু বরসানার মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে দূরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের ছোট্ট পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে হাজার হাজার বছর পিছিয়ে যেতে ভালও লাগে।

গোধূলি বেলায় ব্রজবাসী ওই পাহাড়টা দেখিয়ে বলেন, “ওর পেছনেই ময়ূরকুটির। একদিন কী হয়েছে, শ্যামের আসতে দেরি হয়েছে। আর এ দিকে রাই অপেক্ষা করে করে গেছেন রেগে। আর যায় কোথা! কিছুতেই মানান যায় না। শেষে শ্যামকে সারা গায়ে ময়ুরের পালক লাগিয়ে রাইয়ের চারপাশে নেচে বেড়াতে হয়েছিল। তবে গিয়ে রাগ পড়ে। তাই তো জায়গার নাম ময়ূরকুটির।”

মন্দির থেকে নেমে এসে ছোট্ট নগরের অলিগলিতে ঘুরলে বোঝা যায়, কতটা রাধায় রাঙানো এ নগর। হবে না? রাইয়ের বাপের বাড়ি যে এইখানে। এ নগরের নিঃশ্বাসে রাই। দোলের দিন রং মাখাতে আসায় শ্যামকে রীতিমতো লাঠি হাতে তেড়ে গেছিলেন বৃষভানুনন্দিনী। সেই থেকেই ‘লাঠ-মার হোলির’ সূত্রপাত।

একে পরকীয়া, তায় ‘আমি যা বলব তোমায় তাই শুনতে হবে’ গোছের প্রেম। এ ছুঁড়িকে টপকে শ্যামকে ছোঁবে, কার সাধ্য!

অসাধারণ এক পটভূমিকায় সাধারণরূপী এ প্রেম শাস্ত্র, পুরাণের আঙিনা অনায়াসে পার হয়ে এসেছে। শুধু পার হয়ে এলেও না হয় বুঝতাম, এ যে দেখছি ব্যাসের রচনাকে মোটামুটি উল্টেপাল্টে একসা করে ছেড়েছে।

কৃষ্ণ মথুরা যাওয়ার সময় নাকি বলে গিয়েছিলেন, দু’-এক দিনের মধ্যেই ফিরবেন। মহাকাব্যে তা হয়ে ওঠেনি। তার পর রাইয়ের কী হল, তার হদিশও বিশেষ জানা যায় না। মহাকবির রচনায় এ প্রেম মিলনান্তক হয়ে ওঠেনি। আর এইখানটাতেই বাধ সেধেছেন ব্রজবাসী।

ওই যে, কৃষ্ণ বলে গিয়েছিলেন, ‘আমার শরীর যাচ্ছে, মন এখানেই পড়ে থাকবে’, এই দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই ব্রজ শ্যামকে বেঁধে ফেলেছে। ঋষিকবি যে প্রেমের তল খুঁজে পাননি, বৈষ্ণব সেখানে শ্যাম আর রাইয়ের ঘটা করে বিয়েও দিয়ে দিয়েছে। তাই না নিধুবনের বাইরে সিঁদুর বিক্রি হয়! রাধারানিকে সে সিঁদুর পরাতে হয়। কেন? না, শ্যামের মঙ্গলের জন্য।

যে প্রেমের শেষে বিরহরসেই মনকে সান্ত্বনা দিতে হয়, সে প্রেমকে বৃন্দাবন শেষ অবধি পৌঁছতেই দেয়নি। তাই তো প্রতি রাতে নিধুবনে বাসর সাজান হয়। তাই তো বৃন্দাবনে এখনও নূপুর বাজে!

বড় পরিচিত প্রেম, বড় সাধারণ বলে যখনই ভাবি, মন হেসে বলে, অত সোজা নয়! হাজার হাজার বছর পরও ও প্রেম টিকে আছে, একটুও ফিকে হয়নি।

আর ব্রজভূমি হেসে বলে, একটুও ফিকে...হবেও না!

Vrindavan Tour Guide Tourist spot বৃন্দাবন Travel

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}