Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মধ্যপ্রদেশ জঙ্গলের আদিমরূপ

যাঁরা দেখতে চান, তাঁদের জন্য আদর্শ সাতপুরা ব্যাঘ্রপ্রকল্পের চূর্ণারেঞ্জ। লিখছেন বাদশা মৈত্রযাঁরা দেখতে চান, তাঁদের জন্য আদর্শ সাত পুরাব্যাঘ্র প্রকল্পের চূর্ণারেঞ্জ। লিখছেন বাদশা মৈত্র

চুর্ণার গভীরে।

চুর্ণার গভীরে।

শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৯ ১৪:৫৪
Share: Save:

মেনরোড থেকে বাঁদিকে ঘুরে প্রায় ৫০ কিলোমিটার গেলে চূর্ণারেঞ্জ। এর অনেকটাই গভীর জঙ্গলের পথ, মাঝখানে বেশ কয়েকবার বিভ্রান্ত হয়ে গাড়ি থামিয়ে এদিক-ওদিক একটু বোঝার চেষ্টা করে আবার যাত্রা শুরু। ফোনের নেটওয়র্ক নেই, জিপিএস কাজ করছে না, একটু পরেই সন্ধে নামবে। রাস্তা ভীষণ খারাপ, মাঝে মাঝে নেই বললেই চলে। গাড়ির ড্রাইভার জঙ্গলে বিশেষ সড়গড় নন, তাই স্টিয়ারিং আমার হাতে। এই অবস্থায় বেশ কিছুক্ষণ চলার পরে এল কয়েকটা ঘর নিয়ে একটা ছোট গ্রাম। সেখান থেকে রাস্তা বুঝে নিয়ে, সন্ধে হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেই চূর্ণা ...সাতপুরা ব্যাঘ্র প্রকল্পের একটি রেঞ্জ।

ভারতের খুব কম ব্যাঘ্র প্রকল্পেই এতখানি ভিতরে এখনও বুকিং করে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। চারপাশে জঙ্গল, মাঝে এক অংশ ঘিরে বনবিভাগের বিশ্রামাগার। কাঁটা তারের বেড়া জায়গায় জায়গায় উধাও হয়ে গিয়েছে। সৌরবাতিই ভরসা। আর মোবাইলের সংযোগ একটা নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া অসম্ভব। জঙ্গলের আদিম রূপ যাঁদের রক্তে ঢেউ তোলে, তাঁদের জন্য চূর্ণা!

সবে ঢুকেছি, হঠাৎই পিছন থেকে দল বেঁধে কাদের যেন ছুটে আসার আওয়াজ। সেই সঙ্গেই জঙ্গলের লোকদের ‘হুটহুট’ চিৎকার— সব মিলিয়ে একটা রোমহর্ষক ব্যাপার! পিছন ফিরতেই দেখি, একদল হরিণ তির বেগে ছুটে আসছে অতিথিনিবাসের দিকে।আর তার পিছনেই এক পাল বুনো কুকুর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বেড়ার গা ঘেঁষে যেন ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকের একটা দৃশ্যের শুটিং হয়ে গেল।হরিণের পায়ের আওয়াজ দূরে মিলিয়ে যাওয়ার পরে জঙ্গলের এক কর্মী বললেন, ‘‘লাগতা হ্যায় এক বাচ্চে কোমার দিয়া।’’ শুনতে খারাপ লাগলেও প্রকৃতির ভারসাম্য দাঁড়িয়ে আছে এই খাদ্য-খাদক সম্পর্কের উপরেই।

মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে কাঠবিড়াল ও বাইসন

ঝুপ করে অন্ধকার নেমে গেল চারদিকে। সৌরবাতির টিমটিমে আলোয় সব কিছু দেখা না-দেখার মাঝখানে। ঘরের বাইরে বসে চা খাচ্ছি, হঠাৎই কেউ একজন এসে বলে গেল, পা-টা চেয়ারে তুলে বসতে, রান্নাঘরের কাছে সাপ দেখা গিয়েছে। পা তুলে বসবকী, ছুটলাম রান্নাঘরের দিকে।কালাচ সাপের ভয়ানক বিষ। বড় সাপ নয়, কিন্তু কামড়ালে আর দেখতে হবে না। একজন জঙ্গল কর্মী সাপটাকে পা দিয়ে ঠেলে বালতিতে ভরে, উঠোনের বেড়ার বাইরে দিয়ে আসার চেষ্টা করলেন। কর্মীদের বিশ্বাস, ওর ক্ষতি না করলে, ও কাউকে কিছু করবে না।তাই শান্তি পূর্ণ সহাবস্থানে সাপ বা মানুষ, কারও আপত্তি নেই।

পরের দিন খুব ভোরে বেরোনো, তাড়াতাড়ি শুতে হবে। হঠাৎই একেবারে ঘরের কাছে গভীর কীসের যেন একটা আওয়াজ।প্রথমে বিশ্বাস না হলেও একটু পরেই বুঝলাম, ওটা বাঘের ডাক! একদিক থেকে আর একদিকে সরে সরে যাচ্ছে। অতিথিনিবাসের গেট খোলা... টর্চ নিয়ে এক পা বেরোতেই পা যেন আর নড়ছে না, সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে। আরও লোকজন আলো নিয়ে চলে আসতেই গভীর আওয়াজটা ক্রমে মিলিয়ে গেল।

দিনের বেলা খুব গরম। বহুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরির পরে হঠাৎ করেই রাস্তার ধারে গাছের তলায় একটা বুনো কুকুরের পাল। জঙ্গলে এখন আমরা ছাড়া আর কেউ নেই বললেই চলে। খুব লোভ হচ্ছিল, জিপ থেকে নেমে চোখের দৃষ্টি বরাবর একটা শট নেওয়ার। তাই নীচের রাস্তায় যেন কিছু একটা পড়ে গিয়েছে— এই বাহানায় গাড়ি থেকে নেমে সোজা মাটিতে। আর ড্রাইভার উঠতে বলার আগেই শাটারে আঙুল পড়ছে বারবার। তবে ‘তাড়াতাড়ি করুন’ কানে আসতেই সোজা গাড়িতে। পরে বুঝেছি, কাজটা মোটেই ঠিক হয়নি। জঙ্গলে গিয়ে জঙ্গলের নিয়ম মেনে চলাটাই হল একমাত্র আরণ্যক নীতি।

পরের দিন অনেক ঘুরেটুরে তবে একটা ক্রেস্টে ডহক ইগল দেখতে পেলাম। রোদ থেকে বাঁচতে উঁচু একটা গাছের ডালে বসে সে যেন জিরিয়ে নিচ্ছে কিছুক্ষণ। কিছু বুনো শুয়োর দেখি এদিকে-ওদিকে ঘুরছে। একটা খরগোশ দু’পা উঁচু করে আর কান খাড়া করে শুনছিল আমরা কী বলছি ওদের নিয়ে। চোখাচোখি হতেই নিমেষে উধাও।

সাতপুরা জঙ্গলের আর একটা রেঞ্জ মাধাই। দেনওয়া নদীর পারে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের অতিথিনিবাসের ঠিক উল্টোদিকে মাধাই বনবিভাগের বিশ্রামাগার। যাকে বলে, প্রাথমিক সুবিধেটুকু একেবারে হাতের নাগালে। বিকেলের দিকে রোদের তাপ একটু কম।একটা বড় ঘাসজমিতে আপন মনে চরে বেড়াচ্ছে একদল গাউর অর্থাৎ ইন্ডিয়ান বাইসন। সামনেনদী... এই নদীর উলটোদিকে গতকাল একটা বড়সড় বাইসনকে তিনটে কমবয়সি বাঘ একজোট হয়ে শিকার করেছে, সঙ্গে তাদের মা-ও ছিল। রোদ কমলে যদি তারা বেরোয়, এই আশায় রোদ মাথায় নিয়ে সকলের বসে থাকা বহুক্ষণ। সেই বাইসনটার আধখাওয়া লাশ দেখা যাচ্ছে অনেক দূরে, কিন্তু ‘তাদের’ দেখা নেই। হঠাৎই আমাদের গাইডের চোখ নদীরও পারে একটা পাথুরে জমির উপরে। দেখি, হলুদ ডোরা কাটা একটা শরীর! ঠিক একটু আগেই যেন ঘুম ভেঙেছে, সেই ভঙ্গিতে পাথর টপকে ধীরে ধীরে একেবারে লাশটার কাছে। একটু পরে আরও একটা। সামনে মস্ত বাইসনটা পড়ে থাকতে দেখে, আনন্দে ওরা মাটিতে গড়াগড়ি খেল বেশ কিছুক্ষণ। বাকি একটা আর মায়ের আজ আর খবর নেই। অথচ আজকের মতো আমাদের সময় শেষ। অন্ধকার নামার আগেই তাই ফিরে এলাম সবাই।

সাতপুরা... সাতটা পাহাড় দিয়ে ঘেরা জঙ্গলে শাল, সেগুন, তেন্ডু, মহুয়া, বেল ইত্যাদি কত যে গাছ আর বাঁশের ঝোপে ভরা চারিধার। শোনা যায়, তাঁতিয়া টোপির খোঁজে এসে এই জঙ্গল আবিষ্কার করেন এক ইংরেজ সাহেব। চূর্ণার পুরনো ফরেস্ট রেস্টহাউস গুলো শুনলাম স্বাধীনতার অনেক আগে তৈরি। আসলে জঙ্গলের ভিতরে চূর্ণা নামে একটা গ্রাম ছিল আগে। এখন গোটা গ্রাম সুদ্ধসবারই পুনর্বাসন হয়েছে অন্যান্য জায়গায়। গ্রামের চিহ্ন বলতে রয়েছে শুধু পালে পালে গরু... সংখ্যায় নাকি প্রায় দশ হাজার ছিল। কিন্তু দিনে দিনে ক্রমশ কমে আসছে বাঘ কিংবা চিতা বাবাজিদের জন্য। গরুগুলো ফেলে যাওয়ার অন্যতম কারণ শুনলাম। পুনর্বাসনের পরে প্রায় পাণ্ডববর্জিত কোনও জায়গায় ছোট একটা ঘরে বাস করে, খাবার কিনে গরু-বাছুর পোষার বিলাসিতা করার মতো অবস্থা তাঁদের নেই তাই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়ে এতদিনের সুখদুঃখের সঙ্গীদের বাঘের মুখে ছেড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। বনবিভাগের বিশ্রামাগারে কাজ করা স্থানীয় মানুষদের বুকে কান পাতলে এখনও সেই কষ্টটের পাওয়া যায়।

মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার।

মাধাইয়ের জঙ্গলের বিশ্রামাগারের সামনে নদীতে এখন জল প্রায় নেই বললেই চলে। সরুনদীর উপরেই বানানো হয়েছে পায়ে হাঁটার নড়বড়ে ব্রিজ। ওর উপরেই আমাদের ফেরার গাড়ি। পিছন ফিরে তাকাতে হঠাৎ মনে হল, নদীতে যেন দু’কূল ছাপিয়ে জল এসেছে। একটু আগের সরু নদীটাই ভয়ানক রূপ নিয়েছে এখন। তাই চেনাই যায় না। প্রচণ্ড গরমে চোখে সর্ষেফুলের বদলে শুকিয়ে যাওয়া নদীতে দু’কূল ছাপানো জল দেখছি। পাশ থেকে এই জঙ্গলেরই কেউ একজন কাকে যেন হিন্দিতে বলল, ‘‘বর্ষায় এই নদীর ভয়ানক রূপ... নৌকো ছাড়া পারাপার অসম্ভব।’’ শুনে চমকে উঠলাম। এ-ও কি সম্ভব? বর্ষা আসার আগেই আমার চোখে বর্ষার নদীর রূপ। এক মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম আর গাড়িতে যেতে যেতে ভাবছিলাম, বিশাল এই পৃথিবীর কতটুকুই বা আমরা জানি?

আপাতত নাগপুর থেকে কলকাতার উড়ানের খবরটাই শুধু আমার জানা। তাই দেরি করার কোনও গল্পই নেই। দেনওয়ানদী, সাতপুরা, চূর্ণা, নধাই— নানা রকম মুখের সারি মনের ভিতরে জাবর কাটতে কাটতেই গাড়ি সোজা এয়ারপোর্টে।

মনে রাখবেন

এখানকার প্রকৃতি ভীষণ শুষ্ক। তাই প্রচুর জল খেতে হবে। খাওয়াদাওয়া খুব সাধারণ। রুটি, ডাল, সবজি পাওয়া যায়। মশার উপদ্রব খুব বেশি। তাই মসকিউটো রেপেল্যান্ট সঙ্গে রাখবেন। সানস্ক্রিন লোশনও নিতে ভুলবেন না। বাঘ দেখা মুখ্য উদ্দেশ্য হলে গরমের সময়ে যান। নভেম্বর-ডিসেম্বরে এই জায়গার ল্যান্ডস্কেপ ভারী সুন্দর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Travel Madhya Pradesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE