Advertisement
E-Paper

গড়চুমুক... বনের সুবাস নদীর স্নিগ্ধতায়

নিছক নদী পরিবহণকে আঙিনায় রেখেই বহুমাত্রিক সবুজে সাজিয়ে গুছিয়ে রোপণ করে গড়ে তোলা কৃত্রিম এই জঙ্গলে দিনমান পাখিদের কিচিরমিচির। সবুজের বুনোট মিলেমিশে গিয়েছে নদী সঙ্গমের ভাঁজে। তাই নিয়েই প্রিয় গড়চুমুক।

সবুজের বুনোট মিলেমিশে গিয়েছে নদী সঙ্গমের ভাঁজে। তাই নিয়েই প্রিয় গড়চুমুক।

সবুজের বুনোট মিলেমিশে গিয়েছে নদী সঙ্গমের ভাঁজে। তাই নিয়েই প্রিয় গড়চুমুক।

মধুছন্দা মিত্র ঘোষ

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৭ ২২:২৮
Share
Save

হেমন্তের চাপা গুঞ্জরনকে দোসর করে কোনও অঙ্গীকার না রেখেই বুনো ছায়াটুকুর পাশ দিয়ে স্বচ্ছন্দে বয়ে গিয়েছে আটপৌরে সে নদীজল। দামোদর ও ভাগীরথীর মিলমিশটা ঠিক এখানেই। অনর্গল সবুজ ছড়াচ্ছে গাছপালা, ঝোপঝাড়, গুল্মলতা। সে রং চারিয়ে যাচ্ছে আশপাশ। গড়চুমুক মৃগদাবের এ তল্লাটে এখন অঘ্রাণের হাওয়া তাতে উগরে দিচ্ছে বনের ললিত সুবাস ও নদীর স্নিগ্ধতা।

নিছক নদী পরিবহণকে আঙিনায় রেখেই বহুমাত্রিক সবুজে সাজিয়ে গুছিয়ে রোপণ করে গড়ে তোলা কৃত্রিম এই জঙ্গলে দিনমান পাখিদের কিচিরমিচির। সবুজের বুনোট মিলেমিশে গিয়েছে নদী সঙ্গমের ভাঁজে। তাই নিয়েই প্রিয় গড়চুমুক। যার বাহারি অরণ্যের পাতা থেকে পাতায় লেগে থাকা ফিসফাস। কবি মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতার দু’টি লাইন, হঠাত্ই মনে উদয় হল—

পৃথিবীর শান্ত সৌন্দর্যে টলমল করুক

মানুষের মুখরতাকে চাপা দিয়ে যাক বনমর্মর

হেমন্ত লেখা তিন দিনের অস্থায়ী আস্তানা, আমাদের গাদিয়ারা সরকারি পর্যটক আবাসের ‘রূপশালী’ ভবন। গাদিয়ারার সফরনামা পরে না হয় শোনানো যাবে। গাদিয়ারা থেকে গড়চুমুক মাত্র ২৩ কিলোমিটার। এক সকালে হোটেলে প্রাতরাশ শেষে গাদিয়ারা অটোস্ট্যান্ড থেকে একটা অটো পুরোটাই ভাড়া করে নিলাম। গড়চুমুক যাওয়া-আসা নিয়ে ৪০০ টাকায় রফা হল। এমনিতে গাদিয়ারা থেকে শ্যামপুর বাজার মোড় এসে আবার অন্য অটোতে শ্যামপুর মোড় থেকে গড়চুমুক নয়া মোড় পর্যন্ত দু’দফায় গড়চুমুক পৌঁছনো যায়। তাতে সাশ্রয়ও হয়। তবে দু’দফা অটো পাল্টানোর ঝক্কি এড়াতেই টানা অটো ভাড়া করে চললাম গন্তব্যে। দ্রষ্টব্যের মধ্যে মজুত রাখা আছে উলুঘাটা আটান্ন গেট ও গড়চুমুক মৃগদাব।

না ফুরনো গাঁ-গঞ্জ জনপদ চিরে পথ চলে গিয়েছে। কখনও ছায়া মাখা কখনও বা অঘ্রাণের মিঠে রোদ্দুর ছড়ানো ধান জমি। সড়কপথে প্রায়শই আধা লোহার ব্যারিকেড বসিয়ে পথ আগলানো। হয়তো যান চলাচলের গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য। শ্যামপুর মৌজা বেশ জনবহুল বিস্তৃত এলাকা। তিন রাস্তার শ্যামপুর মোড়ের বাম-হাতি পথটা গিয়েছে বাগনান। ডাইনে পথ কিছুটা এসেই আবার বাঁয়ে বাঁক খেয়ে এক্কেবারে সোজা চলে গিয়েছে ১৮.৫০ কিলোমিটার দূরে আটান্নগেট গড়চুমুক নয়া রাস্তা মোড়।

আটান্ন গেট মূলত একটি নদী বাঁধ। বাঁধের দুই ধারেই দুই প্রবেশতোরণ। ‘উলুঘাটা আটান্ন স্লুইস্ গেট’। মোট আটান্নটি স্লুইস গেট পর পর। নীচ দিয়ে অকাতরে বয়ে চলেছে দামোদর ও ভাগীরথীর মিলিত জলধারা। স্লুইস গেট গলে ঝরে পড়ছে বলে স্রোতের প্রাবল্য রয়েছে। সাঁকো পেরিয়ে মূল সড়কটি গেছে উলুবেড়িয়া। এই নদী বাঁধটির নাম উলুঘাটা আটান্ন গেট। সাঁকোর ধারে ঠেস দিয়ে নিজস্বী তোলার সঙ্গে মোবাইলে তুলে রাখি ঘাটে বাঁধা ডিঙি নৌকার সারির ছবি। নদীর পাড়ে মাটির পাত্র বোঝাই বেশ কিছু নৌকা, হয়তো জলপথে অন্য এলাকায় সওদায় যাবে। কিছু ডিঙি নৌকা মাঝনদীতে ভেসে জলে জাল বিছিয়ে রেখেছে। সদ্য তোলা সতেজ মাছ নিমেষেই বিক্রি হয়ে যাবে। আটান্ন গেট জলসেচ ব্যবস্থা এ অঞ্চলে প্রয়োজনীয় চাষআবাদে উপযোগী। নদীর পূর্ণাবয়ব দেখতে হলে নৌকাবিহারও করা যেতে পারে।

নদীর কোল ঘেঁষে গড়চুমুক পর্যটনকেন্দ্র ও গড়চুমুক ইকো ট্যুরিজম। হরিণের আবাসভূমি। প্রবেশমূল্য মাথাপিছু ১০ টাকা। নীলরঙা মূল তোরণ পেরিয়ে খানিক এগিয়ে বাঁ দিকে সবুজ রং করা মৃগদাবের প্রবেশতোরণ, দুই পাশে চৌকিদার ও তোরণের মাথায় দু’টি হরিণের মূর্তি খোদাই করা। বাঁশ ছোট করে কেটে ফেন্সিং দেওয়া টালির বাঁধানো পথটি চলে গেছে এ ধার-ও ধার। হাওড়া জেলা পরিষদের অধীনে, বন দফতরের দেখ্ভালে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল ও চিড়িয়াঘর, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে থাকার মতো পাখপাখালি, সরীসৃপ ও হরিণের নিরাপদ আশ্রয়। সাধারণ মানুষকে বন্যপ্রাণ ও উদ্ভিদ সম্বন্ধে শিক্ষামূলক সচেতন ও ভালবাসাতে শেখার প্রয়াসে বন দফতর যথেষ্ট ব্যবস্থা নিয়েছে। উদ্দেশ্য মহান, সন্দেহ নেই।

স্থানীয়দের কাছে জনপ্রিয় মৃগদাবটি তৈরি হয়েছিল ১৯৯১ সালের ৩১ জানুয়ারি। টিকিট বিক্রয়কেন্দ্রের জানলার সামনে লট্কানো নোটিস বোর্ডে নীলের উপর সাদা। হরফে লেখা ‘স্কুল পোশাকে প্রবেশ নিষেধ।’ অথচ, স্কুলপড়ুয়া পিঠে বইপত্তরের ভারী ব্যাগ সমেত কিশোর-কিশোরী থেকে নব্য তরুণ প্রেমিক যুগলদের সরগম পার্কের চৌদিক।

দামাল অরণ্যছায়ায় জলাশয় ও বিবিধ খাঁচাগুলোর সামনে পায়ে চলা পথ। পানা ভরা জলাশয়ে শরীর ডুবিয়ে মিষ্টি জলের কুমির। শ্রীলঙ্কা মালয়ের উপদ্বীপ অঞ্চলের মাংসাশী নিশাচর কুমিরগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম Marsh Crocodile, Mugger। এরা এক সঙ্গে ৪০টি মতো ডিম পা়ড়ে। ৬০-৯০ দিন পরে ডিম ফুটে বাচ্চা জন্মায়। পাখির খাঁচায় টিয়া ও চন্দনা রেলিংয়ে সার দিয়ে লেজ ঝুলিয়ে বসে আছে।

শস্যদানার সুদৃশ্য মাটির পাত্রগুলো দেওয়ালে, গাছের কাণ্ডে ঝোলানো। কোনও খাঁচায় ঘাড় গুঁজে বসে আছে ময়ূর। কী বীভত্স কর্কশ ভাবে ডেকে যাচ্ছে একটি ময়ূর— এই নাকি কেকা ধ্বনি! তখনও তিরতির কেঁপে উঠছে পেখমের উজ্জ্বল বর্ণমালা। চাইনিজ সিলভার ফেজান্ট— বুকের কাছটা কালো, ধবধবে সাদা ডানা ও পেখম, মাথায় লাল ঝুঁটি, খয়েরি-লাল শরীরের গোল্ডেন ফেজান্ট। এ অরণ্যে রয়েছে গ্রামবাংলার নানান পাখি— দোয়েল, বসন্তবৌরী, মৌটুসী, সাদা-কালো শালিক, শাহি বুলবুলি, কোকিল, লোহিতপুচ্ছ বুলবুলি, টুনটুনি, ফিঙে, বাঁশপাতি, চড়ুই, ঘুঘু, ফটিকজল, শ্যামা, নীলকণ্ঠ ইত্যাদি। গাছে ঝোলানো বোর্ডে দেশি-বিদেশি পাখিদের নামের লম্বা ফিরিস্তি। সজারু, কুমির, কচ্ছপ, গোসাপ, বনমোরগ, হরিণ খাঁচা। কিছু চিতল ছাড়া আছে অবশ্য জঙ্গলে। তবে সেই দঙ্গলদের দেখতে হয় ৫০০ মিটার দূর থেকে। পর্যটকদের তার বেশি কাছে যাওয়া নিষেধ।

অগ্রহায়ণ শেষের কোমল রোদ্দুরের নীচে সবুজের এক ঘর লাবণ্য…

যাতায়াত: হাওড়া স্টেশন থেকে উলুবেড়িয়া যাওয়ার লোকাল ট্রেনে এসে অটো বা ট্রেকারে গড়চুমুক ১৫ কিলোমিটার। হাওড়া থেকে উলুবেড়িয়া ৪৫ মিনিটের পথ। ধর্মতলা থেকে গড়চুমুক আটান্ন গেট বাসস্টপ ৬০ কিলোমিটার। পৌঁছতে সময় লাগবে সওয়া ২ ঘণ্টা। মুম্বই রোড ধরে গাড়ি চালিয়ে উলুবেড়িয়া এসে শহরের ভিতরে ঢুকে গড়চুমুক পর্যটনকেন্দ্র।

কখন যাবেন: বছরে যখন খুশি যাওয়া যায়। বর্ষাকালে ভাল লাগবে। সবুজ অরণ্যের গন্ধ নিন। শীতকালে মিঠে রোদ ও হিমেল পরশে ঘুরে বেড়ানো।

থাকা: সকালে গিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসা যায়। শীতকালে পিকনিক পার্টির জমায়েত বেশি। এখানে কয়েকটি বেসরকারি গেস্ট হাউস আছে। জেলা পরিষদের লজেও থাকা যায়। সব ঘরগুলিই নদীমুখী।

ছবি: লেখক।

Travel Guide Tourist Spot Garchumuk গড়চুমুক

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}