ধুতি তৈরি করছেন শিল্পী স্বদেশ প্রামাণিক। —সুদীপ ভট্টাচার্য
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ভারী ভালবাসতেন। বাঙালি এখন ফের সেই শান্তিপুরের ধুতিতে মজছে।
পুজোয় বাড়ছে হস্তচালিত তাঁতে তৈরি ধুতির চাহিদা। বিশেষ করে রঙিন ধুতির তুমুল বাজার। কিন্তু সেই চাহিদা সামাল দিতে পারেন, তত দক্ষ শিল্পী শান্তিপুরে এখন আর নেই। তাই জোগানে টান।
শান্তিপুরী ধুতির কদর এক সময়ে ছিল বাংলার বাইরেও। শান্তিপুরের শাড়ির মতোই মিহি সুতোর চাপ বুনোট বা ঘন বুনোটের ধুতির সুনাম ছিল দেশের বাইরেও। ইতিহাস বলছে, মুঘল আমলে এখানকার ধুতি ও কাপড় দিল্লি হয়ে কাবুল, ইরান, বেলুচিস্তান, আরব, গ্রিস-সহ বহু দেশে যেত। সেই সময়ে যে হাতে কাটা সুতোর ব্যবহার ছিল, তা তৈরি করতেন বাড়ির মহিলারা। ২৫০ থেকে ৩০০ কাউন্টের মিহি সুতোয় কাপড় ও ধুতি বোনা হত, এখন যা শান্তিপুরের তাঁতিদের কাছেও অলীক কল্পনা বলে মনে হয়।
একে তো সময়ের পরিবর্তনে আগের বাজার মার খেয়েছিল। তার উপরে শাড়ির তুলনায় ধুতির মজুরি কম হওয়াতেও তাঁতশিল্পীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এখন যা অবস্থা, তাতে সারা শান্তিপুর খুঁজলেও দু’তিন জনের বেশি ধুতি তৈরির শিল্পী মেলা ভার। একমাত্র শান্তিপুর কুঠিরপাড়া কো-অপারেটিভ ওয়েভার সোসাইটি লিমিটেডের দু’জন তাঁতশিল্পী ধুতি তৈরি করেন।
হঠাৎ ধুতির চাহিদা বাড়তে থাকায় শান্তিপুর কিন্তু তা মেটাতে পারছে না। সাধারণ হিসেব হল, এক জন শিল্পী হস্তচালিত তাঁতে সপ্তাহে পাঁচটা মতো ধুতি তৈরি করতে পারেন। দু’জনে খুব বেশি হলে মাসে ৫০টির মতো ধুতি বুনতে পারেন। এত দিন এতেই চলে যেত মোটামুটি। কিন্তু গত দু’তিন বছরে সেই চাহিদা প্রায় দশ গুণ বেড়ে গিয়েছে বলে জানাচ্ছেন কুঠিরপাড়ার এই সমবায়ের কর্তারা।
১৯৪৪ সালে তৈরি এই সমবায়টি এখনও শান্তিপুরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সমবায়ের ম্যানেজার স্বদেশ প্রামাণিক বলেন, ‘‘এখন তো বেশি মানুষ ধুতি পড়েন না। ফলে চাহিদা না থাকায় উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তার উপরে মজুরিও কম। কেননা ধুতিতে শাড়ির মতো নকশা থাকে না। তাই তাঁতিরা ধুতি বানাতে চান না।’’
এত দিন তার সুযোগ নিয়ে এসেছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। অন্য এলাকায় তৈরি ধুতিকে শান্তিপুরী ধুতি বলে তাঁরা চালিয়ে দেন। শান্তিপুর তাঁত বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক তারক দাসের মতে, ‘‘এখনও শান্তিপুরের ধুতির প্রতি মানুষের এতটাই মুগ্ধতা আছে যে শান্তিপুরের নাম করে অন্য এলাকার ব্যবসায়ীরা ঠকিয়ে দিতে পারছেন। শান্তিপুরে এখন আর তেমন ধুতি তৈরি হয় না।’’
এই ছবিটা কিন্তু হালফিল পাল্টাতে শুরু করেছে। স্বদেশবাবুর কথায়, ‘‘এখন বিয়ের অনুষ্ঠানে রঙিন ধুতির সামান্য কিছু চাহিদা আছে। তাই আমরা সাদা ধুতির পাশাপাশি কিছু রঙিন ধুতিও তৈরি করছিলাম। তবে দু’তিন বছর ধরে দেখছি, পুজোর সময়ে রঙিন ধুতির চাহিদা বাড়ছে। মজার ব্যাপার, খদ্দেরদের একটা বড় অংশ কমবয়সী। যুবসমাজের ফ্যাশনে একটা বদল দেখছি। অনেকেই পুজোয় ধুতি পড়তে আগ্রহী হচ্ছেন।’’ তিনি জানান, হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তাঁরা উৎপাদন বাড়াতে চেয়েছিলেন। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘তেমন শিল্পী পেলাম না। যাঁরা আছেন, তাঁদের বয়স হয়ে গিয়েছে। তাঁত চালানোর মতো ক্ষমতা তাঁদের আর নেই।’’
কিন্তু শান্তিপুরের ধুতির কী এমন মহিমা যে নতুন প্রজন্ম ফের ঝুঁকছে?
কলকাতার লেবুতলা থেকে ধুতি কিনতে আসা নেপাল দত্তের ব্যাখ্যা, ‘‘শান্তিপুরের ধুতি মিহি সুতোর। এমন বুনোট আর কোথাও পাবেন না। তাই এই ধুতি একবার পড়লে অন্য ধুতি আর পরতে ইচ্ছা করে না।’’ এই সে দিনও ১২০ কাউন্টের মিহি ধুতি তৈরি হত শান্তিপুরে। এখন সেটা কমে হয়েছে ১০০ কাউন্ট। তবে সেই সুতো দিয়ে ধুতি তৈরির জন্যও বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন। সেই দক্ষতা আছে সামান্য কয়েক জনের।
এক সময়ে শান্তিপুরের কালাকার সম্প্রদায়ের মানুষ সাদা ধুতির উপরে কালো রঙ করে সরু পাড় তৈরি করে দিতেন। পরে ‘ডার্বি’ পদ্ধতি আসায় পাড়ে নকশার কাজ শুরু হয়। ধীরে ধীরে নকশার উন্নতিও হয়েছে অনেক। এখন রঙিন ধুতিতেও সেই নকশা ফুটিয়ে তুলছেন শিল্পীরা। সেই সঙ্গে থাকছে শান্তিপুরের নিজস্ব ‘জলচুরি’ পাড়।
স্বদেশবাবু বলেন, ‘‘আমরা ভাবছি, তাঁতশিল্পীদের বর্তমান প্রজন্ম যাতে ধুতি তৈরিতে উৎসাহিত হন, তার জন্য প্রশিক্ষণ এবং বিশেষ কিছু সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করব।’’
শিল্পী থেকে খদ্দের, নবীনদের হাত ধরেই হয়তো হারানো মহিমা ফিরে পেতে চলেছে শান্তিপুরের ধুতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy