সিবিআইয়ের এই রিপোর্টকে কেন্দ্র করে লোকসভা ভোটের মুখে শাসক ও বিরোধী দলের চাপানউতোর শুরু হয়ে গিয়েছে। সিবিআই রিপোর্টকে পক্ষপাতদুষ্ট আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে তৃণমূল। আর বামেদের বক্তব্য, সে দিন তাদের সরকারের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল, এই রিপোর্টই তার প্রমাণ।
রাসায়নিক শিল্পতালুক তৈরির জন্য নন্দীগ্রামে ৩৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব ঘিরেই ঘটনার সূত্রপাত। অধিগ্রহণ ঠেকাতে নন্দীগ্রামে তৈরি হয়েছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। কমিটির নেতৃত্বে ২০০৭-এর জানুয়ারি থেকে রাস্তা কেটে, অবরোধ করে, গাছের গুঁড়ি ফেলে নন্দীগ্রামকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে ১৩ মার্চ মহাকরণে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব নন্দীগ্রামে পুলিশ পাঠানোর সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। পরের দিন সকালে ভাঙাবেড়া ও অধিকারীপাড়া দিয়ে পুলিশ নন্দীগ্রামে ঢোকার চেষ্টা করে। দু’জায়গাতেই পুলিশ-গ্রামবাসী সংঘর্ষ হয়। পুলিশের গুলিতে ভাঙাবেড়ায় ১১ জনের মৃত্যু হয়। অধিকারীপাড়ায় মারা যান ৩ জন।
পুলিশের বিরুদ্ধে বিনা প্ররোচনায় গুলি চালানো এবং নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের উপরে অকথ্য অত্যাচারের অভিযোগ তুলে সিবিআই তদন্ত দাবি করেছিল তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূল। অভিযোগের গুরুত্ব বিচার করে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় কলকাতা হাইকোর্ট।
সিবিআই যে তদন্ত রিপোর্ট পেশ করেছে, তাতে কিন্তু আন্দোলনকারীদের তরফে প্ররোচনার কথাই বলা হয়েছে। তাদের বক্তব্য, তালপাটি খালের উপরে ভাঙাবেড়া সেতুর এক প্রান্তে পৌঁছে পুলিশ দেখে, অপর প্রান্তে অন্তত পাঁচ হাজার লোক রয়েছে। জমায়েতের সামনের সারিতে মহিলা ও শিশু। পিছনে লাঠি, ভোজালি, রড হাতে পুরুষরা। ওই জনতার পিছন থেকে মাঝেমধ্যেই বোমা ও গুলি ছুটে এসেছিল পুলিশের দিকে।
সিবিআই চার্জশিটে বলেছে, ঘটনাস্থলে উপস্থিত এগ্জিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ওই জমায়েতকে বেআইনি বলে ঘোষণা করার পরে পুলিশ ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। প্রথমে কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেট ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হয়। তাতে কাজ না-হওয়ায় পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন ম্যাজিস্ট্রেট। প্রথমে শূন্যে ১০ রাউন্ড গুলি ছুড়লেও জনতা নড়েনি। তার পরেই জনতাকে লক্ষ করে ১০ রাউন্ড গুলি চালায় পুলিশ। ভাঙাবেড়ায় সে দিন যে ১২৯ জন গ্রামবাসী আহত হন, তাঁদের
সবার বিরুদ্ধেই পুলিশকে আক্রমণ করার অভিযোগ আনা হয়েছে সিবিআইয়ের চার্জশিটে। অধিকারীপাড়ার ঘটনা প্রসঙ্গে সিবিআই জানিয়েছে, সেখানে জমায়েত হাজার তিনেক গ্রামবাসী এতটাই আক্রমণাত্মক ছিলেন যে, তাঁরা কয়েক জন মহিলা কনস্টেবলকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কোনও ক্রমে তাঁদের উদ্ধার করে পুলিশ। ভাঙাবেড়ার মতো এখানেও ভিড়ের পিছন দিকে লাঠি, তলোয়ার, রড, এমনকী আগ্নেয়াস্ত্র-সহ বেশ কিছু লোক ছিল। এখানেও পুলিশকে লক্ষ করে ক্রমাগত গুলি ছোড়া হয়েছে। ঘটনার পরে অধিকারীপাড়া থেকে পুলিশ দেশি বন্দুক এবং গুলি বাজেয়াপ্তও করেছে।
চার্জশিটে সিবিআই বলেছে, অধিকারীপাড়াতেও মাইক প্রচার-সহ নানা ভাবে গ্রামবাসীদের সরে যেতে বলা হয়েছিল। তাতে কাজ না হওয়ায় এক পুলিশ-কর্তা গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। এখানেও এক জন এগ্জিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের থাকার কথা ছিল। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের অভাবে তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। অধিকারীপাড়ায় সব মিলিয়ে ১৭ রাউন্ড গুলি চালায় পুলিশ। এর মধ্যে ১০ রাউন্ড শূন্যে। এখানেও আহত ৩৭ জনের বিরুদ্ধে পুলিশকে আক্রমণ করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
সিবিআইয়ের তদন্ত রিপোর্ট এবং চার্জশিটের কথা প্রকাশ্যে আসার পরেই সরব হয়েছে তৃণমূল। তৎকালীন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতা তথা তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ, “খেজুরি থানার তৎকালীন ওসি অমিত হাতি ফ্রন্ট সরকারের নির্দেশে যে ডায়েরি করেছিলেন, সেটাই তুলে দিয়েছে সিবিআই! এই চার্জশিট সিবিআই ও পুলিশ আধিকারিকদের গড়াপেটা খেলা।” চাজর্র্শিটের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথা জানিয়েছেন শুভেন্দু। প্রতিরোধ কমিটির আর এক নেতা, অধুনা পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সহ-সভাপতি শেখ সুফিয়ানের বক্তব্য, “লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেসকে সাহায্য করতেই এমন চার্জশিট তৈরি করা হয়েছে।”
আর সিবিআই তদন্ত সম্পর্কেই প্রশ্ন তুলে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “সিবিআই মামলা কী হয়, তা ভিখারি পাসোয়ান অন্তর্ধান, ছোট আঙারিয়ার ঘটনা বা নেতাইয়ের গণহত্যা, জ্ঞানেশ্বরী রেল দুর্ঘটনা সব ক্ষেত্রেই চোখের উপরে আছে!”
অন্য দিকে, সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের জেরে রাজ্যে পায়ের তলার মাটি হারানো বামেরা এই সিবিআই রিপোর্টকে হাতিয়ার করে তৃণমূলকে পাল্টা জবাব দেওয়ার আশা করছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “নন্দীগ্রামে আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র হয়েছিল। দক্ষিণপন্থী থেকে অতি-বামপন্থী পর্যন্ত বিরোধীদের সেই মহাজোটের ধারাবাহিক অপপ্রচার সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, সে সব অপপ্রচারই ছিল!” যার উত্তরে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “তা হলে বুদ্ধবাবু (তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য) খেজুরিতে গিয়ে নন্দীগ্রামে গুলিচালনার জন্য ক্ষমা চাওয়ার নাটক করেছিলেন কেন?”
নন্দীগ্রামের ঘটনায় বুদ্ধবাবু এবং হলদিয়ার তৎকালীন সিপিএম সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠকে দায়ী করে বরাবরই তদন্ত দাবি করেছে তৃণমূল। প্রথম দফার চূড়ান্ত চার্জশিট পেশ করা আগে সিবিআই তৃণমূল-শাসিত রাজ্য সরকারের কাছে যে খসড়া তদন্ত রিপোর্ট পাঠিয়েছিল, তাতে ভাঙাবেড়ায় গুলি চালানোর জন্য তিন পুলিশকর্তা অরুণ গুপ্ত, অনিল শ্রীনিবাসন ও অমিত হাতি এবং অধিকারীপাড়ার ঘটনায় অন্য তিন পুলিশকর্তা সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাশিস বড়াল ও শেখর রায়ের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশের অনুমতি চাওয়া হয়। রাজ্য তা না মেনে বুদ্ধবাবু ও লক্ষ্মণবাবুর ভূমিকা খতিয়ে দেখতে বলে। কিন্তু সিবিআই জানিয়ে দেয়, ওই দু’জনের বিরুদ্ধে কোনও তথ্যপ্রমাণ তারা পায়নি।