Advertisement
E-Paper

সময় পিছিয়ে গেল ১ বছর ৫৪ সেকেন্ড

শ্যামল ঘোষ। পেশায় সরকারি চিকিৎসক। কৃষ্ণনগর পুর হাসপাতালে কর্মরত। রাজ্যে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর বাবা।

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২১ ০৬:৫৮
১৭ মার্চ, ২০২০। রাজ্যে প্রথম করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট ‘পজিটিভ’ এসেছিল।

১৭ মার্চ, ২০২০। রাজ্যে প্রথম করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট ‘পজিটিভ’ এসেছিল। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

১৭ মার্চ, ২০২০। প্রথম কোভিড ঢুকল বাংলায়। শুরু হল ভয়, আতঙ্ক, পরপর মৃত্যু। সব বর্ষপূর্তি সুখের হয় না। তবু গত এক বছরের ছন্দপতন ফিরে দেখল আনন্দবাজার ডিজিটাল।

মাত্র ৫৪ সেকেন্ড। তার আগে প্রথম তিন বার ফোন কেটে দিয়েছেন। চতুর্থ বার ফোন ধরেছেন। কিন্তু পরিচয় শুনেই সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটেছেন।

পঞ্চম বার ফোন ধরলেন। তার পর গড়গ়ড় বলে গেলেন একই কথা, ‘‘আমি কোনও কথা বলব না।’’ ৫৪ সেকেন্ড ধরে। তার পর নিজেই ফোন কেটে দিলেন তিনি।

তিনি— শ্যামল ঘোষ। পেশায় সরকারি চিকিৎসক। কৃষ্ণনগর পুর হাসপাতালে কর্মরত। এক বছর আগেও তাঁকে সংবাদমাধ্যম খুঁজে বেড়িয়েছে অনর্গল। এক বছর পরেও তাঁকে খুঁজছে। কারণ, শ্যামল ঘোষ রাজ্যে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর বাবা।

১৭ মার্চ, ২০২০। রাজ্যে প্রথম করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট ‘পজিটিভ’ এসেছিল। ঘটনাচক্রে, সেই করোনা-আক্রান্তই শ্যামল-পুত্র। অক্সফোর্ডের পড়ুয়া ১৫ মার্চ ভোরে কলকাতা বিমানবন্দরে নামেন। তাঁকে বিমানবন্দরে আনতে গিয়েছিলেন শ্যামলের স্ত্রী। কর্মসূত্রে যিনি নবান্নের শীর্ষ স্তরের আমলা। পর দিন অর্থাৎ ১৬ মার্চ ছেলেকে নিয়ে নবান্নেও গিয়েছিলেন তিনি। তার ঠিক পরের দিন যখন করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট আসে বিলেতফেরত ওই তরুণের, গোটা রাজ্যে শোরগোল পড়ে যায়।

সমালোচনার ঝড় নেটমাধ্যমে। একের পর এক আক্রমণ শ্যামলের পরিবারের প্রতি। তাঁর স্ত্রী-পুত্রের উদ্দেশে বাছা বাছা শব্দ প্রয়োগ। বাদ যাননি শ্যামলও। তখনও ‘লকডাউন’ ঘোষণা হয়নি। হয়নি ‘জনতা কার্ফু’ও। গোটা বিশ্বের মতো বাংলাও কম্পিত করোনা-ভয়ে। রাজ্যে প্রথম করোনা আক্রান্তের কথা জানতে পেরে ‘সহানুভূতি’, ‘সহমর্মিতা’র চেয়ে শ্যামলদের জন্য অনেক বেশি বরাদ্দ হয়েছিল ‘সন্দেহ’, ‘বিদ্বেষ’ আর ‘ঘেন্না’।

শ্যামল-পুত্রের পর আরও প্রায় পৌনে ৬ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত রাজ্যে।

শ্যামল-পুত্রের পর আরও প্রায় পৌনে ৬ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত রাজ্যে।

১৭ মার্চ, ২০২১। এক বছর পরে। রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৮৫৩। অর্থাৎ শ্যামল-পুত্রের পর আরও প্রায় পৌনে ৬ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত রাজ্যে। কিন্তু ‘প্রথম’ হওয়ার সেই ‘অভিঘাত’ এক বছর পরেও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে শ্যামলকে। রাজা রামমোহন রায় লিখেছিলেন, ‘শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর’। কিন্তু শ্যামলের কাছে প্রথম সে দিনই ‘ভয়ঙ্কর’ হয়ে উঠেছিল। আনন্দবাজার ডিজিটালে তখন তিনি লিখেছিলেন, ‘আমাদের ভুল বুঝবেন না প্লিজ’! শুরুতেই শ্যামল লিখেছিলেন, ‘সাফ বলে দেওয়াই ভাল’। তার পর লিখেছিলেন, ‘ছেলের চিকিৎসার ব্যাপারে কোনও গাফিলতিই করিনি। যদিও কোনও উপসর্গ ছিল না। লন্ডন থেকে ফেরার আগে ও নিজেকে আইসোলেট করে রেখেছিল। এখানে এসেও। বাড়ি আর হাসপাতালের বাইরে যায়নি। শপিং মলে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। আমার স্ত্রী নবান্নে কিছু ক্ষণের জন্য গিয়েছিলেন। সেই সময় আমাদের ছেলে নবান্নের কার পার্কিংয়ে গাড়িতে বসে ছিল। এটা হয়তো ঠিক হয়নি, মানছি। এ ছাড়া আমাদের কোনও গাফিলতি হয়নি। আমি আমার ছেলের সংস্পর্শে আসিনি’।

সে দিন তাঁকে প্রায় কৈফিয়তের সুরে জানাতে হয়েছিল, ‘আমার ছেলে বা স্ত্রী কিন্তু কোনও পার্কে যায়নি, কোনও রেস্তরাঁতে যায়নি, কোনও শপিং মলে যায়নি, কোনও সিনেমা থিয়েটার, ক্লাব কোথাও যায়নি। সে সবের কোনও প্রশ্নই ওঠে না’।

এক বছর আগে শ্যামল যখন আনন্দবাজার ডিজিটালে এ কথা লিখেছিলেন, তখন রাজ্যে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১। তাঁর একমাত্র ছেলে। আর এক বছর পর সেটা পৌনে ৬ লাখের বেশি।

কিন্তু গত ১ বছর কেমন গেল? কেমন আছেন তাঁর পুত্র? তাঁর পরিবার কি স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে? চার পাশের প্রতি ‘অভিমান’ কমেছে? এখনও কি করোনা সুরক্ষা বিধি মেনে চলেন তাঁরা? টিকা নিয়েছেন? এক বছরে তো কত কথা জমে যায়। সে সব জানতেই তাঁকে ফোন করা হয়েছিল।

ফোন ধরলেন শ্যামল। কিন্তু কিছু বললেন না। বলতে চাইলেন না। কিন্তু তাঁর না-বলা কথায় থেকে গেল সেই বিরক্তি, সেই অভিমান, সেই ক্ষোভ।

সময় পিছিয়ে গেল ১ বছর ৫৪ সেকেন্ড।

COVID-19 coronavirus One year of Corona Corona in Bengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy