Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Cyclone Amphan

তছনছ বাড়ি, হাতে ৫ হাজার

সকলে যে টাকা ফেরত দেননি, সে কথা অবশ্য মানছেন তৃণমূলের বাগদা বিধানসভা কমিটির চেয়ারম্যান তরুণ ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘বেশির ভাগই টাকা ফেরত দিয়েছেন। তবে সকলে এখনও দেননি।’’

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

সীমান্ত মৈত্র 
বনগাঁ শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২০ ০৯:৪৭
Share: Save:

কেউ বলছেন, টাকা পাইনি। কেউ বলছেন, গোটা বাড়িটা ধুলোয় মিশে গেল। কিন্তু হাতে পেলাম আংশিক ক্ষতিপূরণের মাত্র ৫ হাজার টাকা। কেউ বলছেন, ক্ষির তো খেয়ে গেল শাসক দলের নেতারা। আবার শোনা যাচ্ছে, বিরোধীরাও কম যাননি। যার যেখানে শক্তি, সেখানে তারাই নাকি লুটেপুটে খেয়েছে ক্ষতিপূরণের সরকারি টাকা। চাপে পড়ে অবশ্য টাকা ফেরতও দিয়েছিলেন কেউ কেউ।

আমপান পরবর্তী রাজনীতি গড়িয়েছে ক্ষতিপূরণে টাকার হিসেবনিকেশ বা তাতে মিশে থাকা জল নিয়ে। সেই আকচাআকচির মধ্যে অনেকের সমস্যার যে নিষ্পত্তি হয়নি, তা দেখা গেল বনগাঁ মহকুমায়। তবে খুঁজলে ছবিটা দুই ২৪ পরগনার নানা প্রান্তে কার্যত একই।

ভিতের উপরে টিন, শুকনো নারকেল পাতা, ভাঙা কাঠের কয়েকখানা আসবাব পড়ে। আমপানে টিনের চালের এই এক চিলতে বাড়িটুকু সম্পূর্ণ ভেঙে গিয়েছিল বাগদা ব্লকের বাসিন্দা পরিতোষ ও বাপি দাসের। টিনের চাল চোখের সামনে উড়ে যেতে দেখেছেন। বাড়ির মন্দিরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ঘরের বেশিরভাগ জিনিসপত্রই নষ্ট হয়। ঝড় থামলে দেখেন, মাটির ভিতটুকুই শুধু দাঁড়িয়ে আছে।

সেই ঘর সোজা করে দাঁড় করাতে পারেননি দুই ভাই। জানালেন, বাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে গেলেও সরকারি ক্ষতিপূরণের ২০ হাজার টাকা পাননি। আংশিক ক্ষতিপূরণের মাত্র ৫ হাজার টাকা হাতে আসে। ওই টাকায় বাড়ি সারানো সম্ভব ছিল না। ভাঙা বাড়ির পাশে ভাঙাচোরা ইটের গাঁথনির নীচে আপাতত রাত কাটাচ্ছেন পরিবারের পাঁচ সদস্য। পরিতোষ বলেন, ‘‘কয়েক বছর আগে সরকারি প্রকল্পে বাড়ি করার জন্য মায়ের নামে ৩৫ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। তা দিয়ে ইটের দেওয়াল দিতে পেরেছিলাম। আমপানের পরে পুরনো টিন কিনে এবং পরিচিতদের কাছ থেকে বাঁশ এনে ইটের ঘরটা থাকার মতো করে নিয়েছি।’’

প্রতিবেশী কর্ণদেব বিশ্বাসের টিনের বাড়িটি আমপান এবং তার সাত দিন পরে কালবৈশাখী ঝড়ে সম্পূর্ণ লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। পেশায় ভ্যানচালক কর্ণদেবও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত তালিকার ৫ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। তা দিয়ে ঘর মেরামত সম্ভব ছিল না। তাঁর কথায়, ‘‘আরও ২৫ হাজার টাকা ধার করতে হয়েছিল। তা দিয়ে ঘর ও বাথরুম করেছি। ওই টাকা এখনও শোধ করে যাচ্ছি।’’

উত্তম মণ্ডল নামে এক খেতমজুর জানালেন, গাছের ডাল পড়ে বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু ক্ষতিপূরণের কোনও টাকাই পাননি তিনি।

ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও যাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকেছিল, তাঁরা সকলে টাকা ফেরত দেননি বলেও অভিযোগ। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই ওই টাকা সরকারি কোষাগারে ফিরিয়ে দেওয়া নির্দেশ দিয়েছিলেন বিডিও জ্যোতিপ্রকাশ হালদার। কিছু লোক টাকা ফেরালেও অনেকেই তা করেননি বলে জানালেন স্থানীয় মানুষ।

বিজেপির বারাসত সাংগঠনিক জেলার সম্পাদক তথা বাগদা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য অমৃতলাল বিশ্বাসের অভিযোগ, ‘‘প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও অনেকেই ক্ষতিপূরণের ২০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। অনেকেই টাকা ফেরত দেননি। প্রশাসনকে জানিয়েও ফল হয়নি। শাসকদলের নেতাদের মদতেই কেউ কেউ টাকা ফেরত না দিয়ে বসে আছেন।’’ একই বক্তব্য সিপিএমের বাগদা এরিয়া কমিটির সম্পাদক সুশান্ত চক্রবর্তীর।

সকলে যে টাকা ফেরত দেননি, সে কথা অবশ্য মানছেন তৃণমূলের বাগদা বিধানসভা কমিটির চেয়ারম্যান তরুণ ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘বেশির ভাগই টাকা ফেরত দিয়েছেন। তবে সকলে এখনও দেননি।’’ বাগদা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তৃণমূলের গোপা রায় বলেন, ‘‘শুনেছি, বেশিরভাগই টাকা ফেরত দিয়েছেন।’’

গাইঘাটা ব্লকের সকলে টাকা ফেরত দেননি বলে জানিয়েছেন গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তৃণমূলের গোবিন্দ দাস। তিনি বলেন, ‘‘ব্লকে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ২০ হাজার টাকা এবং ৩৩ হাজার পরিবার ৫ হাজার টাকা করে পেয়েছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও যাঁরা টাকা পেয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগ টাকা ফেরত দিয়েছেন। তবে সকলকে দেননি।’’ বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, অভিযোগ, টাকা ফেরাতে প্রশাসনিক তৎপরতা ছিল না। বাগদার বিডিও বলেন, ‘‘লিখিত ভাবে প্রধানদের কয়েকবার নির্দেশ দিয়েছি প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও যদি কেউ টাকা পেয়ে থাকেন, তা হলে সেই টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করতে। এখন পর্যন্ত ৪৩ জন টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন। প্রধানেরা লিখিত ভাবে জানিয়েছেন, এর বাইরে টাকা ফেরত দেওয়ার আর কেউ বাকি নেই। এ বিষয়ে কোনও অভিযোগও পাইনি।’’

সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পঙ্কজ ঘোষ বলেন, ‘‘বনগাঁ মহকুমায় আমপানের ক্ষতিপূরণের টাকা বিলি নিয়ে চূড়ান্ত স্বজনপোষণ ও দুর্নীতি হয়েছে।’’

জেলা তৃণমূলের কোঅর্ডিনেটর গোপাল শেঠ অবশ্য বলেন, ‘‘তৃণমূলের লোকজন যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছিলেন, তাঁরা টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন। বিজেপির লোকজন টাকা ফেরত দেননি। বিডিও অফিসগুলিতে ক্ষতিগ্রস্তদের নামের তালিকা টাঙানো হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত কোনও মানুষ টাকা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হননি।’’

তাঁদের দলের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিজেপির বারাসত সাংগঠনিক জেলার সহ সভাপতি বিশ্বজিৎ দাস।

অতশত চাপানউতর অবশ্য বোঝেন না খেতমজুর উত্তম। তাঁর শুধু আক্ষেপ, ‘‘দু’দফায় তালিকা তৈরি হল। অথচ, আমার ভাঙা বাড়িটুকু সরকার বাহাদুরের নজরেই পড়ল না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

compensation Cyclone AMphan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE