Advertisement
E-Paper

আর্সেনিকের বিষ মিশে জলে, মৃত্যুর দিন গুনছেন অনেকে

গাইঘাটা, পানীয় জল যেখানে আতঙ্কেরই অন্য নাম। বহু বছর ধরে উচ্চ মাত্রায় আর্সেনিক-মিশ্রিত পানীয় জল খেয়ে এই ব্লকের বহু মানুষ মারা গিয়েছেন। অনেকে মৃত্যুর দিন গুনছেন। সরকারি কর্তাদের কাছে দরবার করেও সুরাহা মেলেনি। রাজনীতির কারবারিদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি মিলেছে ঢের, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৫ ০০:১৯

গাইঘাটা, পানীয় জল যেখানে আতঙ্কেরই অন্য নাম।

বহু বছর ধরে উচ্চ মাত্রায় আর্সেনিক-মিশ্রিত পানীয় জল খেয়ে এই ব্লকের বহু মানুষ মারা গিয়েছেন। অনেকে মৃত্যুর দিন গুনছেন। সরকারি কর্তাদের কাছে দরবার করেও সুরাহা মেলেনি। রাজনীতির কারবারিদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি মিলেছে ঢের, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।

আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, ব্লকের ৯০ শতাংশ মানুষের পানীয় জলে আর্সেনিকের পরিমাণ স্বাভাবিকের থেকে বেশি। মূলত ১৯৯৫ সালের আগে পর্যন্ত গাইঘাটায় আর্সেনিক সম্পর্কে মানুষ বিশেষ কিছুই জানতেন না। বাড়ির সাধারণ টিউবওয়ের জল পানীয় হিসাবে ব্যবহার করা হতো। ওই বছরই আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটির পক্ষ থেকে গাইঘাটার বিভিন্ন এলাকার পানীয় জল পরীক্ষা করার ব্যবস্থা হয়েছিল। যার ফলাফল সমীক্ষার পরে বোঝা যায় প্রকৃত পরিস্থিতি। কয়েক বছর আগে আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীরা উপযুক্ত চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে বিডিও অফিসে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। প্রশাসনের বিভিন্ন মহলে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। তারপরেও অবস্থার উন্নতি হয়নি।

আর্সেনিকের ভয়াবহ সমস্যার কথা স্বীকার করে নিয়ে গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি ধ্যানেশনারায়ণ গুহ জানান, কয়েক বছর আগে স্থানীয় গাইঘাটা ব্লক পুষ্প ও কৃষি মেলার পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সংস্থাকে দিয়ে এলাকার বেশ কিছু গভীর নলকূপের জল পরীক্ষা করানো হয়েছিল। তাতে দেখা গিয়েছে, পানীয় জলে স্বাভাবিকের থেকে বেশি মাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে। বিশেজ্ঞেরা জানিয়েছেন, মাটির নীচে ৪০০-৬০০ ফুট গভীরের জলে আর্সেনিক মাত্রা অনেক বেশি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এলাকায় যে সরকারি গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে, তার বেশ কিছু ওই গভীরতার মধ্যে রয়েছে। ধ্যানেশবাবুর আশ্বাস, ‘‘নৈহাটি থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে গঙ্গার বিশুদ্ধ পানীয় আনার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। নৈহাটিতে ইতিমধ্যেই ওই প্রকল্পের কাজ শুরুও হয়েছে।’’ গাইঘাটার বিডিও পার্থ ভৌমিকও স্বীকার করছেন, ব্লকের ১৩টি পঞ্চায়েত এলাকাই আর্সেনিক দূষণ প্রভাবিত।

স্থানীয় বািসন্দারা জানান, অনেকেই পাইপ লাইনের মাধ্যমে আসা ট্যাপের জল বা গভীর নলকূপ এবং বাড়ির সাধারণ কলের জল পানীয় হিসাবে ব্যবহার করেন। পানীয় জল ছাড়াও এলাকায় উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য, বিচুলি এমনকী, গরুর দুধেও আর্সেনিকের পরিমাণ বেশি থাকার আশঙ্কা আছে।

আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটির রাজ্য সম্পাদক অশোক দাসের দাবি, ‘‘১৯৯৫ সাল থেকে গাইঘাটা ব্লকে আর্সেনিক দূষিত পানীয় জল খেয়ে বিষে আক্রান্ত হয়ে এখনও পর্যন্ত মারা গিয়েছেন ৩০ জন। এখনও আর্সেনিক বিষে গুরুতর আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় দু’শো।’’ প্রতিরোধ কমিটি সূত্রে জানা গেল, ব্লকের বহু প্রাথমিক ও হাইস্কুলের পড়ুয়ারাও স্কুলের নলকূপ থেকে আর্সেনিক দূষিত জল খাচ্ছে। কমিটির পক্ষ থেকে নলকূপের জল পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, স্বাভাবিকের থেকে বেশি মাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে। ভূগর্ভস্থ জল দিয়ে চাষবাস হয়। আর ওই জলেই উচ্চমাত্রায় আর্সেনিক থাকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পানীয় জলে আর্সেনিকের স্বাভাবিক মাত্রা প্রতি লিটারে ০.০১ মিলি লিটার। সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা প্রতি লিটারে ০.০৫ মিলি লিটার। ব্লকের বেশির ভাগ পানীয় জলের কলেই ওই মাত্রার থেকে বেশি মাত্রায় আর্সেনিক-যুক্ত জল আসে। অশোকবাবুর অভিযোগ, ‘‘এসএসকেএম হাসপাতালে সরকারি ভাবে আর্সেনিক আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু আড়াই বছর আগে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আর্সেনিকে আক্রান্তদের শনাক্তকরণেরও ব্যবস্থা নেই।’’

এক আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর কথায়, ‘‘মদ খেয়ে মরলে সরকার ক্ষতিপূরণ দেয়। আমার বাড়িতে মাটির নীচে সোনা পাওয়া গেলে সরকার তা নিয়ে নেয়। তা হলে জলে বিষ থাকলে কেন সরকার আমাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে না।’’

স্থানীয় বিষ্ণুপুর উত্তরপাড়ার বাসিন্দা বছর তেষট্টির ভীম বিশ্বাস দীর্ঘদিন ধরেই আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত। পেশায় চাষি ভীমবাবু মাঠে যেতে পারেন না। হাঁটাচলার শক্তিও প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন। রবিবার দুপুরে ভীমবাবুর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির বারান্দায় একটি খাটের উপরে খালি বসে আছেন তিনি। সারা শরীরে কালো ও বাদামি রঙের ছোপ ছোপ দাগ। ভীমবাবুর হাতের তালুতে ও পায়ের পাতার নীচে গুটি গুটি দানায় ভরে গিয়েছে। ভীমবাবু বলেন, ‘‘ইতিমধ্যেই আর্সেনিক বিষ আক্রান্ত হয়ে আমার দুই ভাই মারা গিয়েছে। আমার শরীরও ভাল যাচ্ছে না।’’ ভীমবাবু জানান, বাড়ির সাধারণ টিউওবয়েলের জল খেতেন। জানতেন না, ওই কলের জলে উচ্চমাত্রায় আর্সেনিকের বিষ মিশে রয়েছে। আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ কমিটির সদস্যরাই তাঁদের এ ব্যাপারে সচেতন করেছিলেন। কিন্তু তত ক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। টাকার অভাবে তিনি চিকিৎসা করাতে পারছেন না বলে জানালেন। গাজনা এলাকার ৬৫ বছরের বৃদ্ধ আমজাদ সর্দার। মাঠের মধ্যে একফালি মাথা গোঁজার জায়গা। আমজাদ নিজেও আর্সেনিকের বিষে আক্রান্ত। বললেন, ‘‘আমার স্ত্রী সালেমা গত কয়েক বছর আগে আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। চিকিৎসা করানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য আমার ছিল না। অতীতে খেত মজুরের কাজ করতেন আমজাদ। এখন অসুস্থতার কারণে পারেন না। হাতের তালু দেখিয়ে বললেন, ‘‘যখন গুটি ওঠে, নিজেই কেটে দিই। প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। নিজের চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই বলে জানালেন তিনিও।

বিডিও জানিয়েছেন, গভীর নলকূপের জল পরীক্ষা করা হয়। এলাকার বিশ কিছু স্কুলেও ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসানো হয়েছে। যার ফলে পড়ুয়ারা আর্সেনিক মুক্ত জল থেকে পাচ্ছে। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সুব্রত সরকার অবশ্য জানিয়েছেন, আর্সেনিক নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনার অভাব আছে। ব্লক স্বাস্থ্য দফতর জানায়, ঠাকুরনগরে চাঁদপাড়া ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আর্সেনিক ক্লিনিক আছে। সেখানে কোনও রোগী অবশ্য আসেন না। এলেও তাদের সাধারণ রোগের ওষুধ দেওয়া হয়। আর্সেনিক আক্রান্তরা অবশ্য জানিয়েছেন,ওই ক্লিনিকে চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা নেই। আর্সেনিকের দূষণ শরীরে প্রবেশ করেছে কিনা তা-ও জানা যায় না।

(চলবে)

arsenic mixed water gaighata arsenic gaighata arsenic death arsenic causes skin cancer gaighata arsenic pollution simanto maitra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy