সামনের সারিতে বসে চার জন। মথুরাপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।
ডায়মন্ড হারবার: চালকের এক ধারে দু’জন, অন্য ধারে আরও দু’জন বসে। পিছনের আসন থেকে এক যাত্রী মিনমিন করে বললেন, ‘‘দাদা, একটু কম লোক তুললে হতো না, আপনি স্টিয়ারিং-ব্রেক সামলাবেন কী করে?’’ ‘কুছ পরোয়া নেহি’ স্টাইলে উত্তর মিলল, ‘‘আপনি চুপচাপ বসে থাকুন, না পোষালে নেমে যেতে পারেন!’’
পিছনের আসনে সেই যাত্রীর অবশ্য তখন নেমে যাওয়ারও জো নেই। কারণ, তিনজনের আসনে সেখানে বসে চারজন। সেই চাপ সামলে নামবার পথ কোথায় যাত্রীর!
ডায়মন্ড হারবার মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় শ’য়ে শ’য়ে অটো চলে। অনেক জায়গাতেই চালকদের দাপটে ট্যাঁ-ফু করার সুযোগ পান না যাত্রীরা। খুচরো পয়সা নিয়ে খুচরো গোলমাল লেগেই আছে।
তার উপরে অভিযোগ, অধিকাংশ অটোয় কাগজপত্রের বালাই নেই। চালকের লাইসেন্স? সে সব হয় তো আছে হাতে গোনা কিছু যুবকের। রুট পারমিটের নামে যা থাকে, তা হল অলিখিত অনুমোদন। যেখানে খরচ পড়ে হাজার দশেক টাকা!
আর এ সবে মদত দেয় রাজনৈতিক দল, অভিযোগ বহু দিনের।
ডায়মন্ড হারবারের মথুরাপুর থেকে রায়দিঘি ও জয়নাল, মগরাহাট স্টেশন থেকে দক্ষিণ বারাসত, মন্দিরবাজার থেকে বিজয়গঞ্জ বাজার, কুলপি থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর, দক্ষিণ বিষ্ণুপুর থেকে জয়নগর, মথুরাপুর থেকে ঘোড়াদল-সহ বিভিন্ন রুটে অটো চলাচল করে। নিয়ম-নিষেধ মানে না বেশির ভাগ অটোই, অভিযোগ নিত্যযাত্রীদের।
আরও অভিযোগ, অনেক অটোয় উপযুক্ত আলোরও ব্যবস্থা নেই। সন্ধের পরে অটোতে চড়া রীতিমতো বিপজ্জনক। রাস্তাঘাটও অনেক সময়ে ভাঙাচোরা। সেই অবস্থায় ছোটখাট দুর্ঘটনা লেগেই থাকে। গাড়ির চাকা তাপ্পি মারা। তার উপরে অটোর রেষারেষি চলে।
মথুরাপুর থেকে রায়দিঘি ও জয়নাল রুটে অটো চলে ৫০০-৬০০টি। গাড়ি চালানোর অনুমতি পেতে জেলা পরিবহণ আধিকারিকের দফতরে ছোটাছুটির দরকার পড়ে না। জানা গেল, অটো স্ট্যান্ডের ‘স্টার্টার’ই সব ব্যবস্থা করে দেয়। তাকে দিতে হয় ১০ হাজার ১ টাকা। টাকা ফেললে মুখে মুখেই মিলে যায় ‘রুট পারমিট’ মথুরাপুর স্টেশন মোড়ে বসা স্টার্টারকে প্রতি দিন দিতে হয় ১০ টাকা করে। রায়দিঘিতে আরও ১০ টাকা। তা হলেই আর কোনও ঝক্কি নেই। তা ছাড়া, রাস্তায় কোনও সমস্যা হলে চালক পাশে পাবেন তৃণমূল অটো ইউনিয়নের নেতৃত্বকে। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটলে ইউনিয়নই টাকা-পয়সা দিয়ে মিটমাট করিয়ে দিচ্ছে, এমন উদাহরণও শোনা যায়। তবে থানা-পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছয় না এ ধরনের বিষয়। ফলে সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকে না কিছুই।
অটো চালকদের দাপট এতটাই, নিত্যযাত্রীরা সাধারণত মুখ খুলতে সাহস পান না। মথুরাপুর-রায়দিঘি রুটের এক অটোযাত্রী দেবাশিস পুরকাইত, শ্যামল গায়েনরা বলেন, ‘‘বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জন্য মাঝে মধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু চালকদের কিছু বললে উল্টে কটূ কথা শুনিয়ে দেয়। মহিলারা তো অসম্মানিত হওয়ার ভয়ে মুখই খোলেন না।’’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন অটো চালক বললেন, ‘‘দিন দিন প্রতিযোগিতা বাড়ছে। গাড়ির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ব্যবসায় তেমন লাভ থাকছে না। তার উপরে গাড়ি রাস্তায় নামালেই ইউনিয়ন থেকে পুলিশ— সকলকে টাকা গুণতে হচ্ছে। তাই বেশি যাত্রী না নিয়ে উপায় থাকে না।’’ তবে যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়, এমনটা মানতে নারাজ ওই চালকেরা।
অটোর দৌরাত্মের পিছনে নানা সময়ে বাম-ডান নেতাদের প্রশ্রয় থাকে, অভিযোগটা নতুন নয়। আগে সিটুই সবটা দেখভাল করত। ইদানীং তৃণমূলের শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারাই ব্যাপারটা সামলে নিয়েছেন। অটো-পিছু মৌখিক পারমিট এবং দিনে আয় ধরলে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় হয় প্রতি মাসে। যার কিছুটা দলের তহবিলেও ঢোকে, জানাচ্ছে ইউনিয়নেরই একটি অংশ।
মথুরাপুর রুটের আইএনটিটিইউসি-র ইউনিয়নের স্টার্টার হাকিম বারি পিয়াদা এটা মেনে নিচ্ছেন যে রুটে বেআইনি অটো চলে। তবে তাঁর বক্তব্য, প্রতি দিন যে ১০ টাকা করে টোকেন কেটে তোলা হয় প্রতি অটো থেকে, তা দিয়ে ৮ জন কর্মীর বেতন দিতে হয়। কিন্তু প্রায় ৫০০-৬০০টি অটো থেকে যা টাকা ওটে, গোটাটাই কি মাইনে দিতে চলে যায়? ওই নেতার বক্তব্য, মেরেকেটে দু’আড়াইশো অটো চলে প্রতি দিন। ফলে রোজগার তত বেশি হয় না।
বেআইনি অটোর দাপাদাপি নিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, বিষয়টি জেলা আঞ্চলিক পরিবহণ আদিকারিকের অধীনে। সেখান থেকে কোনও নির্দেশ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক জয়ন্ত দাস বলেন, ‘‘আমরা বেআইনি অটোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছি। ইতিমধ্যে বারুইপুরে অভিযান চলেছে। বাকি মহকুমাতেও অভিযান চালান হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy