E-Paper

গ্রামের দেওয়াল জুড়ে সহজ পাঠের আসর

উত্তর ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত এলাকা বনগাঁর মোল্লাহাটি গ্রাম মূলত আদিবাসী প্রধান। বেশির ভাগই দরিদ্র মানুষের বাস। বহু অপ্রাপ্তির চিহ্ন তার পায়ে পায়ে জড়িয়ে।

সীমান্ত মৈত্র  

শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৭:১৯
মোল্লাহাটি গ্রামের বাড়িতে আঁকা ছবি। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

মোল্লাহাটি গ্রামের বাড়িতে আঁকা ছবি। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক

গ্রামের পথে চলতে ফিরতে কত কিছু যে শিখছে ওরা!

কোনও বাড়ির দেওয়ালে তুলি বুলিয়ে লেখা হয়েছে ইংরেজি এক-দুই-তিন চার...। কোনও বাড়ির গায়ে দক্ষ হাতে আঁকা গাছ। কোনটা তার কাণ্ড, কোনটা মূল, কোনটা পাতা, কোনটা ফুল— সে সব চিহ্নিত করা আছে। হাত ধুলে কী কী রোগ এড়ানো যায়, গ্রামের বাড়ির দেওয়ালেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সে সব চিত্র।

উত্তর ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত এলাকা বনগাঁর মোল্লাহাটি গ্রাম মূলত আদিবাসী প্রধান। বেশির ভাগই দরিদ্র মানুষের বাস। বহু অপ্রাপ্তির চিহ্ন তার পায়ে পায়ে জড়িয়ে। বেশির ভাগ ছোট ছোট মাটির বাড়ি— কোনওটা টালির চালের কোনওটায় টিনের ছাউনি। মাটি লেপা পাটকাঠির বাড়ির ফাঁকফোঁকর গলে উঁকি দেয় শীর্ণকায় চেহারাগুলো। সংকীর্ণ, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট গ্রামের ভিতরে। কিছু পুকুর, ডোবা, ঝোপজঙ্গল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। খুপরি খুপরি দোকান ঘর। শ’তিনেক পরিবারের বাস এখানে। খেতমজুরি, দিনমজুরি করেন বেশির ভাগ মানুষ। হাতে গোনা জনা দশেক সরকারি চাকুরিজীবী।

এ হেন গ্রামে শিক্ষারও তেমন গরজ ছিল না অনেক পরিবারে। একটি প্রাথমিক স্কুল এলাকায়। সেখানে অনেকে ভর্তি হলেও পরবর্তী সময়ে পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তেমন তাগিদ ছিল না অভিভাবকদের। এই পরিবেশ বদলাতেই এগিয়ে আসেন স্থানীয় জনা দশেক শিক্ষিত যুবক-যুবতী। তাঁদের উদ্যোগেই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় আগ্রহী করে তুলতে গ্রামের বাড়ি বাড়ি দেওয়ালে ছবি আঁকার পরিকল্পনা করা হয়। কোভিডের সময় থেকে এই উদ্যোগে বেশ সাড়া মিলছে বলে দাবি প্রসাদ বিশ্বাস, অমল সর্দার, প্রভাস মণ্ডল, পূর্ণিমা মণ্ডল, সূর্যমণি সর্দারদের। তাঁদের পরিকল্পনা মাফিক দেওয়ালে দেওয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সহজ পাঠের আসর।

প্রসাদ বলেন, ‘‘আমাদের গ্রামে ছেলেমেয়েরা কার্যত পড়াশোনা করত না। গ্রাম সম্পর্কে বাইরের মানুষের নেতিবাচক ধারণা ছিল। কলেজে পড়ার সময়ে তা বুঝতে পারি। তখন থেকেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এমন কিছু করতে হবে, যাতে এই গ্রাম সম্পর্কে মানুষের ধারণা পাল্টে যায়।’’ কার্যত ‘অশিক্ষিত’ গ্রামের তকমা নিয়ে যাঁরা বড় হয়েছিলেন, তাঁরাই পরিস্থিতি বদলাতে হাল ধরেন।

কোভিডের সময় গ্রামের এই ছেলেমেয়েরা মানুষকে চাল-ডাল, খাদ্যসামগ্রী দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। পাঠাগার তৈরি করা হয়। সেখানে ছেলেমেয়েদের বিনা পয়সায় এই যুবক-যুবতীরাই পড়ানো শুরু করেন। প্রসাদের কথায়, ‘‘দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি এঁকে শিশুমনে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল। এখন গ্রামের প্রায় সব পরিবারের ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। পথ চলতে চলতেই ছবি দেখে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ পাচ্ছে তারা।’’

নীলকর সাহেবদের স্মৃতি এখনও ছড়িয়ে এই এলাকায়। নীলকুঠির ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ে। কথিত আছে, ব্রিটিশ আমলের ডাক বাংলোয় সাহেবেরা এসে থাকতেন। নীলচাষিদের উপরে অত্যাচার চলত সেখানে। তারও দেওয়ালে ছবি আঁকা হয়েছে। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং স্থানীয় নীলকুঠিইছামতী গ্রন্থাগারের উদ্যোগে আঁকা হয়েছে। দেওয়ালে প্রাথমিক পাঠ দেওয়ার পাশাপাশি ছবির মাধ্যমে এলাকার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। ইংরেজরা কী ভাবে নীলচাষিদের ধরে আনত, অত্যাচার করত— সে সব তুলে ধরা হয়েছে। প্রসাদ বলেন, ‘‘নিজেদের জন্মভূমির ইতিহাস শিশুদের জানা উচিত। বিখ্যাত মানুষদের বাণী ও ছবি-ব্যানার ছাপিয়ে গ্রামে লাগানোর পরিকল্পনা করেছি। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহযোগিতা করছে।’’

সপ্তম শ্রেণির ঝুমা সর্দার, চতুর্থ শ্রেণির শর্মিলা সর্দার, উৎপল সর্দারেরা জানায়, ছবি দেখে অনেক কিছু শিখতে পেরেছে। তাদের কথায়, ‘‘ক্লাসে যা যা পড়ি, তা গ্রামের বাড়ির দেওয়ালে আঁকা দেখি। মজা লাগে। পড়া মনেও থেকে যায়।’’ জাতীয় ফুল, ফল,পাখি, পশু, জাতীয় খেলা, জাতীয় পতাকা— এ সবেরও ছবি আঁকা দেওয়ালে। সুরজিৎ সর্দার নামে এক গ্রামবাসীর কথায়, ‘‘দেওয়ালে আঁকা ছবি দেখে ছেলেমেয়েদের পড়ার আগ্রহ বেড়েছে।’’

বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি জাফর আলি মণ্ডল, বনগাঁর বিডিও কৃষ্ণেন্দু ঘোষ এই কর্মকাণ্ড দেখতে গিয়েছিলেন গ্রামে। জাফর বলেন, ‘‘যুবকদের এই প্রচেষ্টায় এলাকায় শিক্ষার প্রসার বেড়েছে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। ওঁরা দৃষ্টান্তমূলক কাজ করছেন। পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে আমরা ওই এলাকায় একটি ইকো ট্যুরিজ়ম পার্ক তৈরির কাজ শুরু করেছি। এর ফলে ওই এলাকার মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানেরওব্যবস্থা হবে।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

English alphabet

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy