বারুইপুর আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় ধৃতেরা। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।
জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে ভয়ঙ্কর ডাকাত দুর্গানারায়ণ চৌধুরী ও তার দলের খপ্পরে পড়েছিলেন এক দল পর্যটক। তাঁদের মধ্যে এক মহিলার শিরশ্ছেদও করেছিল ডাকাতেরা। এমনকী, এক শিশুর কপাল তাক করে এক ডাকাত প্রায় গুলি চালিয়ে ফেলেছিল। অবশ্য শেষ মুহূর্তে বেঁচে যায় শিশুটি।
কুলতলি এলাকার পিয়ালি আইল্যান্ড ট্যুরিস্ট লজে গুলি চালিয়ে লুঠপাট করা বাস্তবের দুর্বৃত্তেরা অবশ্য রামগোপাল বর্মার ‘জাঙ্গল’ ছবির দুর্গা ডাকাতের মতো অতটা দুর্ধর্ষ নয়। তা সত্ত্বেও শনিবার গভীর রাতের ওই ঘটনা সুন্দরবন অঞ্চলে বেড়াতে ইচ্ছুক মানুষদের অনেকেরই বুকে কাঁপুনি, হাঁটুতে ঠকঠকানি ধরিয়ে দিয়েছে।
এতটাই যে, বহু দিন আগে অগ্রিম জমা দিয়ে করা বুকিং সোমবার সকালে কেউ কেউ বাতিল করেছেন, অনেকে আবার অনবরত ফোন করে খোঁজ নিচ্ছেন, এই পরিস্থিতিতে আদৌ ওই তল্লাটে যাওয়া ঠিক হবে কি না। কারও আবার সপ্তাহ খানেক পরে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও এক কথায় সেটা বাতিল করেছেন।
বাঘাতীনের বাসিন্দা, পেশায় স্কুল শিক্ষিকা পায়েল সরকার ও তাঁর স্বামী দয়াপুরের একটি বেসরকারি রিসর্ট বুক করেছিলেন। কাল, বুধবার থেকে শনিবার ওখানে থাকার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পায়েল দেবী বলেন, ‘‘সোমবার সকালে ফোন করে ওই লজে বুকিং বাতিল করে দিয়েছি। কুলতলির ঘটনা জেনে খুব ভয় লাগছে।’’ পায়েল ও তাঁর স্বামী ওই চার দিন দিঘায় বেড়াতে যাবেন। আবার দমদমের মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় সপ্তাহ খানেকের মধ্যে মেয়ে ও স্বামীর সঙ্গে সুন্দরবনে যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু সোমবার মিতা দেবী বলেন, ‘‘কুলতলির ঘটনার পর সুন্দরবনে যাওয়ার কথা আপাতত আর মাথাতেই আনছি না। যা চলছে চার দিকে, তাতে আদৌ কোথাও বেড়াতে যাব কি না, সেটাই ভাবছি।’’
সজনেখালিতে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দফতরের ম্যানেজার সোমনাথ দত্ত বলেন, ‘‘কুলতলির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর সকাল থেকে বেশ কয়েকটি সফর বাতিল করার জন্য বেশ কিছু ফোন এসেছে।’’ সোমনাথবাবু স্বীকার করে নেন, কুলতলির ঘটনার পর পর্টকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। দয়াপুরের বেসরকারি রিসর্ট-এর কর্তা উদয়শঙ্কর রায়ও একমত, ‘‘এ বার সুন্দরবনে বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারেও পর্যটকদের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হল।’’ বস্তুত, বহু রিসর্ট মালিক ও ট্যুর অপারেটর-এর বক্তব্য, সন্ত্রাসবাদী হোক বা স্থানীয় ডাকাতদল, তারা পর্যটকদের ক্ষতি করে না— এই ধারণাটাই বড়সড় ধাক্কা খেল পিয়ালি আইল্যান্ড ট্যুরিস্ট লজের ঘটনায়। যে কারণে সরকারি, বেসরকারি রিসর্ট বা ল়জ কর্তৃপক্ষ উদ্বিগ্ন পর্যটকদের বার বার আশ্বাস দিলেও অনেকেই আশ্বস্ত হচ্ছেন না।
শুধু কথায় যে চিঁড়ে ভিজবে না, সেটা বুঝে সাতজেলিয়া দ্বীপের একটি বেসরকারি রিসর্ট-এর কর্তা রাজীব দেবনাথ বলেন, ‘‘পযর্টকদের আমরা বলছি, কোনও চিন্তা নেই, আসুন, আপনাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমরা নিচ্ছি।’’ সেই জন্য ওই রিসর্ট-এ রাতে চার জনের জায়গায় আট জন নিরাপত্তারক্ষীর বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। ৩ এপ্রিল নিউ আলিপুর থেকে জনা দশেক পর্যটকের ওই রিসর্ট-এ যাওয়ার কথা। সোমবার নিউ আলিপুর থেকে একাধিক বার ওই রিসর্ট-এ ফোন করে জানতে চাওয়া হয়েছে, পরিস্থিতি ভ্রমণের পক্ষে আদৌ অনুকূল কি না।
একই দিনে দয়াপুরের বেসরকারি রিসর্ট-এ ৫৫ জনের বুকিং। সেখানে আগে থেকেই আট জন নিরাপত্তারক্ষী, তাঁদের মধ্যে তিন জন ছিলেন বন্দুকধারী, এ বার সেই জায়গায় রক্ষীর সংখ্যা ও বন্দুকের সংখ্যা দু’টোই দ্বিগুণ করা হচ্ছে।
বাসন্তী-গোসাবা এলাকায় প্রায় সরকারি-বেসরকারি ৫০ থেকে ৬০টি লজ রয়েছে। গোসাবার বালি নেচারক্লাব রিসর্ট-এর তরফে অনিল মিস্ত্রি বলেন, ‘‘সকাল থেকে লজে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে একাধিক পর্যটক খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করেছেন। আমরা পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছি।’’ শুধু সরকারি-বেসরকারি হোটেল-লজ নয়। নদীপথে বিভিন্ন লঞ্চ ভা়ড়া নিয়ে পর্যটকরা সফর করেন। সেই মত লঞ্চ কারবারিরাও অগ্রিম বুকিং নিয়ে থাকেন। ক্যানিং এলাকার লঞ্চ ব্যবসায়ী শম্ভু মান্না বলেন, ‘‘আমাদের কাছেও সকালে একাধিক ফোন এসেছে। সবাই জানতে চান, এখন আসাটা নিরাপদ কি না।’’
এই অবস্থায় দয়াপুরের বেসরকারি রিসর্ট-এর কর্তা উদয়শঙ্করবাবুর দাবি, পুলিশকে রাতে টহলদারি বাড়াতে হবে, লজগুলির সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ রাখতে হবে, জলপথেও টহলদারি দিতে হবে এবং সড়কপথেও পেট্রোল ভ্যানের ব্যবস্থা করতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy