Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কোলে নেতিয়ে পড়ছে মেয়ে, মাঝরাতে মাঝি খুঁজছেন বাবা

সাপে ছোবল মারলে ওঝা-গুনিনের কাছে দৌড়ে লাভ নেই, এটুকু জানা ছিল মেয়ের বাবার। হাসপাতালের দিকেই রওনা দিয়েছিলেন তিনি।

চলে গেল সাড়ে চার বছরের এই মেয়েই।

চলে গেল সাড়ে চার বছরের এই মেয়েই।

সামসুল হুদা
ক্যানিং শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:০৩
Share: Save:

সাপে ছোবল মারলে ওঝা-গুনিনের কাছে দৌড়ে লাভ নেই, এটুকু জানা ছিল মেয়ের বাবার। হাসপাতালের দিকেই রওনা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে নদী পেরিয়ে যখন পৌঁছলেন হাসপাতালে, তখন কেটে গিয়েছে ঝাড়া তিন ঘণ্টা। সাড়ে চার বছরের মেয়ে বৃহস্পতি অধিকারীকে আর বাঁচাতে পারেননি ক্যানিং মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসকেরা।

রবিবার রাতের এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, সুন্দরবনের চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল। সুন্দরবন পৃথক জেলা হবে বলে ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেই ঘোষণার পরে বছর ঘুরতে চললেও এখনও প্রশাসনিক তৎপরতা কিছুই শুরু হয়নি। বাচ্চা মেয়েটির মৃত্যুতে ফের উঠছে প্রশ্ন, জেলা কবে হবে সুন্দরবন। প্রশ্নটা উঠছে এই আশা থেকে, পৃথক জেলা হলে হয় তো সুন্দরবনের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর হালও ফিরবে।

বৃহস্পতির বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালির গাববেড়িয়ায়। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, রাতে খাওয়া-দাওয়ার পরে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুমোচ্ছিল মেয়েটি। রাত প্রায় ১২টা নাগাদ তাকে সাপে ছোবল মারে। মেয়ের কান্নায় ঘুম ভাঙে বাবা-মায়ের। তাঁরা ঘরের আলো জ্বেলে দেখেন, তখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে একটি কালাচ সাপ।

বিপদ বুঝে মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েন বাবা কিশোর অধিকারী। সন্দেশখালির যে এলাকায় তাঁর বাড়ি, সেখান থেকে একটা নদী পেরিয়ে ক্যানিং মহকুমা হাসপাতালে যেতে ঘণ্টাখানেক লাগে দিনের অন্য সময়ে।

কিন্তু তখন তো মাঝরাত।

খেয়াঘাটে গিয়ে কিশোরবাবুরা দেখেন, নৌকো ঘাটে বাঁধা থাকলেও মাঝির পাত্তা নেই। কিছু দিন আগেই এমন পরিস্থিতিতে হিঙ্গলগঞ্জে পুলিশ ভুটভুটি ডেকে এনে অসুস্থ এক ব্যক্তিকে ঝড়-জলের রাতে নদী পার করিয়ে বসিরহাট জেলা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। সে যাত্রা প্রাণে বেঁচেছিলেন ওই ব্যক্তি।

কিন্তু বৃহস্পতির ভাগ্য ততটা সুপ্রসন্ন ছিল না।

মাঝি পেতে হিমসিম খেতে হয় কিশোরবাবুকে। সদ্য কন্যাহারা বাবা বলেন, ‘‘চোখের সামনে দেখছিলাম, মেয়েটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে। কিন্তু কিচ্ছু করতে পারছিলাম না। ওকে কোলে করে ছুটোছুটি করছিলাম মাঝির খোঁজে।’’

এক সময়ে মাঝির জোগাড় হয়। নৌকোও মেলে। গাববেড়িয়া নদী পেরিয়ে ও পাড় থেকে মোটর ভ্যান ধরে যখন ক্যানিং মহকুমা হাসপাতালে পৌঁছন সকলে, তখন মেয়েটি নেতিয়ে পড়েছে। ঘড়ির কাঁটায় রাত প্রায় সাড়ে ৩টে।

হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু হয় বৃহস্পতির। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ভোর ৫টা নাগাদ মারা যায় সে।

হাসপাতাল সূত্রে জানানো হয়েছে, আর কিছুক্ষণ আগে পৌঁছতে পারলে হয় তো বাঁচানো সম্ভব হতো শিশুটিকে।

কিন্তু কী আর করতে পারতেন অসহায় বাবা!

কিশোরবাবু বলেন, ‘‘আমরা যে জায়গায় থাকি, সেখান থেকে নদী পেরিয়ে রাতবিরেতে কাউকে হাসপাতালে আনা তো সহজ কাজ নয়। তাই চোখের সামনে মেয়েটাকে এ ভাবে মরতে দেখতে হল।’’ কিশোরবাবুর আফসোস, কাছাকাছি যদি হাসপাতাল পেতাম, তা হলে মেয়েটাকে হারাতাম না।

কিন্তু সন্দেশখালি ব্লক হাসপাতালে কেন গেলেন না কিশোরবাবুরা?

জানা গেল, দ্বীপভূমি সন্দেশখালির ক্ষেত্রে সেই দূরত্বটা আরও বেশি। সময়ও লাগে বেশি। তা ছাড়া, নদী পেরোতে লাগে দু’দুটো। যার ফলে সন্দেশখালির বহু মানুষই প্রয়োজনে ক্যানিং হাসপাতালেই যান। এ ক্ষেত্রেও সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কিশোরবাবুরা।

কিন্তু মাঝি পেতে দেরি হওয়ায় আরও অনেক দূরের পথে পাড়ি দিল ছোট্ট বৃহস্পতি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Child Snake bite death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE