Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পাচন দিয়ে পেটানো হয়েছিল এজেন্টকে

অর্থলগ্নি সংস্থার চক্করে পড়ে বহু টাকা খুইয়েছেন অনেকে। কেউ আবার নিজেরা এজেন্ট হয়ে বাজার থেকে টাকা তুলেছেন দেদার। নিজেরাও টাকা ঢেলেছেন সংস্থায়। আরও তাড়াতাড়ি আরও বেশি মুনাফার আশায় তাঁদের সকলেরই ক্ষতি হয়েছে প্রচুর। কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন। কেউ এখনও অথৈ জলে। খোঁজ নিল আনন্দবাজার। কয়েক বছর আগে একটি ভুঁইফোড় আর্থিক প্রতারণা চক্রের খপ্পরে পড়েন তিনি। চক্রের এজেন্টদের চালচলন, লাইফ স্টাইল দেখে গ্রামের অনেকেই প্রভাবিত হয়েছিলেন।

নারায়ণপ্রসাদ বসু

নারায়ণপ্রসাদ বসু

সীমান্ত মৈত্র
বাগদা শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৩৯
Share: Save:

হাতুড়ে চিকিৎসা করে কোনও রকমে দিন কাটছিল বাগদার আমডোব গ্রামের বৃদ্ধ নারায়ণ প্রসাদ বসুর। পরিবারে অভাব থাকলেও শান্তি ছিল।

কয়েক বছর আগে একটি ভুঁইফোড় আর্থিক প্রতারণা চক্রের খপ্পরে পড়েন তিনি। চক্রের এজেন্টদের চালচলন, লাইফ স্টাইল দেখে গ্রামের অনেকেই প্রভাবিত হয়েছিলেন। মোটা কমিশনের আশায় তিনি শিবম কালটিভেশন প্রাইভেট লিমিটেড নামে ওই সংস্থার এজেন্টের কাজ নেন। গ্রামের মানুষের কাছ থেকে তিনি টাকা সংগ্রহ করতেন। কম সময়ে বেশি সুদের আশায় গ্রামের মানুষও লক্ষ লক্ষ টাকা রাখতে শুরু করেন। প্রথম কিছুদিন সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু বছর দশেক আগে সংস্থার কর্মকর্তারা টাকা পয়সা নিয়ে কেটে পড়েন। সাধারণ মানুষ টাকা না পেয়ে এজেন্টদের উপর চড়াও হয়।

নারায়ণ নিজেও জমি গরু-ছাগল বিক্রি করে কয়েক লক্ষ টাকা রেখেছিলেন। গ্রামের মানুষের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা তুলেছিলেন। সব মিলিয়ে লাখ ২৫ টাকা হবে। তাঁর অধীনে প্রায় সত্তোর জন টাকা রেখেছিলেন।

তাঁরা প্রতারিত হয়েছেন বুঝতে পেরে গ্রামের মানুষের রাগ গিয়ে পড়ে নারায়ণের উপর। শুরু হয় বাড়িতে এসে হুমকি গালিগালাজ। প্রাণ ভয়ে বাড়ি থেকে বেরনো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বৃদ্ধের। এরই মধ্যে ঘটে যায়, অভিশপ্ত ঘটনাটি। বছর পাঁচেক আগে একদিন সাইকেল নিয়ে নারায়ণ যাচ্ছিলেন নিজের চেম্বারে। রাস্তায় বেশ কিছু প্রতারিত মানুষ তাঁকে সাইকেল থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন। এরপর শুরু হয় পাচন দিয়ে (গরু চরানোর লাঠি) বেধড়ক পেটানো। যন্ত্রণায় রাস্তায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। এলাকারই কিছু মানুষ এসে তাঁকে রক্ষা করেছিলেন। মানুষ যদি বাঁচাতে না আসতেন তা হলে কী হতো তাঁর, ভাবলে আজও শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায় নারায়ণের।

ওই ঘটনার পর থেকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আজও সুস্থ হতে পারেননি। টালি, মাটির দেওয়াল দেওয়া বাড়িতে বসে নারায়ণ বলেন, ‘‘এখনও রাতে ঘুমতে পারি না। ভিটে বাড়ি পর্যন্ত লিখে নিতে চেয়েছিল গ্রাহকেরা। এখন অবশ্য তাঁরা বুঝেছেন।’’ অতীতে তিনটি চেম্বার না থাকলেও এখন একটি মাত্র চেম্বার করছেন তিনি।

আমডোবের বাসিন্দা প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য গণেশ ঘোষও ওই সংস্থায় টাকা রেখে প্রতারিত হয়েছেন। পাশাপাশি এজেন্ট হিসাবেও কয়েক লক্ষ টাকা তুলেছিলেন। পরে নিজের জমি বিক্রি করে গ্রাহকদের পঞ্চাশ শতাংশ টাকা শোধ করেছেন। এজেন্ট ও গ্রাহকেরা জানান, ওই সংস্থার প্রচুর জমি, ভেড়ি, অফিসবাড়ি, ফলের বাগান রয়েছে। সরকারের কাছে অনুরোধ, ওই সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা ফেরানোর ব্যবস্থা করা হোক। শিবম নয়, বাগদা ব্লকে অতীতে সারদা, রোজভ্যালি, অ্যালকেমিস্ট, রুবিস্টার, রেনেসাঁস, লেপার্টের মতো গোটা দশেক ভুঁইফোড় আর্থিক সংস্থা মারফৎ মানুষ প্রতারিত হয়েছে। গচ্ছিত টাকা ফেরৎ না পেয়ে ব্লকের হাজার হাজার মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছেন। আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা বাগদা ব্লকের বহু চাষি এখন দিন মজুরিতে পরিণত হয়েছেন। কারণ তাঁরা নিজেদের জমি বিক্রি করা টাকা রেখেছিলেন। বেসরকারি হিসাবে, গত কয়েক বছরে ব্লকের মানুষের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা লোপাট হয়ে গিয়েছে। ওই সব সংস্থার কর্মকর্তারা কেউ জেলে, কেউ জামিনে মুক্ত। কেউ আবার পরবর্তী সময়ে ভোটে দাঁড়িয়ে জয়ী হয়ে পঞ্চায়েতের উপপ্রধানও হয়েছেন। এক এজেন্ট বলছিলেন, ‘‘বাগদা ব্লকের অর্থনীতিটাই ভেঙে পড়েছে। মাথা তুলে দাঁড়াতে সময় লাগবে।’’

বাসিন্দারা জানালেন, সংস্থার এজেন্টরা গাড়ি নিয়ে গ্রামে আসত। তাদের কথাবার্তায় প্রভাবিত হয়েছিলেন মানুষ। রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা ওই সব সংস্থার হয়ে কথা বলতেন। তাদের অনুষ্ঠানে যেতেন। এজেন্টরাও ক্লাবগুলোকে হাতে রাখতে টাকা দিত। সাধারণ মানুষের দাবি, প্রতারকদের শাস্তির পাশাপাশি টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করুক আদালত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Chit Fund Scam Agent
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE