Advertisement
E-Paper

এখনও শ্রীহীন জমি-জিরেত

প্রত্যন্ত এই এলাকা কোনও কালেই অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ ছিল না। তবে কিছু কিছু চাষবাস করে, সমুদ্র, পুকুরে মাছ ধরে সংসার চালিয়ে নিতেন মানুষজন। আমপানের দাপট জীবনের সেই স্বাভাবিক ছন্দকেই তছনছ করে দিয়েছে। 

দিলীপ নস্কর 

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২০ ০৯:৪২
কোনওমতে: মাথা গুঁজে আছেন রণজিৎ পাড়ুই। নিজস্ব চিত্র।

কোনওমতে: মাথা গুঁজে আছেন রণজিৎ পাড়ুই। নিজস্ব চিত্র।

হাত ধরে এক রকম টানতে টানতেই নিয়ে যাচ্ছিলেন রণজিৎ পাড়ুই। সেই সঙ্গে শাপশাপান্ত করছিলেন। কপাল চাপড়াচ্ছিলেন থেকে থেকে।

খানিক দূরে দেখা গেল, দোমড়ানো মোচড়ানো একটা টালির বাড়ি পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। সে দিকে আঙুল দেখিয়ে রণজিতের চোখে জল। বললেন, ‘‘জানেন, ওইটেই ছিল আমার ঘর। রাক্ষুসে আমপান সব শেষ করে দিয়েছে।’’

তিন ছেলেমেয়ে, বৌকে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে এলাকাতেই প্লাস্টিকের ছাউনি খাটিয়ে এখন রাত কাটে রণজিতের। জানালেন, ঘর সারানোর ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে পঞ্চায়েতের দোরে দোরে ঘুরেছেন। হাতে পেয়েছেন মাত্র ৫ হাজার টাকা।

ছ’মাস আগে, ২০ মে সকালে সমুদ্র লাগোয়া সাগরের এই অংশেই আছড়ে পড়ে আমপান। ছ’মাস পড়ে আমপানের জিরো পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেল, সেই ভয়াবহ ক্ষতে কার্যত প্রলেপ পড়েনি এখনও। ছন্নছাড়া অবস্থা সাগরের ধবলাট পঞ্চায়েতের শিবপুর গ্রামের। বেশিরভাগ মানুষই অন্যত্র সরে গিয়েছেন। আর রণজিতের মতো কেউ কেউ দাঁতে দাঁত চেপে ত্রিপল টাঙিয়ে রাত কাটাচ্ছেন পৈত্রিক ভিটের ধ্বংসস্তূপ আগলে।

ঝড়-জলের দাপটে সে দিন সমুদ্রবাঁধ-লাগোয়া মাটির বাড়িগুলি কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। তারই কিছু টালি, বাঁশের কাঠামো এখনও পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রনজিৎ পারুইয়ের মাটির দেওয়াল, টালির ছাউনির বাড়ির অবস্থাও সে রকমই। রণজিৎ বলেন, ‘‘৫ হাজার টাকায় কী হয় বলুন তো!’’

হয়নি কিছুই। এখন কোনও কোনও দিন হয় তো দিনমজুরির কাজ পান বছর ষাটেকের রণজিৎ। দু’একশো টাকা আয় হয় সে দিন সে দিন। তাই দিয়ে কার্যত মুড়ি চিবিয়ে দিন কাটছে।

প্রতিবেশী সামন্ত কালসা, তরুণ কালসা, বিশ্বনাথ কালসারাও জানালেন, বাড়িঘর ঝড়ে উড়ে গেলেও ক্ষতিপূরণ কার্যত কিছুই পাননি। কোনও রকমে জোড়াতালি দিয়ে মাথা গুঁজে আছেন। কেউ কেউ চেয়েচিন্তে একখানা ত্রিপল হয় তো জোগাড় করেছেন।

সমুদ্রবাঁধের প্রায় দু’শো মিটার দুরে প্রহ্লাদ মালের বাড়ি। ঝড় আসছে জেনে মাটির দেওয়ালের অ্যাববেস্টসের ছাউনির ঘর চারিদিকে আড়াআড়ি ভাবে মোটা কাছি দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন। একটা সময়ে ঝড়ে-মানুষে অসম লড়াইয়ে জিতে যায় প্রকৃতিই। অ্যাসবেস্টসের চাল খড়কুটোর মতো উড়ে যায় চোখের সামনে। ভেঙে পডে বাড়ি।

প্রহ্লাদরা আর সেই বা়ড়িতে ওঠেননি। আগে দিনমজুরি করে, পুকুরে মাছ ধরে সংসার চলত। এখন সপরিবার চলে গিয়েছেন ফলতায়। সেখানে চানাচুর কারখানায় কাজ করেন। বললেন, ‘‘এলাকায় কাজকম্মো নেই। বাড়ি সারানোর টাকাও পাইনি। তাই চলে এলাম।’’

এমন অনেকেই আছেন, আমপানের পরে পরিস্থিতি একু স্বাভাবিক হতে শুরু করলে আর বাড়িমুখো হননি।

প্রত্যন্ত এই এলাকা কোনও কালেই অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ ছিল না। তবে কিছু কিছু চাষবাস করে, সমুদ্র, পুকুরে মাছ ধরে সংসার চালিয়ে নিতেন মানুষজন। আমপানের দাপট জীবনের সেই স্বাভাবিক ছন্দকেই তছনছ করে দিয়েছে।

এ বার পান চাষ তেমন কিছু হচ্ছে না বলে জানালেন দুলাল দাস, ব্রজনাথ জানারা। এলোপাথাড়ি হাওয়ায় পানের বরজ সব নষ্ট হয়েছিল। আর সারিয়ে উঠতে পারেননি কেউ।

লতিব মোল্লা, কাসেম মোল্লারা জানালেন, সামান্য চাষবাস করে, পুকুরে মাছ ধরে কোনও রকমে চলছিল সংসার। কিন্তু চাষের জমি নোনা জলে অনাবাদী হয়ে পড়েছে। নোনা জল ঢোকার পরে পুকুরও সংস্কার করার ক্ষমতা নেই কারও। ফলে মাছ চাষও হচ্ছে না। সমুদ্রের বাঁধ ভাঙতে ভাঙতে অনেকের জমিজমা, পুকুর আগেই তলিয়ে গিয়েছিল বলে জানালেন গ্রামের অনেকে। আমপান সেই ক্ষত আরও গভীর করেছে। এবং ক্ষত উপশমে প্রশাসন, সরকারকে তাঁরা পাশে পাননি বলে অভিযোগ অনেকের। এলাকার বিজেপি নেতা নন্দলাল দাস জানালেন, আমপানে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তেরা অনেকেই টাকা পাননি। পঞ্চায়েতের নেতা-কর্মী বা শাসকদলের ঘনিষ্ঠরা ক্ষতিপূরণের ২০ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন। অনেক পরিবারের ৪-৫ জন সদস্যও টাকা পেয়েছেন। আর কিছু হতদরিদ্র মানুষের হাতে ৫ হাজার টাকা গুঁজে মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।

ধবলাট পঞ্চায়েতের উপপ্রধান সজল বারিক বলেন, ‘‘কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ পেতে সমস্যা হয়েছে।’’ কথা এগোনোর আগেই ‘ব্যস্ত আছি’ বলে ফোন কেটে দেন তিনি। সাগরের বিধায়ক বঙ্কিম হাজরা বলেন, ‘‘ক্ষতিগ্রস্তরা সকলেরই টাকা পাওয়ার কথা। কেন ওই পঞ্চায়েতে অনেকে টাকা পাননি, তা খোঁজ নেব।’’ পাশাপাশি তিনি জানান, এখনও পর্যন্ত অনেকের অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকছে। বাকিরাও পেয়ে যেতে পারেন। বিডিও সুদীপ্ত মণ্ডলের কথায়, ‘‘কিছু কিছু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর ঠিকঠাক ছিল না। সেগুলি সংশোধন করে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকে যাবে।’’

ঘর সারানোর বিশ হাজার টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে যদি ঢুকেও যায়, স্বাভাবিক ছন্দে কি কখনও ফিরতে পারবে গ্রাম, সে প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যাচ্ছে।

Cyclone Amphan Sundarban
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy